'সে' একজন মানুষ। আজ তার কোন নাম নেই, কোন সম্বোধনও নেই। সে শুধুই একজন মানুষ, যাকে সবাই রোবট ভাবে অথবা বানাতে চায়। সেও আজ ভেবেছে সে রোবট হবে, জানবে শুধু যান্ত্রিকতা, মানবিকতা নয়। সে জানবে কোথায় কতটুকু হাসি দিলে কিংবা বিষন্ন মুখ করলে অনুভূতির সঠিক বহিঃপ্রকাশ দিয়ে চারপাশের মানুষগুলোর তৃপ্তি মাখা মুখ দেখা যায়। তবে সে কাঁদতে জানবে না, কারন যন্ত্রমানবেরা কাঁদতে জানে না।
সাইন্স ফিকশনগুলোতে যে তৃতীয় ও চতুর্থ মাত্রার যন্ত্রমানব দেখা যায়, যারা জানে মানুষের হাসি-কান্না, কষ্ট-আনন্দ নামক কতগুলো মানবিক অনুভূতি আছে। তাদের মাঝে প্রোগ্রাম করা থাকে কোনগুলো মানুষের আনন্দ আর কোনগুলো বেদনা, কিন্তু তারা জানে না সে অনুভূতিগুলো কেমন। অনুভূতি প্রকাশের সময় মনে যান্ত্রিকতা আর মুখে মানবিকতা ফুটিয়ে মনুষ্য স্বরে বলবে আপনার, তোমার বা তোর আনন্দে আনন্দিত হলাম, আর দুঃখে দুঃখ দুঃখ ভাব করে বলবে আমি দুঃখিত। মানুষগুলো নিশ্চয়ই এই সূক্ষ্ম অভিনয়টুকু ধরতে পারবে না, কারন তারা যে ঠিক এমনই চায়। তার সমস্ত মানবিক অনুভূতিগলো সে হত্যা করবে নির্মমভাবে।
সে একদিন একটা রক্ত মাংসের অনুভূতিশীল একজন মানুষ ছিল। সে কাঁদতে জানত, হাসতে জানত। সেগুলো যান্ত্রিক ছিল না। সেগুলো ছিল তার অনুভূতিতে। মানুষের মন নামে যে অদৃশ্য কি একটা আছে না? সেখানে....
তার অনেক অভিমান ছিল, অনেক স্বপ্ন ছিল। ছোট্ট ছোট্ট চাওয়া পাওয়ার মাঝে অনেক সুখ ছিল। আজ থেকে তার এগুলোর কিচ্ছু নেই। তার যান্ত্রিকতা আছে। সে সবাইকে চাবি দেয়া পুতুলের মত খুশি করবে। সবাই যেমন শুনতে চায়, যেমন রূপ দেখতে চায় সবাই সেগুলোই দেখবে!
তার ছিল রাতের তারা ভরা, জোছনা প্লাবিত কিংবা মেঘলা আকাশ। বৃষ্টি ছিল, হিমেল হাওয়া ছিল। এর প্রত্যেকটায় সে আলাদা আলাদা অনুভবে হারিয়ে যেত। আপন অনুভূতিতে উদাস হয়ে যেত, মনটা কত জায়গায় ঘুরে বেড়াত। মন খারাপ হলে কেঁদে বালিশ ভেজাত। আরো বেশী মন খারাপ হলে মেঝে বসে থাকত, মাঝে মাঝে কুঁকড়ে শুয়ে মেঝেতে জমে থাকা চোখের জ্বলে ছবি আঁকত। মাঝে মাঝে বন্ধ দরজার আড়ালে চিৎকার করে ফুঁপিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করত, কিন্তু সে কখনও পারে নি। সে কাঁদত সবার চোখের আড়ালে।
মাঝে মাঝে কাউকে তার কষ্টের কথাগুলো বলতে খুব ইচ্ছা হত। সে তার কষ্টগুলো বুঝবে, অনুভব করবে, ভাগ করে নেবে। অন্তত অনুভব করতে না পারলেও বলবে, "শোন তুমি একদম কাঁদবে না, তুমি তো একা নও, তোমার জন্য আমি আছি। তোমার কষ্টগুলো শুধু তোমার না, আমারও।" কেউ না বুঝে এই কথা গুলো বললেও এই অর্থহীন কথাগুলো শোনার জন্য সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত। কেউ তার আকুলতাটা বোঝে নি, সে আর অপেক্ষা করবে না। সে বুঝে গেছে তার কষ্টগুলো কারো নয়, তার একার, শুধু একার....
সে নিরর্থক অনেক কেঁদেছে, কিন্তু আর না। আজকে সে চিৎকার করে নয় ফুঁপিয়ে ষুঁপিয়ে অনেক কেঁদেছে। শীতল মেঝের সাথে মিশে শীতল হতে শিখেছে, চোখার জলের সাথে শেষ বারের মত অনেক কথা বলেছে। শেষ পর্যন্ত নিজের উপরে প্রচন্ড আক্রোশে মুষ্টিবদ্ধ একটা আঘাত হানল দেয়ালে, আশ্চর্য একটুও ব্যাথা পেল না। সে যে মানুষ এটা প্রমান করতেই হাতের কিছু অংশ একটু ফুলে উঠল। তাতে কি! সে তার শরীরটাকে হত্যা করতে না পারলেও মনটাকে তো হত্যা করতে পারবে, অনুভূতিগুলোকে তো হত্যা করতে পারবে। পারবে মানুষে মুখোশের আড়ালে যন্ত্রমানব হয়ে থাকতে........
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১১ রাত ২:৩১