তোমার কি হয়েছে মিলি? লিমন জিজ্ঞেস করে।
-না কিছুই না।
-আমাকে বল, আমি তোমার স্বামী তোমার যেকোন কোন সমস্যা আমার চেয়ে আর কে ভাল বুঝবে বল?
-আরে না কিছু না।
কিন্তু দিন দিন মিলির আচারণ অস্বাভাবিক হতে থাকে, মিলির মা কিংবা বোনেরা ফোন করলেও তাদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করে। মাঝে মাঝে মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে হাওমাও করে কান্নাকাটি করে। মেয়ে নুসরাত মায়ের এমন অবস্থা দেখে একা একা মন খারাপ করে বসে থাকে।
একদিন লিমন মিলিকে একজন মনঃচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার সামদানী খুবই বিচক্ষণ ব্যাক্তি । লিমনকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে মিলির কাছে তার শৈশব কৈশোর, বাবার মৃত্যু বিয়ে সব ঘটনাগুলো খুটিয়ে জানতে চান।
-দেখুন আমার কাছে কিছুই লুকাবেন না। আমি আপনার ভাল চাই, আপনি অকপটে সব কিছু আমাকে বলুন তবেই আমি আপনাকে ভাল কিছু সমাধান দিতে পারবো। আর কারো জন্য না হোক আপনার মেয়ের জন্য হলেও আপনাকে স্বাভাবিক হতে হবে।
হঠাৎ করেই মেয়ের কথা শুনে মিলির বুকের ভিতরটা হাহাকার করে ওঠে। কতদিন হল মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে আদর করা হয় না!
- আমি বাচতে চাই আমার মেয়ে নুসরাতের জন্য হলেও বাচতে চাই।
মিলি ধীরে ধীরে ডাক্তার সামদানীর কাছে জীবনের সবগল্পগুলো অকপটে বলতে থাকে,
পাচ বোনের মধ্যে আমিই সবার বড়, তাই মায়ের প্রথম চিন্তা সবার আগে সবার আগে আমাকে পার করা। বাবা বেচে থাকলে হয়তো এতটা ভাবতে হতোনা আমার মা সফুরা বেগমকে। তিনি মারা গেছেন প্রায় দশ বছর আগে, তারপর থেকে মা সংসারের হাল ধরেছেন। মায়ের সামনে তখন বিরাট দায়িত্ব, পাচ পাচটা মেয়ে বিয়ে দেওয়াতো আর চাট্টিখানি কথা নয়? আমি যতটুকু বুঝি আমি দেখতে যথেষ্টই সুন্দরী কিন্তু আমার বাবা বেচে নেই কিংবা লম্বায় কিছুটা কম এইসব অজুহাতে একটার পর একটা বিয়ে ভেঙে যায় আর আমার মা সফুরা বেগমের টেনশন বাড়তে থাকে।
একদিন সকালে বাবার বন্ধু আফজাল চাচা হাজির।
-অনেকদিন আপনাদের বাড়ি আসা হয় না ভাবী ভাললাম মর্নিংওয়াক সেরে একটু ঘুরে যাই।
-খুব ভাল করেছেন আফজাল ভাই,মিলির বাবা মারা যাওয়ার পর আমরা কি কঠিন সময় পার করছি সেটা একমাত্র আল্লাহ ই জানেন।মেয়েমানুষ হয়ে দর্জির দোকান চালানো যে কতটা যে কঠিন সেটা আমি ছাড়া আর কে ই বুঝবে?
-সবই তো বুঝি ভাবী কি আর করার আছে আমাদের? আচ্ছা ভাবী মিলিরতো বয়স হয়েছে ওর বিয়ের কথা ভাবছেন?
-বিয়েতো দিতেই হবে,কিন্তু ভাল পাত্র পাই কই? আর আমার যা অবস্থা তাতে বিয়েতে খরচ করার মত কোন টাকাও অবশিষ্ট নেই।
-আমার হাতে একটা ভাল পাত্র আছে, আর খরচাপাতি নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না ভাবী,আপনাকে কিছুই খরচ করতে হবে না শুধু বলেন রাজী আছেন কিনা?
-আপনি কার কথা বলছেন আফজাল ভাই?
-কেন আমার ভাতিজা লিমন,ব্যাংকে বড় পদে চাকুরী করে, অনেক টাকা বেতন পায়, লোন পেয়ে গেলে দুই এক মাসের মধ্যেই ফ্লাট কিনবে।ছেলের বয়স একটু বেশি, কিন্তু ছেলেদের বয়সে কি আসে যায়?
-আমাকে একটু ভাবতে দেন ভাই পরে না হয় জানাই।
-আচ্ছা ঠিক আছে ভাবী, তবে বেশি সময় নিয়েন ভাবী, আর আপনার পাচ পাচটা মেয়ে, সবগুলোর বিয়ে দিতে হবে সেটাও একটু মাথায় রাইখেন।
আর যা বললাম কিছু ছোটখাটো কিছু বিষয়েতো ছাড়তো দিতেই হয়।
এ কথা বলে বাবার বন্ধু আফজাল সেদিনের মত বেরিয়ে গেলেন।
মা সফুরা বেগম অনেক চিন্তাভাবনা করে দেখলেন আমার বয়স ৩৩, এখন বিয়ে না দিলে পরে ভাল পাত্র পাওয়া মুশকিল হবে। অন্তত ২০টা বিয়ে ভেঙ্গেছে। তাছাড়া লিমন সচ্ছল পরিবারের একমাত্র ছেলে, তাই সাত পাচ ভেবে আমার মতামত অগ্রাহ্য করে আফজাল সাহেবের ভাতিজা লিমনের সাথে আমাকে বিয়ে দেওয়ার সিন্ধান্ত নিলেন । তিনি আমাকে বোঝালেন
-দেখ মিলি তোর আরও চার চারটি বোন রয়েছে, তাছাড়া লিমনের বাবা বলেছেন বিয়ের যাবতীয় খরচাপাতি তিনিই দেবেন। আমাদের মত তোকে টিনের খুপড়ি ঘরে থাকতে হবে না। নিজের বোনেদের কথা ভেবে হলেও তুই রাজী হয়ে যা মিলি।
মায়ের এমন অনুরোধ অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই, তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই বিয়েতে রাজী হয়ে যাই।
মহাধুমধামের সাথে একটি নামকরা কমিউনিটি সেন্টারে আমাদের বিয়ের হয়ে যায়। যাবতীয় খরচ ছেলে পক্ষই দেয়। এমনকি আমার বাকী চারবোনের জন্য নতুন কাপড়চোপড় কেনা ও অন্যান্য খরচ বাবাদ এক লাখ টাকার একটা চেক আফজাল চাচার মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন।
বিয়ের পর দুই কামরার টিনশেড খুপরি ঘর থেকে আমার স্থান হয় আঠারোশো স্কয়ারফিটের বিশাল ফ্লাটে। আমার সংসারে শুধুই সুখ আর সুখ। লিমন বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে, গ্রামেও তাদের প্রচুর সম্পত্তি,লিমনের বাবা একটা সরকারি চাকুরী করতেন সেখান থেকে বেশ ভাল অংকের রিটায়ার্ডমেন্ট বেনিফিট পেয়েছেন তাছাড়া লিমনের উচ্চ বেতনের চাকুরী, সব মিলিয়ে অর্থ সম্পদের কোন অভাব নেই লিমনদের।
সবকিছু বিবেচনা করে আমি নিজের সংসারে মনোযোগী হই। শ্বশুরকে সময়মত চা দেওয়া, প্রতিদিন রাতে প্রেশারের ঔষধ খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেওয়া, শ্বাশুড়ির পাকাচুল বেছে দেওয়া, চুলে তেল দিয়ে দেওয়া সব দায়িত্বই যথাযথ ভাবে পালন করতে থাকি।
ওদিকে স্বামী লিমনও আমার রূপেগুনে মুগ্ধ। মাঝেমধ্যেই আমার জন্য কানের দুল,পায়ের নুপুরসহ এটা সেটা কিনে নিয়ে আসেন।
-বিয়েতেইতো কত গহনাই দিলে আবার এসবের কি দরকার ছিল?আমি হেসে বলি।
-অবশ্যই দরকার আছে, আমার বউয়ের হাসি পৃথিবীর সবচেয়ে দামী, লিমন বলে।
মাঝেমধ্যেই লিমন আমাকে নিয়ে ফাস্টফুড কিংবা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়। কক্সবাজার, সিলেট বেড়াতে নিয়ে যায়। আমার ভাললাগা মন্দলাগা সুবিধা অসুবিধা সব কিছুরই খেয়াল রাখে লিমন। বিয়ের আগে আমার মনের মধ্যে যে সংশয় দানা বেধেছিল তা অল্প দিনেই দূর হয়ে যায় । আমি তখন একজন সুখি রমণী।
বিয়ের দুই বছরের মাথায় আমার কোল আলো করে মেয়ে নুসরাতের জন্ম হয়। শ্বশুর শ্বাশুড়ি আত্মীয়স্বজনরা সবাই খুশি। আমার মা নাতনীর জন্য ছোট ছোট কাথা সেলাই করে নিয়ে দেখতে আসেন। শ্বাশুড়ির পীড়াপীড়িতে মাকে সেদিনের মত থেকে যেতে হয়। মেয়ে সুখে আছে দেখে আমার মা সফুরা বেগম পরম তৃপ্তি নিয়ে বাড়ি ফিরে যান।
পাচজনের পরিবারে আমার মেয়ে নুসরাত যেন একটি জীবন্ত খেলনা, পরিবারের সকল মনযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় সে। এভাবে বিয়ের প্রথম চার বছর বেশ হাসি আনন্দ আর ভালবাসায় কেটে যায়। আমি আমার ফেলে আসা টানাপোড়েনের সংসার থেকে সুখের সাগরে ভাসতে থাকি।
একদিন দুপুরে কলিং বেলের শব্দে দরজা খুলতে যাই। আমি ভেবেছিলাম লিমন হয়তো আগে ভাগে ফিরে এসেছে। দরজার খুলে দেখি ময়লা শার্ট আর খোচাখোচা দাড়ির একলোক দাড়িয়ে আছে। সাথে পাচ ছয় বছরের একটা বাচ্চা ছেলে।
-কাকে চান? আমি জিজ্ঞাসা করি।
-লিমন আছে?
-আপনি?
এরমধ্যেই আমার শ্বাশুড়ি হাজির হয়।
-আরে মনির? এটাকি আমার আমার দাদুভাই?
-হুম।
বাচ্চাটিকে আমার শ্বাশুড়ি পরম আদরে কোলে তুলে নেয়,বারবার চুমু দিতে থাকেন।
আকস্মিক এই ঘটনায় আমি হকচকিয়ে যাই।
শ্বাশুড়ির কাছে জিজ্ঞাসা করি।
-আম্মা বাচ্চাটা কে?
-আমার দাদুভাই, আমার শ্বাশুড়ির উওর।
লিমনের যে আগে বিয়ে ছিল সেই বিষয়টি অবশ্য আফজাল চাচা গোপন করেননি।লিমনের একটা বিয়ে হয়েছিল সেই পক্ষে একটা ছেলেও আছে। আমার শ্বাশুড়ির কাছ থেকে জেনেছি লিমনের যে মেয়েটার সাথে বিয়ে হয়েছিল মেয়েটার চরিত্র ভাল ছিল না অন্য ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়েছে। আসলে একপক্ষ থেকে কথা শুনলে কথার সত্য মিথ্যা যাচাই করা মুসকিল।অল্প দিনেই আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে আমার শ্বাশুড়ি মোটেও সহজ মানুষ নন। এটা করা যাবে না ওটা করা যাবে না এখানে যাওয়া যাবে না ওখানে যাওয়া যাবে না এসব শুনতে আমাকে সবসময় তটস্থ থাকতে হয়।আমি জানতাম লিমনের প্রথম পক্ষের ছেলেটা মামার বাড়িতে থাকে, বিয়ের আগে শুনেছিলাম ওই ছেলে সারাজীবন মামাবাড়িতেই থাকবে লিমন প্রতিমাসে খরচ বাবাদ পাচ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেবে।
-আজ থেকে আমার দাদুভাই এখানেই থাকবে, তুমি ওর খেয়াল রাখবে বৌমা,
-ঠিক আছে আম্মা, আমি নিজেকে সামলে নিয়ে উওর দেই।
লিমনের অতীত যে এভাবে আমার সামনে এসে হাজির হবে সেটা আমি কোনদিনই ভাবতে পারেনি। হঠাৎ করেই আমার সংসারের সুখ কেমন যেন ফিকে হয়ে আসে। কিছুই ভাল লাগে না আমার ।এতদিন পরিবারের সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আমার মেয়ে নুসরাত, হঠাৎ করেই নুসরাতের সেই ভালবাসার জায়গাটাও যেন দুইভাগ হয়ে যায়।
গল্পে অনেক সৎ মায়ের গল্প পড়েছি আমি। গল্পের সৎ মা সবসময় খারাপ হয়, বাচ্চাদের উপর অত্যাচার করে, বাচ্চাদের ঠিকমত খেতে দেয় না, কথায় কথায় মারে। আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি গল্পের সৎ মায়েরদের মত সে হবো না, সত্যিকারের মা হবো।
নিজের মেয়ে নুসরাতের চেয়েও লিমনের ছেলে আবিরের প্রতি বেশিমাত্রায় যত্নবান হই আমি। আবিরকে সময়মত খাওয়ানো গোছল করানো, স্কুলে নেওয়া আনা কোন কাজেই কোন ত্রুটি রাখি না।সবসময় ভিতর ভিতর এক ধরনের ভীতির মধ্যে থাকি এই না জানি আবীরের প্রতি একটু অযত্ন হয়ে যায় , আবীরের একটু অযত্ন হলে তার শ্বশুর শ্বাশুড়ি কি ভাববে?লিমন কি ভাববে? আমিতো গল্পের সৎমায়েদের মত ভয়ংকর নই।
আবীরের যত্ন নিতে নিতে নিজের মেয়ের প্রতি অবহেলায় করতে শুরু করি। ভাবি নিজের মেয়ের যত্ন না নিলেও কেউ কিছু বলবে না, এমনকি ধীরে ধীরে নিজের প্রতিও অবহেলা শুরু করি। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করি না নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নেওয়াও কমিয়ে দেই। কিছুতেই মন থেকে নিজের ছেলে হিসাবে আবীরকে মেনে নিতে পারি না।আসলে মানুষের জীবনটা বড়ই বিচিত্র, তাকে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে লোক দেখানোর জন্য অনেক কাজ করে যেতে হয়। বাস্তব জীবনে অভিনয় করতে করতে আমি একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ি। মাঝে মাঝেই মনে হয় আত্মহত্যা করি কিন্তু মেয়ে নুসরাতের কথা ভেবে সেটাও করতে পারিনা।
ডা. সামদানী বলেন
- প্রথমেই আপনাকে ধন্যবাদ সুন্দরভাবে গল্পটা বলার জন্য। আপনি নিজেই আপনার নিজের সমস্যার সমাধান করে ফেলেছেন, আপনি বাচে থাকতে চান তাই বিষয়টা এভাবে ভাবুন আপনার কিছু হলে আপনার মেয়ের অবস্থা আবীরের চেয়েও খারাপ হতে পারে। আমি আপনাকে সামান্য কিছু ওষুধ দেবো তবে আপনার সদিচ্ছাই সবচেয়ে বড়।
আপনি চাইলে নিজেকে অন্য কোন কাজে ব্যস্ত রাখতে পারেন তাতে আপনার মনোযোগ অন্যদিকে ডাইভার্ট হবে।
এরপর কেটে গেছে পাচ বছর , মিলি এখন একটি বেসরকারি ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার। নুসরাত ক্লাস থ্রি আর আবীর ক্লাশ সিক্স এ পড়ে । স্বামী সংসার ছেলে মেয়ে,চাকুরী নিয়ে মিলি সুখী রমনী।
-
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০১৯ বিকাল ৩:১১