ছোটবেলায় এক বড় ভাইয়ের মুখে একটা গল্প শুনেছিলাম। গল্পের নাম "জুলাপের বড়ি"।
এক দেশে এক রাজা ছিলেন। রাজার একমাত্র কন্যার মুখে বাগি(বড় ফোড়া) হওয়াতে দেশের স্বনামধন্য সব ডাক্তার কবিরাজ ডাকা হল। কিছুতেই সেরে উঠছিলেন না রাজকন্যা। স্বভাবত রাজা খুবই উদ্বিগ্ন। উজির নাজির সবাইকে ডাকা হল। সিদ্ধান্ত হল - ঐ রাজ্যের ইহলোক ত্যাগকারী এক স্বনামধন্য কবিরাজের একমাত্র ছেলেকে ডাকা হবে। তিনি এই অসুখের কোন চিকিৎসা জানেন কিনা।
কবিরাজের ছেলেটা ছিল অনেকটা ভবঘুরে। পিতার থেকে কিছুই শিখে রাখেননি শুধু একটা জুলাপের বড়ি ছাড়া।
ডাকা হল কবিরাজের ছেলে নব্য কবিরাজকে।
রাজা: তুমি আমার কন্যাকে সুস্থ করে তুলতে পারবে?
নব্য কবিরাজ: মহারাজের অনুমতি পেলে রাজকুমারীকে সারিয়ে তোলা আমার জন্য কোন ব্যাপারই নয়।
(নব্য কবিরাজের কথা শুনে রাজা আশ্চর্য হলেন আবার মনে মনে খুশি হলেন কন্যার সেরে ওঠার কথা ভেবে।)
রাজা: চিকিৎসার অনুমতি দেয়া হল তোমাকে।
অনুমতি পেয়ে নব্য কবিরাজ বাড়ি চলে গেলেন। বাড়ি গিয়ে পিতৃসূত্রে শেখা বিশাল আকারের (রাজকন্যার মুখগহ্বর থেকে বড়) একটা জুলাপের বড়ি বানালেন। রৌদ্রস্নান করিয়ে বড়িটাকে শুকালেন। শুকনো বড়িটাকে নিয়ে হাজির হলেন রাজদরবারে।
রাজকন্যাকে হাজির করা হল নব্য কবিরাজের সামনে। একটা চেয়ারে বসানো হল রাজকন্যাকে। নব্য কবিরাজ তার কবিরাজী ঝুলি থেকে এবার বের করলেন জুলাপের বড়ি। রাজকন্যকে হা করতে বললেন নব্য কবিরাজ। রাজকন্যা হা করার চেষ্টা করলেন। খুব সামান্যই হা করতে সক্ষম হলেন। সেই সামান্য হা দিয়ে জুলাপের বড়ি খাওয়ানো সম্ভব হচ্ছিল না নব্য কবিরাজের। আরো বড় হা করতে বললেন রাজকন্যাকে। রাজকন্যা চেষ্টা করছেন আরো বড় হা করার জন্য। রাজকন্যার চেষ্টার একপর্যায়ে ফটাস একটা শব্দ হয়ে বাগিটা ফেটে ভিতরের বিষাক্ত রসগুলো বের হয়ে গেল। সুস্থ হয়ে উঠলেন রাজকন্যা। হাসি ফুটল রাজার মুখে,রাণির মুখে।খুশির বন্যা বয়ে গেল রাজ দরবারে,পুরো রাজ্যে। চারিদিকে নব্য কবিরাজের সুনাম ছড়িয়ে পড়ল।
কিছুদিন পরে দেখা দিল আরেক সমস্যা। এবার রাজ্যের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। স্বাধীনতা রক্ষার লড়াই।পাশের রাজ্য থেকে হুমকী আসছে এ রাজ্য দখল করে নেয়ার।
ঘুম নেই রাজার চোখে,উজির নাজিরের চোখে,রাজ্যের প্রজার চোখে। পাশের রাজ্যের সমর শক্তি অনেক বেশি। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কোন রাস্তাই খুজে পাচ্ছিলেন না রাজা । উজির নাজির নিয়ে দফায় দফায় সভায় বসে ও কোন সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পারছিলেন না।
অবশেষে ডাকা হল নব্য কবিরাজকে। খুলে বলা হল তাকে সমস্যার কথা। নব্য কবিরাজ সব শুনে রাজাকে বললেন- মহারাজ আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা যুদ্ধ করব এবং যুদ্ধে আমরাই জয়ী হব। রাজা বিস্মিত হয়ে বললেন সেটা কিভাবে সম্ভব? আমরা যে ওদের থেকে সব দিক থেকেই পিছিয়ে। নব্য কবিরাজ বললেন মহারাজ বেয়াদবি মাফ করবেন। আপনি শুধু আমার সাজেশন অনুযায়ী সব কিছু করতে উজির নাজিরকে অর্ডার দিয়ে দিন। রাজা বললেন কী করতে হবে বল। নব্য কবিরাজ বললেন- মহারাজ, যে নদী দিয়ে শত্রুপক্ষ আমাদের আক্রমণ করতে আসবে ঠিক সেই নদীর পাড়ে আমাদের সৈন্যদের জন্য তাবু গাড়তে হবে এবং নদীর পাড় ঘেঁষে সারিবদ্ধভাবে অসখ্য টয়লেট বসাতে হবে। রাজা সাথে সাথে হুকুম দিয়ে দিলেন সব ব্যবস্থা করার জন্য।
নব্য কবিরাজ রাজদরবার ছেড়ে বাড়ি চলে গেলেন। বাড়ি গিয়ে নিজ রাজ্যের সৈন্যসং্খ্যা অনুযায়ী মাথাপিছু একট করে জুলাপের বড়ি বানালেন। লোকজন দিয়ে সব জুলাপের বড়ি নদীর পাড়ে তাবুতে নিয়ে রাখা হল।সব সৈন্যদের তলব করা হল নদীর পাড়ের তাবুতে।
পাশের রাজ্য থেকে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। নব্য কবিরাজ বললেন, মহারাজ এবার প্রত্যেক সৈন্যকে একটি করে জুলাপের বড়ি খাইয়ে দিন। সবাইকে একটি করে জুলাপের বড়ি খাইয়ে দেয়া হল। খাওয়ানোর কিছু সময়ের মধ্যেই সবার পাতলা পায়খানা শুরু হয়ে গেল।সেনারা এবার টয়লেটে যাওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে গেছে। এ দৃশ্য দেখে রাজা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। নব্য কবিরাজ বললেন মহারাজ চিন্তা করবেন না যুদ্ধে আমরাই জয়ী হব।
শত্রুবাহিনী খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। কিন্তু নদীর পাড়ের দৃশ্য দেখে তারা ঘাবড়ে গেল। তারা ভাবল হাজার হাজার সৈন্য শুধু টয়লেটে যাওয়ার জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তাহলে এদের সৈন্য সং্খ্যা না জানি কত! এদের সাথে যুদ্ধ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা। সেনাপতির আদেশে সবাই নিজ দেশে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে ফিরে গেলেন।
যুদ্ধ না করেও জয়ী হলেন নব্য কবিরাজের মহারাজ, রক্ষা পেল রাজ্য।
গল্প শুনে বেশ আনন্দ পেয়েছিলাম।কিন্তু গল্পটার মাঝে আনন্দের পাশাপাশি যে কষ্ট আছে তখন খুবই ছোট্ট ছিলাম বলে অনুধাবন করতে পারিনি।
বড় ভাইকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত সেনাদের কী দশা হয়েছিল বা পরবর্তীতে রাজ্যের এবং রাজার কপালে কী ঘটেছিল।
সেই নব্য কবিরাজের অসং্খ্য প্রেতাত্মা আমার দেশের আকাশে বাতাসে ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। তারা আমার দেশের মানুষের ওপর তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে দলীয় তন্ত্র বা পরিবার তন্ত্র চাপিয়ে দিয়ে দেশ ও দেশের মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে যেমনি নব্য কবিরাজ জুলাপের বড়ি খাইয়ে হাজার হাজার সেনাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:১২