তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ এক স্রোতস্বিনী। এগিয়ে চলছে দু’জন সাঁতারু বাজি রেখে জীবন। দ্বিমুখী লড়াই । একদিকে স্রোতের চ্যালেন্জ। অন্যদিকে প্রতিদ্বন্ধীর । তবুও সামনে এগিয়ে যাওয়া। এগিয়ে যাচ্ছে তারা। পৌঁছে গেল এক-তৃতীয়াংশ প্রায়।
কিন্তু একি হলো! একজন যে ফিরে আসছে! রণেভঙ্গ? সত্যিই তো! পিছপা হয়ে টার্ন করল সে উল্টো দিকে। ফিরে আসল আগের জায়গায়।
আর অন্যজন! তার কী হবে! একাকি সে । আশ্চর্য! একাকিই এগিয়ে যাচ্ছে সে লক্ষ্যপানে। স্থির এ দিকের উপকূলের সবগুলো চোখ । উদ্বিগ্ন সবগুলো।
সফলতার উপকূল। সে তো এখনো অনেক দূরে। এদিকে নিস্তেজ হয়ে এসেছে সে। তাবুও সামনে এগিয়ে যাওয়ার লড়াই। লড়াই সফলতার উপকূলে পৌঁছানোর। মরণপণ লড়াই। আপোষহীন। অকুতোভয় সে। পৌঁছে গেল সে কাছাকাছি। মানজিলে মাকসুদের কাছাকাছি।
পরে একটা নৌকা অসহায় ভেবে উঠিয়ে নিল তাকে। উঠানো না হলে হয়তো সে পৌঁছে যেত। সফলতার উপকূলে। মুমূর্ষাবস্থায়। হয়তো বা ওখানেই রচিত হত তার সলিল সমাধি।
এখানে কার্যত কেউ উপকূলে পৌঁছতে না পারলেও উপস্থিত দর্শকসকল দ্বিতীয় জনকেই বিজয়ী হিসেবে সাব্যস্ত করেছে। প্রথম জন চিহ্নিত হয়েছে পরাজিত হিসেবে।Ñ স্রষ্টার দেয়া মেমোরি কার্ডে সংরক্ষিত আমার ছেলেবেলার জীবন্ত মুভি এটি।
কী ভাবছ বন্ধু! এটি কি বলার মত ঘটনা, নিত্যদিনই তো এসব আমি দেখতাম কৈশোরে। নদীমাতৃক বাংলার গ্রামীণ জীবনেÑ তাই নাকি? আঁছ করতে পারছনা কিছুই ? কি উদ্দেশ্য এ নগণ্য দৃশ্য দেখিয়ে?
ঠিকই ধরেছ। জীবনের এক চিরন্তন ফিলসফি লুকিয়ে আছে এখানে। কচিমনে আমার যেটি ফেলেছিল ইতিবাচক প্রভাব । আজ পরিণত বয়সে এসে বাস্তবতার রণাঙ্গনে ঐ দৃশ্য ভেসে উঠে প্রেরণার বাতিঘর হয়ে।
শোন! ঐ দৃশ্যকে যদি সফলতা-ব্যর্থতার কষ্ঠিপাথর বানাই তাহলে কেমন হয় ? তুমি একমত হবে আশা করি।
স্রোতস্বিনী এ জীবন নদীতে কত যে বিচিত্র সাঁতারুর সমাহার! কেউ সাফল্যের সাথে কাঙ্খিত মনজিলে পৌঁছে সফলতার পতাকা উড্ডীন করে। কেউ প্রবল বেগে ছুটে এসে মাঝখানে হারিয়ে যায়। আবার কেউ তো বিছ্মিল্লায় গলদ। তুমি কি দেখো নি, প্রবল প্রতাপশালী সেসব প্রেসিডেন্ট, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, বিশ্বমাতানো সুন্দরীদের যারা জীবনযুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছে আত্মহত্যার মাধ্যমে। দুরন্ত হিটলারের আতœঘাতী গোল তুমি দেখেছো নিশ্চয় । সফলতাকে কবর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারলেই সার্থকতা।
অন্যদিকে আছে এমনও অজস্র দৃষ্টান্ত যেগুলো প্রেরণার এক একটি লাইটহাউস হয়ে থাকবে চিরদিন। তুমি কি দেখো নি নগণ্য কেরানী থেকে নোবেল বিজয়ী বার্নাডশ কে? দেখো নি তুমি জিরো থেকে হিরো হওয়া দারিদ্রপীড়িত জেলে পরিবারের ছেলে প্রেসিডেন্ট এ পি জে আবদুল কালামকে? কামারের ছেলে থেকে বিশ্বনন্দিত প্রেসিডেন্ট ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মজলুমানের সোচ্চার কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠা প্রেসিডেন্ট ডক্টর আহমাদি নেজাদকে কে না জানে?
কিন্তু আমাদের খুব কমই এগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে থাকি। আমাদের অধিকাংশই বলে বেড়াই - আসলে আমার কপাল খারাপ। আমার দ্বারা কী আর হবে। আমার মেধা কম। পারিবারিক অবস্থা আমার ভাল না , ইত্যাদি। ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম শিক্ষা নাকি এই যে, ‘ মানুষ খুব কমই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে থাকে।’
কাজের কথায় আসা যাক। তুমি কি বন্ধু চিন্তিত? পারিবারিক স্টেটাস্ নিয়ে? তোমার জন্ম হয়েছে হয়তো দরিদ্রে জর্জরিত কোন পরিবারে সহায়-সম্বলহীন অবস্থায়। কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে । অথবা মধ্যবিত্তে। আমি নিশ্চিত তোমরা যারা প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যাল-কলেজে অধ্যয়নরত তাদের অধিকাংশের অবস্থান মধ্যবিত্ত স্তর থেকে নিচের দিকে।
তাতে কী হয়েছে! তোমার আছে স্রষ্টার দেয়া এক শক্তিশালী মস্তিস্ক। তাঁর দেয়া বিবেক-বুদ্ধি। এসব যথাযথ কাজে লাগিয়ে তুমি ও হতে পার ইতিহাসের আরেকটি সোনালী অধ্যায়। নজরুল কি বলেন নি -
‘হে দারিদ্র! তুমি মোরে করেছ মহান’।
আর পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা ভাল হলে তো কথাই নেই। তবে সে দিকে আছে অন্য বিপদ। বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেওয়ার বিপদ। তাই সাবধান !
তবে হ্যাঁ। সফলতার কাঙ্খিত মনজিলে পৌঁছতে হলে তোমার থাকা চাই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য। লক্ষ্য বাস্তবায়নের সুন্দর পরিকল্পনা। আর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সর্বাত্মক চেষ্টা। সোজা কথায় লক্ষ্যের জন্য তোমার মানসিকতা হওয়া চাই ‘উড় ড়ৎ ফরব’ – টাইপের। মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন।
সত্য বলতে কি আমাদের দেশের অধিকাংশ ছাত্রের কোন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকেনা। কারো কারো লক্ষ্য থাকলেও লক্ষ্যে পৌঁছার কোন পরিকল্পনা থাকে না তাদের অনেকের। কেউবা পরিকল্পনা করে এভাবে - দেখি রেজাল্ট কেমন হয়, ভাল হলে ওটা করব, আর ভাল না হলে......ইত্যাদি। ‘হলে’ মার্কা পরিকল্পনা। আমাদের মধ্যে তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য যারা বালক লিংকনের মত কাটছাঁট বলে দিতে পারে - ‘আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হব আমি।’ এ ধরনের দৃঢ় মনোভাব থাকা চাই। কিভাবে লিংকন প্রমাণ করেছিল দঋধরষঁৎব রং ঃযব ঢ়রষষধৎ ড়ভ ংঁপপবংং.’ তা তোমার অজানা নয়।
সেই অশ্বারোহী দুরন্ত রণযাত্রীর মানসিকতা আমাদের থাকা চাই যে দুর্বারবেগে দুর্গমগিরি পাড়ি দিতে গিয়ে পথের ঝোপ-ঝাড়ের কণ্টকাঘাতে রক্তাক্ত হয়েও সে দিকে ভ্র“ক্ষেপই করেনা। সময় থাকেনা যার সেদিকে ফিরে থাকানোর। মায়ের আদর, বোনের হাসি, সংসার সুখ, প্রিয়ার মুখ, প্রেমিক-প্রেমিকার মায়াবী চাহনি সব ছেড়ে চলে সে লক্ষ্যপানে। সব পিছুটানকে পদাঘাত করে এগিয়ে যেতে জানে সে। সব পিছুটান তার কাছে হয়ে যায় একেবারেই তুচ্ছ। দুর্নিবার সে। বিপদ দেখে সে যায় না থমকে। এক পথে ব্যর্থ হলে সে বের করে নেয় বিকল্প বহু পথ। প্রত্যেকটি ব্যর্থতাকে সে পরিণত করে সফলতার একেকটি লাইটহাউসে।
কী! বিশ্বাস হচ্ছে না ! তাহলে শুনো! বিংশ শতাব্দীর আরেক ঘুমভাঙ্গানী লেখক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, বিপ্লবী, সাংবাদিক যিনি চৌদ্দ বছরে এতিম হয়েছেন তার বক্তব্য-
‘মানব ইতিহাসে প্রথম শ্রেণীর যত মানুষের জীবন কথা পাওয়া যায় তাদের শতকরা প্রায় নব্বই জনই দরিদ্র পিতা-মাতার ঘরে জন্ম গ্রহণ করেছেন। তাদেরকে সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় জীবনের মহাসমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয়েছে। তারা তরঙ্গের আঘাত সহ্য করে এগিয়ে যেতে শিখেছেন। যৌবনের কামনা-বাসনাকে গলা টিপে হত্যা করে যৌবনকাল কাটিয়েছেন। এবং এভাবে সংগ্রাম করতে করতে একসময় উপকূলে পৌঁছে সফলতার পতাকা উড্ডীন করতে সক্ষম হয়েছেন।’
সুন্দর পরিকল্পনার পাশাপাশি ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন’ টাইপের মনোভাব থাকলে লক্ষ্যে তুমি পৌঁছবেই। জীবন তরীকে সফলতার উপকূলে নিয়ে যেতে হলে নিচের বিষয়গুলো তোমাকে বিবেচনায় রাখতে হবে-
প্রথমত: জীবনে সফলতা ও ব্যর্থতার হিসাব হয় চূড়ান্ত লক্ষ্যের সফলতা ও ব্যর্থতার আলোকে। এজন্য চূড়ান্ত লক্ষ্য নির্ধারণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করতে পারলে পর্ণকুঠিরের সহায়-সম্বলহীন কোন অবলার জীবনকেও সার্থক বলা যায়। বিপরীতে চূড়ান্ত লক্ষ্যে ব্যর্থ হলে প্রসিডেন্ট কিংবা বিলিয়নিয়ার যে কেউই ব্যর্থদের তালিকাভুক্ত হয়। সমকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মতাদর্শ নিয়ে ব্যাপক অধ্যয়ন তোমাকে করতে হবে চূড়ান্ত লক্ষ্য নির্ধারণে। পর্যাপ্ত অধ্যয়নের মাধ্যমে কেউ যদি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে ‘দুনিয়ার এ জীবনটাই প্রথম ও শেষ, মৃত্যুপরবর্তী জীবন বলতে কিছু নেই’ , তবে তার চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে ‘জীবনকে যেকোন মূল্যে যেকোন উপায়ে সর্বাত্মকভাবে ভোগ করা ।’ মানবসেবা, দান-খয়রাত, বিয়ে-সাদী, অর্থ-বিত্ত, পদমর্যাদা ও জীবনের সামগ্রিক কর্মকান্ডে ‘এনজয়’ ই হবে তার মূল উদ্দেশ্য। আর কেউ যদি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ‘ঐশী বিধানই ( উরারহব এঁরফবষরহব) সফলতার একমাত্র পথ’, তার চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে ‘স্রষ্টার সন্তোষ অর্জন’।
দ্বিতীয়ত: তোমাকে নির্ধারণ করতে হবে কোন সেক্টরে তুমি যাবে। কোন মাধ্যম (সবফরঁস) অবলম্বন করে তুমি চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছতে চাও। সোজা কথায় পেশা নির্ধারণ। তোমার স্বভাবজাত প্রবণতা, পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার আলোকে নির্দিষ্ট করতে হবে কোন সেক্টরে ক্যারিয়ার গড়বে তুমি।
তৃতীয়ত: সেক্টর নির্ধারণের পর সে সেক্টরের সর্বোচ্চ স্থরে পৌঁছার জন্য তোমার থাকা চাই সুন্দর একটি পরিকল্পনা। দীর্ঘমেয়াদী ও স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে তোমাকে।
এককথায়, তোমার প্রত্যেকটি সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা, দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর অর্থাৎ সমগ্র জীবনটাই লক্ষ্যের জন্য বয় হবে পরিকল্পিতভাবে।
মনে রেখো বন্ধু! উন্নত ক্যারিয়ার, কাঙ্খিত জীবন-সঙ্গী ও সঙ্গীনী, অর্থ-সম্পদ এসব হল চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছার মাধ্যম (সবফরঁস)। এসব মাধ্যমের কোন কোনটি না পেয়েও তুমি পৌঁছতে পারো চূড়ান্ত লক্ষ্যে । জীবন তরীকে নোঙ্গর করতে পারো সফলতার স্বপ্নীল সীমানায়। সফলতা-ব্যর্থতার মানদন্ড হল, লক্ষ্যের জন্য কে কী পরিমাণ চেষ্টা করল কিংবা করলনা।
শেষ করতে গিয়ে মনে পড়ে গেল ইতিহাসের সেই নির্মম শিক্ষার কথা-
বন্ধু আমার! ইতিহাসের সেই ‘মিষ্টার এ্যাভারিজ ম্যান’দের তালিকাভুক্ত হতে যাবেন না তুমি.......।