somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পারফিউম

২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে একদিন সাইকেল চালিয়ে বাসায় আসছি। রাত প্রায় সাড়ে বারটার মতন বাজে। মফস্বল এলাকায় এটা অনেক রাত। বৃষ্টির মধ্যে ল্যাম্পপোষ্টের আলো এক অপার্থিব সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। এই পবিত্রতম আলোতে দাড়িয়ে খুব করে আকিদের কথা মনে পড়ছে। আমার খুব কাছের বন্ধু, বিপদে পড়ার আগে যে ছুটে আসত। খুব ছোটবেলার বন্ধু আকিদ। হু হু করে মনে পড়ে যায় সব স্মৃতি। ছোটকালে একসাথে কতই না ঘুড়ে বেড়ানো কিংবা ক্রিকেট খেলা। একবার মনে আছে ক্রিকেট খেলতে খেলতে আমার একটা শট পাশের বাড়ির আঙ্কেলের বাসার কাঁচ ভেঙ্গে ফেলে। আঙ্কেল দৌড়ে ছুটে আসেন। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই আকিদ আঙ্কেলকে বলে সে কাঁচ ভেঙ্গেছে! আঙ্কেল কোন কথা না শুনেই আকিদকে টেনে নিয়ে কান ধরিয়ে সবার সামনে দাঁড়া করিয়ে রাখেন। আমি হতভম্ব হই। আমার হতভম্ব মুখের দিকে আকিদ তাকিয়ে হাসে। এই আমাদের বন্ধু আকিদ!
আকিদ ছিল আমাদের বেস্ট ফ্রেন্ড। আমরা চার জনের একটা গ্রুপ। আমি, চমক, নাহিয়ান আর আকিদ। যেখানেই যাই এই চার এক সাথেই থাকবে। এক সাথে ফিল্ম দেখতে যাওয়া, আড্ডা দেওয়া, গান শুনা, প্রাইভেট পড়া সব কিছু এক সাথে। তবে আকিদ সারাক্ষণই পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকত। আমরা সবাই ওকে মিনি আইনস্টাইন ডাকতাম। ক্লাসের ফার্স্ট প্লেসটা ওর জন্য থাকত! আমাদের লড়াইটা হত সেকেন্ড বা থার্ড হওয়ার জন্য।
আস্তে আস্তে যখন বড় হতে থাকি আকিদের সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে। ছেলেটা সিগারেট খেত না। কিন্তু কলেজে ওঠার পর আস্তে আস্তে আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই সিগারেটে আসক্ত হয়ে পড়ি। আমি জানি আমাদের এই চারজনের সার্কেল বাদে কারও সাথে আকিদের ওরকম ফ্রেন্ডশীপ ছিল না। ও সবার সাথে সহজে মিশতে পারত না তবে যার সাথে মিশত একদম পুরো মিশে যেত। একই কলেজে পড়ার সময়ও পড়া বাদে ওর সাথে তেমন আলাপ হয় নি। আমরা সিগারেট খেতাম বলে ও আমাদের সব সময় পাশ কাটিয়ে যেত। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে আমরাই ওকে পাশ কাটাতাম। এভাবেই কেটে যেতে লাগল দিন।
ইউনিতে উঠার পর প্রায় দুই বছর হয়ে গেল আকিদের সাথে দেখা হয় না। মাঝে মাঝে উড়া উড়া খবর পাই আকিদ প্রেম করছে। শুনে অবাক হই। কিভাবে সম্ভব? যেই ছেলে মেয়েদের সাথে কথা বলে না সে কিভাবে প্রেম করে? খবর শুনে বিশ্বাস হতে চায় না। ছেলেটা ঢাকায় হলে থাকে। একদিন কি মনে করে যেন একটা ফোন করলাম। কত দিন পরে প্রিয় এই বন্ধুটার সাথে কথা মনে করতে পারছি না। অনেকক্ষণ কথা হল। কত স্মৃতি, কত ডানপিটেপনা। সেই শৈশব, সেই হারিয়ে ফেলা দিনগুলো! আহা! কি দিনগুলোই না ছিল। কতবছরই না আমাদের আবার একসাথে দেখা হয় না। তো আকিদকে বলে ফেললাম, চল দোস্ত একটা রিইউনিয়ন করে ফেলি। সব ফ্রেন্ডরা মিলে একসাথে দেখা, আড্ডা- গান। কত কিছুই না হবে।

ঠিক বহু বছর পর আকিদের সাথে দেখা। আরও শুকিয়ে গেছে ছেলেটা। এমনিতেই প্রচন্ড হ্যাংলা। ঠোঁট কাল হয়ে গেছে। বুঝাই যায় প্রচুর সিগারেট খায়। আগের মত সেই প্রচন্ড বোকা বোকা ভাবটি আর নেই। এক কাপ চায়ের সাথে সে পর পর তিনটা লিফ ধরিয়ে ফেলল! আমরা সবাই অবাক হয়ে ওকে দেখি। গল্প জমে, সময় কাটে দ্রুত। কিন্তু সেই আগের মতন সুরটি নেই। কোথায় যেন সব সুর হারিয়ে গেছে। তারপরও বহুদিন পর সব পুরোন বন্ধুদের আড্ডা। খুব অল্প সময়টুকু কেটে যায় পাখির ডানায় ভেসে!
তারপর আমাদের দেখা নেই। একদিন আকিদের আব্বুর সাথে একটু কাজ ছিল। ভার্সিটি প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। একটা ছবি এটাস্টেড করাতে হবে। তো হুট করেই ওর বাসায় চলে গেলাম এবং খুব স্বাভাবিক ভাবেই আকিদকে পেলাম না। তো কাজ শেষ করে হঠাত করে আকিদের কথা জিজ্ঞাসা করলাম। আঙ্কেল খুব গম্ভীর ভাবে বললেন, ও কেমন যেন হয়ে গেছে। বাসায় আসে না একদম। আমি একটু অবাক হলাম। যেই ছেলেটা এক সময় বাসা থেকে ক্লাস করত বহুটা পথ পেরিয়ে সে নাকি আজ বাসায়ই আসে না! খুব ছোটবেলার ফ্রেন্ড বলে বহুদিন পরে ওর রুমে ঢুকলাম। ঠিক আগের মতই রুমটি আছে, কোথাও কোন চেঞ্জ হয় নি। তবে বহুদিন ব্যবহার হয় না এমন। সেই রুম যেখানে একসময় বহুবার আসা হত। সেই গল্পের বইয়ের তাক যেখানে শত শত গল্পের বই রাখা। ছেলেটা আস্ত বইয়ের পাগল ছিল। হঠাত করে তেতুল বনে জ্যোৎস্না বইটা পড়তে মন চাইল। আকিদের নাকি সবচেয়ে প্রিয় বই। তো বইয়ের মাঝে একটা কাগজ দেখলাম। সাধারণত এইসব ছেলেমানুষী কাজ করা হয় না। তাও খুলে ফেললাম কি মনে করে কাগজটা। একটা চিঠির মতন। পড়া শুরু করে দিলাম...

প্রিয় অনামিকা,
খুব জানতে ইচ্ছে করে তুমি কেমন আছ। কিন্তু জানার কোন উপায় নেই। হা হা। আমার মনে হয় ভালই আছ। তোমার সাথে পরিচয়ের ঘটনা কতই না অদ্ভুত ছিল। মনে আছে একসময় আমি গল্প লিখতাম আর আমার ছাইপাশ গল্প পড়ে আমার সাথে তোমার পরিচয় হয়েছিল। সে গল্প লিখার কারণ আরও অদ্ভুত! তখন ইউনিতে ভর্তি হয়েছি এক রাশ হতাশা নিয়ে। ইন্টার পরীক্ষা থেকেই মনে মনে পণ করেছিলাম বুয়েটেই পড়ব। যেভাবেই হোক পড়তেই হবে। সব কিছু ঠিকঠাক মত চলছিল কিন্তু ঈশ্বর চাননি আমার এই ইচ্ছা পূর্ণ হোক! যখন ভর্তির জন্য কোচিং করা শুরু করেছিলাম তখন দেখি সবাই আমার চেয়ে অনেক বেশী পড়া পারে! শুরু করলাম ভয়ঙ্কর পড়ালেখা। কোচিং এ পরীক্ষার রেসাল্ট ধীরে ধীরে ভাল হতে লাগল। এক সময় মনে হল আমি বুয়েটে চান্স পাবই। কিন্তু ঈশ্বর পাশা খেলেন মাঝে মাঝে! পরীক্ষার ঠিক এক সপ্তাহ আগে আসল প্রচন্ড জ্বর! হা হা। এক্সামের দিন মাথা পুরোই ফাঁকা! কিছুই মনে নাই! আর খুব স্বাভাবিক ভাবেই বুয়েটে টিকলাম না। তারপর শুরু হল হতাশার দিনগুলো! এই হতাশার দিনগুলোতে মনে হল আমি কারও প্রেমে পড়ে গেছি। শুধু প্রেম না একদম উথাল-পাথাল প্রেম। প্রতিটা সময় তার কথাই ভাবতাম। প্রতিটা ক্লাসে তার দিকেই তাকিয়ে থাকতাম। তার ঘনকালো চুলে কতবারই না হারিয়েছি। তার প্রিয় রঙ দিয়ে নিজের জগত সাজানোর চেষ্টা করেছি। যখনই তার কথা মনে পড়ত তখনই গল্প লিখতাম। যদিও জানতাম সে আমাকে পছন্দ করবে না। কেনই বা করবে। আমার মতন নিতান্ত তুচ্ছ, ইমম্যাচিউরড, একটা আনস্মার্ট ছেলেকে পছন্দ করার কোন কারণ তো নেই। তারপরও মনে ক্ষীণ একটা আশা ছিল যদি পরে কিছু হয়ে যায়। সেই আশায় রঙ বোনা শুরু করলাম। যদি কখনও তার উপযুক্ত হতে পারি, যদি হয়ত কোনদিন আমাকে তার ভাল লাগে!
সময় গড়াতে লাগল। একটা সময় পরীক্ষার রেসাল্ট খারাপ হয়ে গেল। একদম সেমিস্টার ড্রপ! বাসায় সব কিছু লুকিয়ে রেখে কোনরকমে হলে এসে আশ্রয় নিলাম। যখন মনে হল তাকে আর দেখতে পাব না ক্লাসে, কিছু না ভেবেই হুটহাট করে সব বলে ফেললাম। এবং যথারীতি সে মানাও করে দিল। তারপর মান অভিমানের পালা! অনেকবার বুঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হওয়া। আস্তে আস্তে তার থেকে দূরে সরে আসার চেষ্টা করা শুরু করলাম। যাকে জীবনের চেয়ে বেশী ভালবাসতাম সে আমাকে এভাবে ফিরিয়ে দিল? ফিরিয়ে দেওয়াটাই হয়ত স্বাভাবিক কিন্তু কেন যেন মেনে নিতে পারি নি। তাই বারবার ছুটে গেছি তার কাছে। আর বারবারই ফিরে পেলাম সমান অপমান!!
দিন কাটতে লাগল। লেখালেখি বিষয়টাকে কেন যেন ঘৃণা লাগা শুরু হল। একদিন হঠাত করেই ফেসবুকে তোমার ম্যাসেজ! লেখা পড়ে অনেকেই আগে ম্যাসেজ বা ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাতো। কিন্তু তেমন ভালো করে কারও সাথে কথাও বলা হত না। কিন্তু আমি যাকে জীবনের চেয়ে বেশি ভালবেসেছিলাম তুমি ছিলে অবিকল তার মত। সমান উচ্ছল, সমান রাগী, তারমতই বইপাগুলে, ক্লাসের প্রথমদিকের ছাত্রী। একদম সবকিছুই এক! কিভাবে এটা সম্ভব আমি জানি না। যখন তোমার কষ্টগুলো শুনলাম তখন মনে হল তোমার যেন আর কোন কষ্ট থাকে না। আস্তে আস্তে তোমাকে আকড়ে ধরে ফেললাম। হয়ত নিজের বেঁচে থাকার জন্য। একটা সময় এমন হয়ে গেল আমরা দুজন দুজনার।
সময় কাটতে লাগল মেঘের ডানায় ভেসে ভেসে। সারাদিনের বোরিং ক্লাস আর এসাইনমেন্ট হয়ে গেল আনন্দময়! ক্লাসের মাঝে তোমার একটা টেক্সট পেলেই মনটা ভাল হয়ে যেত। পুরোটা ক্লাস হয়ে যেত আনন্দময়। ক্লাস শেষ করে টিউশনির ঝামেলা। রাত দশটা পর্যন্ত টিউশনির ঝামেলাকে আর ঝামেলা লাগে নি। টিউশনির ফাঁকে ফাঁকে ম্যাসেজ বিনিময়! তারপর রুমে এসে ঘন্টার পর ঘন্টা মোবাইল ফোনে একসাথে আকাশের তারা গোণা। জীবন বোধহয় এরচেয়ে আনন্দের হয় না। তুমি থাকতে ঢাকা থেকে অনেক দূরে। তাই দেখা হত খুব কম। মোবাইলেই কথা বলা। অনামিকা, মনে আছে আমাদের প্রথম দেখা হওয়ার দিনটা? আমার নীল রঙ প্রিয় বলে তুমি আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য নীলে সেজেছিলে। তারপর থেকে যতবারই দেখা হয়েছে ততবারই তুমি নীলে সেজেছিলে। কতই না সুন্দর ছিল দিনগুলো। প্রথম কোন মেয়ের হাতে হাত রাখা, প্রথম স্পর্শ সবকিছুই অদ্ভুত। সারাদিন ঘন্টার পর ঘন্টা রিকশায় ঘুড়া। আচ্ছা, অনামিকা তুমি কি ভুলে গেছ সব? আমি যখন তোমার জন্য কিছু কিনে নিয়ে যেতাম তখন আমাকে ইচ্ছা মত বকা দিতে টাকা নষ্ট করার জন্য। অনামিকা, আমাদের কতই না ঝগড়া হয়েছে খুব ছোট ছোট বিষয়ে! সারাদিনের মধ্যে একশবার ঝগড়া করে ঠিক মধ্যরাতে মিল হয়ে যেত। আমি ঘুমিয়ে পড়তাম, ফোনে বহুবার হ্যালো বলার পর তুমি ঘুমাতে যেতে। অনামিকা, তুমি কি সব ভুলে গেছ?? জান, আমার না এখনো বিশ্বাস হয় না কেউ আমাকে এতটা ভালবেসেছিল। সারাটা দিন ধরে অপেক্ষা করে কখন আমার ক্লাস শেষ হবে, কখন টিউশনি শেষ করে রুমে আসব। কখন আমার সাথে ফোনে কথা হবে। ঠিক তেমনি সারাদিনের ক্লান্তিকে একটুও ক্লান্তি মনে হয় নি আমার, কারণ আমি জানতাম একজনের কন্ঠস্বর শুনলে সারাদিনের সব ক্লান্তি মুহূর্তের মধ্যে উড়ে যাবে। মাঝে মাঝে চিন্তা করি, যে ছেলেটা কারও সাথে কথা পর্যন্ত বলত না সে কিভাবে একজনের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে একটা রাতকে সকাল বানিয়ে ফেলে! রিলেশন ভাঙ্গার ঠিক আগের দিন পর্যন্ত তোমার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা হয়েছিল। অথচ আমাদের রিলেশন ভাঙ্গল কিনা পহেলা বৈশাখের রাতে। এটাও সম্ভব! পহেলা বৈশাখে তোমার সাথে দেখা না করলে কি হত বল তো? কেন এত জোড় করলে তুমি দেখা করার জন্য? তুমি অপরূপ রূপে সাজবা সে সাজ দেখার জন্য এত কষ্ট করে টেনে নিয়ে আসলে এতদূরে কিসের জন্য বল তো? সেদিন তোমাকে তো কত ছেলেই সুন্দর লাগছে বলবে, আমাকে এটা বলার জন্য ঢাকা থেকে আসতে হবে? তুমি তো জানতেই আমার বাসায় সেমিস্টার ড্রপের কথা শুনে কত ঝামেলা। প্রায় এক বছর পর সত্যটা জেনে আব্বু আম্মু কতটা কষ্ট পেয়েছে তুমি দেখলেই বুঝতে! তারউপর টিউশনি বাদ দিয়ে ঢাকার বাইরে যাওয়া একদম কষ্টকর সেই সময় কারণ তখন স্টুডেন্টদের পরীক্ষা চলছে! আর আমার নিজের ক্লাসের ঝামেলা না হয় বাদই দিলাম। কত করে বললাম এই পহেলা বৈশাখে না বরং তার একটু পর আসি। তুমি তোমার জিদে অবিচল! তাই সব কিছু বাদ দিয়ে তোমার শহরে ছুটে এলাম। পহেলা বৈশাখের আগের দিন কত্ত ঘুড়াঘুড়ি কত্ত খুনসুটি। স্বর্গ ধরায় নেমে এসেছিল। আমি বললাম আমি সন্ধ্যায় চলে যাই কারণ তুমি বলেছিলে পরের দিনের তোমার সব প্ল্যান তোমার বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে। এদিকে আমি করব পরের দিন? তারউপর আমি যেই হলে ছিলাম সেখানে আমার কলেজ ফ্রেন্ডরা ইচ্ছামত পহেলা বৈশাখ আর ডেটিং নিয়ে মজা করবে। ঢাকা থেকে প্রেম করার জন্য এসেছি বলেই তো পুরা মজা নিচ্ছিল আর সেদিন যদি রুমের মধ্যে একা একা বসে থাকি বা ওদের সাথেই সময় কাটাই তাহলে ব্যাপারটা কেমন হাস্যকর হয়ে যায় না? আসলাম একজনের জন্য, আর সময় কাটাচ্ছি অন্যদের সাথে। তাও আমি কিন্তু খুব স্বাভাবিক মনেই সেটা মেনে নিয়েছিলাম কারণ তুমি আমাকে থাকতে বলেছিলে। পহেলা বৈশাখে তোমার সাথে সব মিলিয়ে দেড় ঘন্টার মত দেখা। তোমার কাঁধে অনেকটা সময় মাথা রেখেছিলাম। আমি স্বর্গ দেখি নি। স্বর্গের সুখ অনুভব করেছি। তোমার হাত ধরে রিকশায় ঘুড়েছিলাম অনেকটা সময়। জন্মান্তর যদি মিথ্যা হয় তাহলে ওটাই শেষ দেখা তাই না?? বাকি সারাটা দিন রাস্তায় একা একা ঘুড়া। ফ্রেন্ডের রুমে যেতে পারছি না। কারণ গেলেই ওরা অবাক হবে। তো সেদিন সকালে ফ্রেন্ডের এক বান্ধুবীর সাথে দেখা। সে তার এক “বয়ফ্রেন্ড” নিয়ে ঘুড়তে বের হয়েছে! ঠিক সন্ধ্যায় যখন একটা টং দোকানে সিগারেট টানছিলাম সেই মেয়েটা তার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে রিকশাযোগে ফেরার সময় বলছিল, ওই যে আমাদের দেবদাস। বলেই ওরা হাসতে লাগল। খুব খারাপ লাগছিল তখন। তাও তো তোমাকে কিছু বলি নি। যখন রাতে ঘুমানোর আগে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিলাম, কারও কাছে কিছু এক্সপেক্ট করা উচিত না ঠিক তখনি তুমি ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করলা তোমার কাছে কি এক্সপেক্ট করি? হা হা। তখন আর মাথা ঠিক রাখতে পারি নি। হয়ত সব কিছু ফেলে এসেছি বলে রাজ্যের সব এক্সপেক্টেশন তোমার উপর ছিল। এ প্রসঙ্গটা সেদিন না তুললে পারতা না অনামিকা? রাগ করে কত কষ্টই না তোমাকে সে রাতে দিয়েছি। আমার মনে হয় তুমি এ প্রসঙ্গ না তুললেই পারতে। কতই না চেয়েছি সব ঠিক হয়ে যাক। কিছুই ঠিক হল না। সে রাতে আমি নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারি নি। তোমাকে কষ্ট দিয়েছি অনেক। হয়ত সারা দিনের সব অভিমান একটা ফোন কলেই ঝেড়ে দিলাম! তারপর আর কথা নেই... তোমার সাথে দেখা করার জন্য, সব ঠিক করার জন্য কত শতবারই না চেষ্টা করলাম। কিছুই ঠিক হল না। একটা বারও ফোন ধরলে না। তারপর ধীরে ধীরে তোমার উপর জমা সমস্ত অভিমান নিজের উপর ঘৃণায় রূপান্তরিত হল।
তারপর থেকে কেবলই মনে হয় আমি বোধহয় তোমার সাথে প্রতারণা করেছি। যে মানুষটা আমাকে এতটা ভালবেসেছে তাকে কেবলই কষ্ট দিয়েছি। এতটা কষ্ট দিয়েছি মানুষটা শেষ কথাটা আমাকে বলেছে, “তুমি আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছ, তুমি জীবনে সুখী হবা না।” বিশ্বাস কর অনামিকা কথাটা আমার কানে প্রতিটা সেকেন্ডে বাজে। যখনই কথা বাজতে থাকে তখনি মদের বোতল খুলি। কেরুর হাফ লিটারের একটা বোতল খালি করে ফেলি। তাও কিছু ভুলতে পারি না। নিজেকে কেবলই ভণ্ড একটা মানুষ বলে মনে হয়। আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম তোমাকে আকড়ে ধরে, আর আমাকে এখন বাঁচতে হচ্ছে মদের বোতলকে সঙ্গে নিয়ে। মাসের শুরুর দিকে মদ খাই শেষে আর টাকা থাকে না। তখন খেতে হয় গাঁজা! হায়রে কপাল। নিজেকে হারিয়ে খুঁজে ফিরি চারদিকে। ভয়ঙ্কর হতাশা ছাড়া আর কিচ্ছু পাই না। ক্লাসে যেতে ভাল লাগে না। ক্রমাগত যাই না বলে ভার্সিটি থেকে বাসায় ফোন দেয়।! আব্বু-আম্মুর কথা শুনে প্রচন্ড খারাপ লাগে। বেচারারা কোন দোষ করে নি। তাও তারা আমার জন্য প্রচন্ড কষ্ট পাচ্ছে। বাসায় যাই না কয় মাস নিজেও জানি না! খুব খারাপ লাগে খুব। কিন্তু সব কেমন যেন উলটা পালটা। মাঝে মাঝে হু হু করে ক্লাস নাইন টেনের কথা। সে সময় ইংরেজি ১ম পত্র পরীক্ষা হত তিন ঘন্টায়। এক রি এ্যারেঞ্জ ছাড়া সব কিছু আমি পারতাম। যেখান থেকেই যত কঠিন প্রশ্নই দিক না কেন ৩৫-৪০ মিনিটে পরীক্ষা শেষ! শুধু রি এ্যারেঞ্জ মিলত না। সোয়া দুই ঘন্টা ধরে চেষ্টা করে আনসিন রি এ্যারেঞ্জ মিলাতে পারতাম না। তখন প্রচন্ড মন খারাপ হত। আড়ালে কান্নাও করেছি। এখন হাসি পায়! জীবনের রি এ্যারেঞ্জই মিলাতে পারি নি আর পরীক্ষা কোন ছাড়!
অনামিকা, একটা সময় কত আনন্দ নিয়েই না রাত কাটত। সেই বারান্দা যেখানে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতাম। আজ তুমি নেই। তাই বলে কি সময় থেমে আছে? জীবন কি কখনও থামে? তুমি চলে যাওয়ার পরও জীবন এক সেকেন্ডের জন্য থামে নি। সেই বারান্দা অবিকল আগের মত আছে। শুধু হাতে আর কোন মোবাইল থাকে না, পড়ে থাকে মদের বোতল। জীবন এমন কেন বল তো? আমি জীবনে কি পাপ করেছি যে ঈশ্বর আমাকে পয়েন্টে পয়েন্টে সব শোধ করে দিচ্ছেন? বাসায় যাই না কতদিন নিজেও জানি না। একদিন জীবনের সবচেয়ে বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে সম্পর্ক ছেদ করেছি সে সিগারেট খেত আর এখন গাঁজা বানানোর সময় সবাই আমাকে ডাক দেয়! এও কি সম্ভব? অনামিকা, তুমি কেন আমাকে এত ভালবেসেছিলে? কত ভালো ভালো হ্যান্ডসাম ছেলে তোমাকে পছন্দ করত। এত দূরের একটা নিতান্ত তুচ্ছ, ইমম্যাচিউড়ড, আনস্মার্ট ছেলেকে কেন ভালবেসেছিলা অনামিকা? কেন??
মাঝে মাঝে হু হু করে মনে পড়ে যায় তোমাকে নিয়ে কাটানো স্মৃতিগুলোর কথা। তখন খুব কষ্ট হয়। ফোনে ব্যালেন্স ভরা হয় না। কোন বান্ধুবীর সাথে ঘুড়তে বোরিং লাগে। কেউ ফোন দিলে বারবার মনে হয় কথা শেষ হয় না কেন! মাঝ রাতে তোমার কথা খুব খুব মনে পড়লে বাইরে বেরিয়ে পড়ি। মাঝ রাতে রিকশা দিয়ে একা একা ঘুড়ি। খারাপ লাগে না! একটা সময় নামাজ পড়তাম, রোজা রাখতাম। বাবা মা আর তোমাকে নিয়ে সুখের একটা সংসারের স্বপ্ন দেখতাম। সব ভেঙ্গে গেছে রে অণু! শেষ কবে নামাজ পড়েছি মনেও করতে পারছি না! এমনকি জুম্মার নামাজও না!! যতদূর মনে পড়ে পহেলা বৈশাখের পর কোনদিন মসজিদেই যাই নি!

অনামিকা, তুমি আমাকে পারফিউম গিফট করেছিলা মনে আছে? পারফিউমটার গায়ের গন্ধ ঠিক তোমার গায়ের গন্ধের মতন। যখন প্রচন্ড মন খারাপ হয় তখন পারফিউমটাকে একটা চুমু খেয়ে আবার রেখে দিই। জীবনে বাবা মা ছাড়া কেউ বোধ হয় এই প্রথম কিছু গিফট করেছিল। প্রথম গিফট, তাও তোমার মতন স্পেশাল একটা মানুষের কাছে। গিফটের মাহাত্য অন্যরকম এটাই স্বাভাবিক। সে পারফিউমটার সাথে একটা কাগজে গুটি গুটি অক্ষরে লিখে দিয়েছিলা, “আমার জীবনে আসার জন্য ধন্যবাদ!” কতবার ভাবি সব ফেলে দিব, পারফিউম কাগজ সব। পারি না। কাগজটা এখনও রয়ে গেছে মানিব্যাগে! অনামিকা, মনে আছে যখন বলতে আমাদের নিয়ে একটা গল্প লিখতে আমি বারবার মানা করতাম। কিন্তু যেদিন তুমি আমাকে পারফিউমটা দিলে, আমার মন অজান্তেই একটা গল্প লিখে ফেলেছিল, পারমিউম-এ স্টোরি অব লাভ। গল্পটা পরিবর্তন হয়ে গেছে অনামিকা! এখন আমার খুব করে বলতে ইচ্ছে হয়, আমায় একটা গল্প দিবে অনামিকা? একটা গল্প?
একটা সময় তোমার জন্য প্রচন্ড মন খারাপ হয়। তখন মনে হয় আমার মত এত তুচ্ছ একটা মানুষ তোমার বয়ফ্রেন্ড কিভাবে হবে? তোমার মতন একটা মেয়ের সাথে আমাকে কখনও মানায় নি। তোমার বান্ধুবীরাও আমাকে নিয়ে হাসত তাই না? যাই হোক, তোমার বন্ধু-বান্ধুবী আর বড় ভাইরা খুব খুশী তোমার সাথে কোন আনস্মার্ট ছেলের রিলেশন নাই! সবার খুশী দেখে তোমারও খুশী হয়ে যাওয়া উচিত।
শোন আমার নীল পরী, তুমি এখন যাকে ভালবাস তার সাথেই তোমার বিয়ে হবে। আমার জীবনের সবকিছুর বিনিময়ে ঈশ্বরের কাছে চাই তুমি সুখী হও। ভুলেও অমাবস্যা তোমাদের গ্রাস করবে না। দুঃখ কি জিনিস এই মানুষ তোমায় বুঝতে দিবে না। আর ভুলেও যদি কোনদিন আমার কথা মনে পড়ে যায়, তাহলে মনে রেখ আমার কোন মন খারাপ নেই। শুধু একটাই শেষ চাওয়া, যদি পার আমাকে মন থেকে মাফ করে দিও। আমি আসলেই তোমার ভালবাসা পাওয়ার যোগ্য না। একটা সময় আমি বলতাম, আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি। এখন কেন যেন মনে হয় সবই ভুল! তোমার ভালবাসা আমার চেয়ে অনেক অনেক বেশি ছিল। অনেক বেশী। তোমার কাছে সত্যি আর কিছু চাওয়ার নেই। শুধু যদি কোনদিন পার, পারলে মাফ করে দিও। প্লীজ...
একটা সময় ভাবতাম টাকাই সব। তাই ক্লাস করার পর বাকি সময়টুকু দিয়ে টিউশনি করাতাম। এখন হাসি পায়। রক্ত বেচা বিশ পচিশ হাজার টাকা আসে! সব চলে যায় নেশায়! হা হা। একদিন পড়ালেখা শেষ করতে পারলে অনেক টাকা আসবে! ওগুলোও তো চলে যাবে নেশাতেই! ভালবাসা ছাড়া সব কিছু টাকা দিয়ে কেনা যায় অনামিকা, সব!
ভেব না আমি কোন দিন সুইসাইড করব। আমার কেউ না থাকতে পারে, আমি মরব না অনামিকা। আমার অনেক টাকা হবে অনামিকা। সেদিন আমি আমার বাসা ভরিয়ে দিব মদের বোতলে। টাকার অভাবে এখন সস্তা কেরু খাই। তখন বিদেশি মদের বোতলে আমি আমার বাসা ভরিয়ে দেব। হাত বাড়ালে তখন খাব ব্ল্যাক লেভেল, ব্ল্যাক এন্ড হোয়াট, ভ্যালেন্টাইন বা ভ্যাট সিক্সটি নাইন! আমি আমার কষ্টের কথা কাউকে বলব না। কাউকে না। শুধু শেষ কষ্টটা মিশিয়ে দিয়ে যাব মদের বোতলে বোতলে।
অনামিকা, আমি কেমন আছি বুঝতে পারছি না। তুমি অনেক ভাল থেক নীল পরী। অনেক ভাল।

ইতি,
-কেউ না


এক নিমিষে চিঠি পড়ে ফেললাম। হঠাত চোখ ভিজে উঠল মনে হল। পোকা ঢুকেছে মনে হয়। এইসব লুতুপুতু প্রেম কাহিনী পড়ে চোখে পানি আসবে না। চিঠিটা বইয়ে গুঁজে দিয়ে মনের অজান্তেই বলে ওঠলাম, আকিদ আর অনামিকা তোরা ভাল থাকিস তোদের যার যার রাজ্যে!
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগটা তো ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে গেলো :(

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৫৭



আমি আমার ব্লগিং শুরু করি প্রথম আলো ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে। ব্লগটির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ প্রথম আলো ব্লগ আমায় লেখালেখিতে মনোযোগী হতে শিখিয়েছে । সে এক যুগ আগের কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

লুঙ্গিসুট

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



ছোটবেলায় হরেক রঙের খেলা খেলেছি। লাটিম,চেঙ্গু পান্টি, ঘুড়ি,মার্বেল,আরো কত কি। আমার মতো আপনারাও খেলেছেন এগুলো।রোদ ঝড় বৃষ্টি কোনো বাধাই মানতাম না। আগে খেলা তারপর সব কিছু।
ছোটবেলায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

লিখেছেন নতুন নকিব, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:২৫

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

ছবি কৃতজ্ঞতা: অন্তর্জাল।

একবার শাইখুল হাদিস মুফতি তাকি উসমানী দামাত বারাকাতুহুম সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হল, জীবনের সারকথা কী? উত্তরে তিনি এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

=মৃত্যু কাছে, অথবা দূরেও নয়=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



©কাজী ফাতেমা ছবি
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলি, আমারও সময় হবে যাবার
কি করে চলে যায় মানুষ হুটহাট, না বলে কয়ে,
মৃত্যু কী খুব কাছে নয়, অথবা খুব দূরে!
দূরে তবু ধরে নেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×