গ্র্যাজুয়েশনের পর ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং করে সেখানেই চাকুরি। বেসরকারি চাকুরি। এন্ট্রি লেভেল জবে বস বিরাট ফ্যাক্টর। ভালো হলে বাঁচোয়া, নইলে জান হারাম। আর পছন্দসই জব পাওয়াও দায়। বসদের পছন্দমতন, নিজের কোন ইচ্ছা খাঁটাবার সুযোগও পেলাম না। একসাথে ৬ ফ্রেন্ড ছিলাম, ৬ জনের কেউই পছন্দসই সেকশন পাই নি আমরা। যে যেটা চেয়েছি দিয়েছে ঠিক তার উল্টা! সবসময় ইচ্ছা ছিলো- জুতার ডিজাইনার হবো, কারণ পড়াশুনা পাদুকা প্রকৌশলে। কিন্তু বিধি বাম- দিয়ে দিল কামলার কাজ, তথা প্রোডাকশন প্ল্যানিংয়ে। একবার ভেবেছিলাম এ জব করবো না, কিন্তু তারপরও জবটা নিলাম। কারণ একে তো প্রথম জব, তার উপর সবার জব হয়ে যাবে আমি একা বসে থাকবো, তারচেয়ে দেখি কি আছে এই জবে। অনেকে বলল প্ল্যানিংয়ের জব ভালো।
জব শুরু করলাম সোৎসাহে আমরা ৬ জন। সকাল ৮ টায় অফিসে যাই, কেউ কেউ বিকাল ৫ টা বাজার সাথে সাথে কেউ কেউ বের হলেও আমার আর তেমন একটা বিকেল দেখার সৌভাগ্য হয় না খুব একটা। হাতে কোন কাজও নেই, শুধু শুধু ফ্লোরে ঘুরে ঘুরে টাইম পাস করা ছাড়া আর কিচ্ছু হয় না। মাঝে মাঝে পারিবারিক কাজে ৫ টায় বের হতে চাইলে বসকে বলি," স্যার আজকে একটু যেতে হবে, কাজ আছে।" বসের উত্তর, "আমি অফিসে আছি আর তুমি চলে যেতে চাও!" ২/১ দিন বের হতে পারি, ২/১ দিন বের হওয়া হয় না। তার উপর আমি কোন কাজে ভুল করলে তো ঝাড়ি খাই-ই, বস ভুল করলেও আমি ঝাড়ি খাই! অন্য কোন ম্যানেজারের সামনে সোজা অপমান, "তানভির, তোমাকে না বললাম ঐভাবে কাজটা করতে! তুমি এভাবে করছ কেন?"; আমি মনে মনে ভাবি, "যাহ শালা এইটা কি কয় বসে!" কিন্তু মুখ ফুঁটে কিছু বলা যায় না, কারন 'Boss's always right'। এভাবে সকাল ৮টা টু রাত ৮টা ডিউটি চলে। সূর্যের মুখ আর খুব একটা দেখা হয় না। বসের ঝাড়ি চলে। অবস্থা এমন হয় যে, বাসায় আসার পর কখনও ফোন বাজলে মনে হয়, এই বুঝি বসে ফোন দিছে, বলবে আমি কি করি নাই, বা কোন কাজ করে নিয়ে যেতে হবে বাসায় বসেই।
এভাবে দিন যায়, সপ্তাহ যায়, যায় মাস। আমি ধীরে ধীরে গুটিয়ে যাই নিজের মধ্যে। একে তো নিজের পছন্দসই কাজ না, তার উপর বসের মানসিক নির্যাতন। আমার ভোরে ঘুম থেকে উঠে ছুটতে হয় অফিসপানে। সারাদিন বসে বসে নিজের অবস্থা অবলোকন করি আর দেখি একই সাথের বন্ধুরা বস ভিন্ন হওয়ায় আর সেকশন ভিন্ন হওয়ায় নানবিধ সুযোগ-সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। নিজেকে আর মানুষ বলে মনে হয় না। একে তো বেসরকারি অনিরাপদ চাকুরি, তার উপর পকেটও ভরে না। কাজে মনোযোগ ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলি। এভাবে প্রায় ১০ মাস পর নিজেকে আবার মুক্ত করি- অপছন্দের জবের ইস্তফা দিয়ে। আমার পুরোনো বস এবার বেশ ভালো আমার সাথে!
নিজেকে আবার পুরোনো ব্যস্ততাহীন জীবনে মানিয়ে নিতে মাস খানেক সময় নেই। কিন্তু এর মধ্যেই আসে হালের ক্রেজ বিসিএস ৩৬ তম প্রিলিমিনারি পরীক্ষা। ফর্ম ফিল আপ করেছিলাম শুধু দেখার জন্য যে, এটা কি? ভার্সিটি লাইফের পুরোটা বছর আমার ডায়ালগ ছিল, ইঞ্জিনয়ারিং পড়ে আমি কেন জেনারেল ক্যাডার হব? কিন্ত ১০ মাসের বেসরকারি জব করার পর আজ আমার সে চিন্তা-ভাবনার আমূল পরিবর্তন। ৩৬ এ হবে না জেনেই পরীক্ষা দিলাম- হয়ওনি।
এর মধ্যে আবার ভাবলাম যে, বসে আছি আর যেহেতু মাস্টার্সও করা হয় নি, জব করতে যেয়ে। এম.বি.এ তে চান্স পেয়ে ভর্তি হয়েই গেলাম। আবার ছাত্রত্ব বরণ করলাম। প্রায় ৮ মাস পর ৩৭ তম বিসিএস প্রিলিমানরি। এবার আমার কিছু পড়া আছে। প্রিলি টিকতেই হবে, সরকারি একটা জবের কাছাকাছি যেতেই হবে। জব খুব দরকার, আর কতকাল বাপের হোটেলে খাব? কিন্তু বেসরকারি চাকুরির উপর প্রাক্তন বসের কারণে যে বিতৃষ্ণা তাতে আমি শেষ পর্যন্ত লড়তে রাজি।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষা মনো:পুত হয় নি, তাই ৫০-৫০ আশাবাদী ছিলাম। সবাইকে সত্যিটাই বলেছি পরীক্ষা খুব ভাল হয় নি, জঘন্যই দিয়েছি।অনেক বাঘা বাঘা প্লেয়ারদের কথা শুনে মনে হচ্ছিল বিসিএস লিখিত বোধহয় দূরান্তের ব্যপার, আমি আশা করা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম।বাসায় ফিরে প্রশ্নপত্র আর মিলাই নি।
গত ১ নভেম্বর রেজাল্টও আসলো। এক বন্ধু ফোন করে বলল, আমি নাকি বিসিএস লিখিত পরীক্ষার জন্য মনোনীত হয়েছি। বাসায় ফিরে অ্যাডমিট কার্ড মিলিয়ে দেখলাম যে, এসেছে। আল্লাহর অশেষ রহমত বলতেই হচ্ছে। এরপর আল্লাহর মহানুভবতায় লিখিত পাড় পেতে চাই। তারপর শেষ বাঁধাটুকুও পার হয়ে দেশের চাকর হতে চাই।
যতটা না দেশের জন্য, তার চেয়ে নিজের জন্যই একটা জব দরকার। বেঁচে থাকতে অর্থ সংস্থান চাই। মিডল-ক্লাস ফ্যামিলির ছেলে হওয়ায় চাকুরি ব্যতীত উপায় নেই। বর্তমান বিবেচনায় একটা সরকারি চাকুরি অনেকটা সোনার হরিন। সেই সোনার হরিণের পেছন ছুটছি। পা পিছলে পড়লে সে হরিণ হারিয়ে যাবে গহীন অরণ্যে। তাই নিষানা ঠিক করে ছুড়তে হবে তীর। আল্লাহ যদি ভাগ্যে রাখেন তবে সে হরিণ মারা পড়বে, একটি তীরেই। নয়তো বারবার তীর ছুড়েও কাজ হবে না। আল্লাহ যেন আমাকে এবারেই লক্ষ্যভেদ করার তৌফিক দেন। সকলের কাছে শুভ কামনা প্রার্থী।
বাকিটা আমার শ্রম ও সাধনা স্বাপেক্ষ।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:৫৮