‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকে মেরুদণ্ড সোজা-সটান রেখে, বের হয় কুজো হয়ে। ঢোকা আর বের হওয়ার মাঝখানের পাঁচ বছর সময়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যা সাত থেকে ১০ বছর পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয়, নানারকম অত্যাচার, নির্যাতন আর মগজধোলাই খেতে খেতে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরের এই সবুজ শ্যামল পাহাড়ঘেরা ক্যাম্পাসটি যে কত বড় কারাগার, সারাদেশের মানুষ তা জানতেও পারে না। শারীরিক নির্যাতন এখানে কদাচিত্ ঘটে, এদিক থেকে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এর পার্থক্য তেমন নেই। কিন্তু ৫-৭ বছরের দীর্ঘমেয়াদি মানসিক ও আর্থিক নির্যাতন দুর্বিষহ।
ভর্তি হওয়ার প্রথম বছর এখানকার ছাত্রছাত্রীরা যে শিক্ষাটা পায় তা হলো ‘মেনে নাও’। আর সে জন্যই বছরের পর বছর যে নানামুখী ও বৈচিত্র্যময় ঢংয়ের শোষণ আর নির্যাতন প্রবর্তন করা হয়, কেউ তার বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দটি করে না। ডান-বাম, সামনে-পেছনে কিংবা উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম বিভিন্ন ভাবধারার রাজনৈতিক দলের ক্যাডার ও নন-ক্যাডার বাহিনী, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, পরিবহন মালিক সমিতি—এই তিন পক্ষের কাছে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা জিম্মি। তাদের কাছে ছাত্রছাত্রীরা হলো সোনার ডিম পাড়া হাঁস। নানা রকম কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নিতে তারা সিদ্ধহস্ত। অর্থনৈতিক শোষণ, অত্যাচার-নির্যাতনে ছাত্রছাত্রীরা অতিষ্ঠ। মেনে নেওয়ায় অভ্যস্ত এ ছাত্রছাত্রীরা সবকিছুই মেনে নেয়, নীরবে সহ্য করে। আর আশায় থাকে কবে একটা সার্টিফিকেট নিয়ে এখান থেকে বের হবে। আর সে কারণেই এবার ভ্যাকেশনের পর ক্যাম্পাসে গিয়ে সবাই দেখে শহর ফেরা তরীগুলো (চবি-শহর চলাচলকারী মিনিবাস) ক্যাম্পাস থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে এক নং গেটে সবাইকেই নামিয়ে দিচ্ছে, কেউ কিছু বলেনি। শোনা যায়, স্টেশনে থাকলে ছাত্রলীগ নাকি গাড়ি ভাংচুর করে, তরী মালিকরা স্টেশনে গাড়ি রাখা নিরাপদ মনে করেন না। তাই ১নং গেট পর্যন্তই তরীগুলোর যাতায়াত। কিন্তু সবাই বুঝতে পারে ১ নং গেট থেকে স্টেশন পর্যন্ত চলাচলকারী সিএনজি ট্যাক্সি সিন্ডিকেটকে সুবিধা দিতেই তরীর এই নতুন ঘাটে নোঙর করা। চবি প্রশাসন-সিএনজি-তরী সিন্ডিকেট এই ত্রিমুখী যোগসাজশে এই কারবার! কেউ কিছু বলে না। কেউ কিছু বলেনি, যখন এই তরীগুলোকে শহীদ মিনার থেকে রেল স্টেশনে আনা হয়েছিল। তখন ছিল রিকশা মালিক সমিতি-শিবির-চবি প্রশাসন—এই তিন অংকের যোগফল। এত বড় যোগফলের বিরুদ্ধে গিয়ে কেউই ‘মাইনাস’ হয়ে যাওয়ার সাহস করেনি। ফলাফল আগে যেখানে শহরের নিউ মার্কেট থেকে ক্যাম্পাসে শহীদ মিনার পর্যন্ত আসতে একজন ছাত্রের খরচ হতো চৌদ্দ টাকা, এখন সেখানে শুধু এক নং গেট থেকে ক্যাম্পাসে ঢুকতেই লাগে ১৫ টাকা। শহর থেকে এক নং গেট পর্যন্ত ১৭ টাকা, গেট থেকে শহীদ মিনার পর্যন্ত মোট ৩২ টাকা, আসা-যাওয়া ৬৪ টাকা খরচ হয়। যাদের ফ্যাকাল্টি দূরে তাদের বেলায় এই আশি-নব্বই টাকায় গিয়ে ঠেকে। আর শাটল ট্রেনের অবস্থা যে কত খারাপ, তা লিখতে গেলেই একটি নিবন্ধ হয়ে যায়। প্রতিবছরই ট্রেনে কাটা পড়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রী মারা যাচ্ছে। কারও কোনো বিকার নেই। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার নামে সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখা হয়েছে। ক্যাম্পাসে কোনো বাক-স্বাধীনতা নেই। মেয়েদের হলে জারি করা হয়েছে মধ্যযুগীয় সান্ধ্য আইন।
কিন্তু সব কিছুর পেছনে একটি সীমানা-দেয়াল থাকে, সেই দেওয়ালে পিঠও ঠেকে যায়। এবার দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের। ৫০০ টাকার ডিসকলেজিয়েট ফি যখন এক লাফে সাত হাজার টাকার ভুতুড়ে অংক হয়ে যায়, তখন দেয়ালে পিঠ ঠেকেই যায়। সে জন্যই ইতিহাস বিভাগের ১০-১২ জন ছাত্রের উদ্যোগে নেওয়া প্রতিবাদ মিছিলটি পরের দিনই হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর বিক্ষোভ মিছিলে পরিণত হয়; দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ উগড়ে আসে।
বিক্ষোভ শব্দটার মধ্যেই ভাংচুরের গন্ধ থাকলেও প্রথম পাঁচ দিন পর্যন্ত এই আন্দোলন অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক ছিল। কেউ সহিংসতায় যায়নি। তারপরও শিক্ষক লাঞ্ছনার অভিযোগ তুলে সুজন কান্তি দেকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। অথচ প্রকৃত ঘটনা একেবারেই উল্টো। সহকারী প্রক্টর চন্দন কুমার পোদ্দারই সুজনকে চড় দেন। এমনকি যে শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ তোলা হয়েছে, সে শিক্ষক নিজেই সাংবাদিকদের কাছে এ ঘটনা অস্বীকার করেছেন! বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী একটা ধারণা প্রচলিত-শিক্ষকরা হচ্ছেন সিনিয়র স্কলার আর ছাত্ররা জুনিয়র স্কলার। কিন্তু প্রক্টরিয়াল বডির কেউই ছাত্রদের মেধা ও আত্মসম্মানবোধকে কখনোই বিন্দুমাত্র সম্মান দেখাননি। বরং শাস্তির খড়গ সর্বদাই ছাত্রদের জন্যই নির্ধারিত। এর আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী একজন ছাত্র প্রগতির পরিব্রাজক দলের (প্রপদ) সংগঠক জাহিদুর রহমান রোকনকে বহিষ্কার করেছে প্রশাসন। আন্দোলনকে থামিয়ে দিতে ভয়ভীতি দেখানোই যে এসব বহিষ্কারের উদ্দেশ্য, সবাই তা বোঝে। সুজনকে বহিষ্কারের পরও তাই আন্দোলন থামেনি। তবে সহিংসও হয়নি। ছাত্রছাত্রীরা চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে এই কয়েক দিন। কিন্তু প্রশাসন এটাকে আন্দোলনকারীদের দুর্বলতা ভেবেছে। আন্দোলনের প্রথম দিনের কর্মসূচির পর যখন সুজনকে বহিষ্কার করা হলো, দ্বিতীয় দিনের কর্মসূচি ঠিক করা হলো—উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে ছাত্র জমায়েত, স্মারকলিপি প্রদান ও উপাচার্যের বক্তব্য শোনা। কিন্তু সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত বারংবার চেষ্টা করেও উপাচার্যের দেখা পাওয়া যায়নি। তাঁর কাছে যাতে স্মারকলিপি পৌঁছাতে না পারে সে ব্যবস্থা তিনি আগেই করে রেখেছেন। উপাচার্য তার চার তলার আরাম কেদারা ছেড়ে উঠে আসেননি। এসির বাতাসে তিনি চা-বিস্কিট খেয়েছেন আর ছাত্রদের উপেক্ষা করেছেন। কোনো রকম পাত্তাই দেননি। তিনি একটি কৌশল নিয়েছিলেন। ভিসি অফিসের চারপাশে চার-পাঁচশ ছাত্রছাত্রীর খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। মাথার ওপর জ্বল-জ্বল করছে প্রখর সূর্য। আছে ট্রেন ধরার তাড়া। এ অবস্থায় ছাত্ররা ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে রণেভঙ্গ দেবে—এই ছিল তার আশা। কোনোমতে দুপুর পর্যন্ত এসব উপেক্ষা করতে পারলেই হলো, পরদিন শবেবরাতের বন্ধ, সুতরাং আন্দোলন শেষ! এই ছিল তার কৌশল। সত্যিকার অর্থে সেদিন তিনি সফলও হন। কিন্তু পরবর্তী হিসেবেই তিনি ভুল করেন। শবেবরাতের বন্ধের দিন আন্দোলন চলে মোবাইল ফোন ও ফেসবুকে। সেদিনের চবি ছাত্রদের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখলেই বোঝা যাবে, কতটা ক্ষোভ ছাত্রদের মধ্যে বিরাজ করছিল। ব্যক্তিগত প্রেম-ভালোবাসা, বন্ধুত্বের ছল-চাতুরি—এসব ছাপিয়ে সেদিন সবার স্ট্যাটাস হয়ে উঠেছিল চবি প্রশাসনের ওপর বিষোদগার এবং আন্দোলনে যোগদানের সর্বাত্মক আহ্বান।
যেহেতু উপাচার্য অফিসের কর্মসূচি ব্যর্থ, তাই কর্মসূচি নিয়ে যাওয়া হয় শহরে। ট্রেনে কাটা পড়ে মামুনের মৃত্যুতে শহরে যে আন্দোলন হয়েছিল, তত্কালীন উপাচার্য সেখানে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই উদাহরণটি বেশি দিনের পুরনো নয়, সম্ভবত এ কারণেই শহরের কার্যক্রম হাতে নেয়া। শহরের রাস্তা অবরোধ হলো, পুলিশ ফোন দিল উপাচার্যকে। কিন্তু উপাচার্য পুলিশকে যা বললেন তা শুধু বাংলাদেশের উদাহরণে নয়, সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। পৃথিবীর আর কোনো দেশের উপাচার্য তার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পেটানোর পরামর্শ দিয়েছেন কি না আমরা জানি না। উপাচার্য-পুলিশের এই কথোপকথনের খবর পুলিশের বরাতেই পত্রিকায় এসেছে (দৈনিক প্রথম আলো, ০৩/০৮/১০)। উপাচার্যের একগুঁয়েমির কারণেই যে এই পরিস্থিতির উদ্ভব, পুলিশ তা সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করে দিয়েছে। এখন উপাচার্য যতই বলুক এই দায়ভার পুুলিশের, পুলিশ তা মানবে না। আর দেশও জেনে গেছে কত বড় মিথ্যা কথা তিনি বলেছেন। বেদম পেটানোর পর বিশ ছাত্রকে সেদিন গ্রেফতারও করা হয়। এর মধ্যে কাউসার নামে ইংরেজি চতুর্থ বর্ষের একজন ছাত্র রয়েছে, যে তার ক্লাসের সবচেয়ে শান্ত ও ভদ্র ছেলেদের একজন। ভাংচুরের ঘটনায় সে যখন গ্রেফতার হয়, তখন বুঝতে বাকি থাকে না পেছনের দেয়ালটা পিঠের ওপর কত ওজন নিয়ে ঠেকেছে। কিন্তু উপাচার্য আবারও হিসেবে ভুল করেছেন। প্রথম কয়দিনের ক্যাম্পাসের আন্দোলনকে দক্ষহাতে সামাল দেওয়া, শহরের আন্দোলনকেও দমন করা এবং ২০ ছাত্রকে গ্রেফতার করা—ভাবলেন এবার বড় একটা ভয় দেখানো গেল। সুতরাং আন্দোলন শেষ। কিন্তু পরদিন তিনি যা দেখলেন এবং স্বভাবসুলভভাবে যা দেখালেন, আর যা দেখল সারা দেশ, তিনি-সহ কেউ ঘুণাক্ষরেও তা কল্পনা করেননি। শাটল ট্রেন ক্যাম্পাসে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর বিশাল মিছিল! প্রকম্পিত হয়ে উঠল চবি ক্যাম্পাস। তিনটি ছাত্রী হল থেকে শত শত ছাত্রীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে ব্যাপক মিছিল চবি আর কখনও দেখেনি। পুলিশের বাধাতেও তারা পিছপা হয়নি। তারা বসে পড়ে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্দেশক্রমে পুলিশ এখানেই রচনা করে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য অধ্যায়। বিস্ময়করভাবে হঠাত্ করেই তারা পেটানো শুরু করে ছাত্রীদের। সবাই হতভম্ব হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে। তারা কল্পনাও করতে পারেনি প্রশাসন এত নোংরাভাবে পুরুষ পুলিশ লেলিয়ে দেবে। কয়েকশ মেয়ের ওপর একযোগে লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল, রাবার বুলেট! ধাওয়া-ধোঁয়া-আর্তনাদ-চিত্কার, কী যে বিভীষিকাময় দৃশ্য! প্রত্যক্ষ্যদর্শী ছাড়া কাউকে বোঝানো যাবে না। দিনের শেষে প্রতি ছাত্রী হল হয়ে ওঠে এক একটি হাসপাতাল। চবির আকাশ ভারী হয়ে ওঠে আহত ছাত্রীদের আর্তচিত্কারে।
প্রশাসন সেদিন ‘মহানুভবতা’ দেখায় ছাত্রী হলে ডাক্তারসহ অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে। যাতে করে হলেই তাদের চিকিত্সা করা যায়, কষ্ট করে যাতে তাদের বাইরে আসতে না হয়। কিন্তু এখানেও প্রশাসনের ধূর্ততা গোপন থাকে না। যত আহত ছাত্রী বাইরে আসবে, হাসপাতাল-মেডিকেলে চিকিত্সা নেবে, ততই হামলার বিভীষিকা বাইরে প্রকাশ পাবে। তাই তাদের এ মহানুভবতা। এদিকে ছাত্রদের কী অবস্থা? ছাত্রদের সঙ্গে প্রশাসনের সাক্ষাত্ হয়েছে কয়েক পর্বে। প্রথম পর্বে প্রশাসনের ছিল ‘ছাত্র পেটানো কর্মসূচি’। সে পর্বেই ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। লাঠি, বর্ম, টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট, বন্দুকের বাঁট ও পায়ের বুট—এই ছিল পুলিশের অস্ত্র। আর ছাত্রদের হাতে ছিল ইট-পাটকেল, কারও কারও হাতে গাছের ডাল। অনেক ছাত্র সেদিন দুর্গম পাহাড় ও পার্শ্ববর্তী গ্রামে আশ্রয় নেয়। তবুও থামেনি তাদের আন্দোলন। তারা ধাওয়া খেয়ে আবার সংগঠিত হয়।
দ্বিতীয় পর্বে ছিল গণগ্রেফতার। যুদ্ধের সময় সামরিক বাহিনীর জলপাই রংয়ের গাড়ি যেভাবে রাস্তার ধুলোবালি উড়িয়ে জনমনকে প্রকম্পিত করে যুবকদের ধরে নিয়ে যেত আর্মি ক্যাম্পে, সেভাবেই সেদিন বিকেলে চবি ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে পুলিশের নীল রংয়ের প্রিজন ভ্যান। যাকে যেভাবে পেয়েছে, গ্রেফতার করেছে। হলের ভেতরে দরজা ভেঙে রুমে ঢুকেছে; গরুর মতো পিটিয়েছে ছাত্রদের। তারপর ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শহরে। শহরের শেষ প্রান্তে হালিশহর পুলিশ লাইনের ছোট কুঠুরিতে গাদাগাদি করে রাখা হয় ৩০০ ছাত্রকে। দেরিতে হলেও মিডিয়াতে সব খবর এসেছে। শোনা গেছে এখানেও প্রশাসন অর্থকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে; সাংবাদিকদের টাকা দিয়ে কিনতে চেয়েছে। কিন্তু অবস্থা এতটাই বেসামাল হয়ে গেছে, এই অস্ত্রও কাজে লাগেনি। শেষ পর্যন্ত উপাচার্য দেড় মাসের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেন। প্রথমে ঘোষণা ছিল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। ছাত্রছাত্রী, এমনকি প্রভোস্টদের না জানিয়ে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে এ ঘোষণা দেয়া হয় । কিন্তু অনির্দিষ্টকারের জন্য বন্ধ কথাটার মধ্যেই প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে অবস্থা কতটা বেসামাল! তাই কৌশল পরিবর্তন করে সেটা করা হয়েছে ‘৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ’। প্রশাসন ভেবেছে এর মধ্যে সব কিছু গুছিয়ে নেবে। কিন্তু ছাত্ররা থেমে থাকেনি, থাকবেও না—যতক্ষণ না তাদের যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নেয়া হচ্ছে। তারা সংবাদ সম্মেলন করেছে, জানিয়ে দিয়েছে তাদের দাবির যৌক্তিকতা এবং এর বিপরীতে প্রশাসনের কী নির্মম ভূমিকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সংবাদ সম্মেলন হয়েছে। সাবেক ডাকসু নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না এ আন্দোলনকে বলেছেন নব্বই-পরবর্তী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ছাত্র আন্দোলন। সারাদেশে নিন্দার ঝড় বইছে। চবি প্রশাসন তারপরও মিথ্যাচার করেই যাচ্ছেন। তারা এখনও সব দোষ ছাত্রদের ঘাড়েই চাপাতে চাইছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের এই হুযুগে তারা এটাকে শিবিরের নাশকতার চেষ্টা বলে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার পাঁয়তারা করছে। তারা নাকি ভিডিও ফুটেজ দেখে শিবিরের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে—আন্দোলনের চরম পর্যায়ে এত ছাত্রছাত্রীর অংশগ্রহণ দেখে শিবির যদি এই সুযোগ কাজে লাগাতে চায়, সেই দায়ভারটা কার? অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। তারা যদি শুরুতেই আন্দোলনকারীদের দাবি-দাওয়াকে আমলে নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসত, তবে কেউ পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারত না। আন্দোলনকারীরা সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছে যে, ভাঙচুরের ঘটনায় উপাচার্যের মদদপুষ্ট ক্যাডারবাহিনী ছিল। তারা আন্দোলনকে খারাপ দিকে ঠেলে দিয়ে সাধারণ ছাত্রদের ওপর দায় চাপানোর পথ করছিল কি না, তাও খুঁজে বের করা দরকার। সর্বপরি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এর দায় এড়াতে পারে না; যেহেতু পুলিশের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক তারাই। অভিযোগের তীর যাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দিকেও। যে ঘটনা পাহাড় ঘেড়া চবিতে ঘটেছে, তা যদি রাজধানীর ঢাবিতে ঘটত, তবে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারও এতদিনে নড়ে উঠত।
প্রশাসনের ব্যাপক দুর্নীতির কথা সবারই জানা। গুঞ্জন রয়েছে, প্রতিবছর ভর্তি ফরম বিক্রি বাবদ যে কোটি কোটি টাকা আয় হয় তা গুটিকয়েক শিক্ষক ও রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের ক্যাডারদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়। বিভিন্ন প্রকল্পসহ নানা খাতে যে লুটপাট হয় তা ঠেকাতে পারলেও ছাত্রছাত্রীদের এই অতিরিক্ত বোঝা বহন করতে হয় না।
তাই সংশ্লিষ্ট সবারই উচিত ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়া। কুঁজো হয়ে যাওয়া, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া চবির ঘুমন্ত যৌবন যেভাবে মেরুদণ্ড সটান করে জেগে উঠেছে, আর কোনো শোষণ তারা মেনে নেবে না। আর যেহেতু এর ঢেউ লাগতে শুরু করেছে সারাদেশের সব বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে; সুতরাং সরকারের সামনেও এক কঠিন ভবিষ্যত্ অপেক্ষা করছে। তাই সরকারকেও ভাবতে হবে—তারা কি আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের শিক্ষাবাণিজ্যের প্রেসক্রিপশন বাস্তবায়ন করবে, নাকি এ দেশের নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত আপামর জনসাধারণের কাছে উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত রাখবে।
এটিএম মোহিতুল ইসলাম, শাফিনূর নাহার, মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ, তানজিল মাহমুদ শাহ্