আমাদের কবিতা: প্রথম পর্ব এখানে
প্রবণতা ও প্রবণতা সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি:
যে কোনও কালের কবিতাই , যদি আলাদাভাবে চিহ্নিত হয়, তবে সেটা তার প্রবণতার জন্যই। ক্লাসিসিস্ট থেকে রোমান্টিক, রোমান্টিক থেকে মডার্নিস্টিক বা পোস্টমডার্নিস্টিক বা পোস্টল্যাঙ্গুয়াল বা যত প্রকারের চিন্তাভূমি আমরা দেখবো এদের মূলকথা প্রবণতাকে ঘিরেই। আবার প্রতিটি কালের প্রবণতাই যে খুব নির্দিষ্ট- তাও নয়, তার অনেকগুলো দিকচিহ্ন থাকতে পারে কিন্তু মূলগতভাবে তারা খুব কাছাকাছি। একারণে একজন বিনয় মজুমদার যেমন আধুনিক কবি, ঈভ বনফোয়া ও তেমনি আধুনিক কবি।
কিন্তু এই দেশে, অনেক কিছুর মতোই, কবিতার প্রবণতা চিহ্নিত করণে বিস্তর ঊনতা রয়ে গেছে বলে মনে হয়। এমনকী রয়েছে ভূলপাঠও। তেমনি একটি ভূলপাঠের উদাহরন দেয়া যেতে পারে সমকালীন বাংলা কবিতা নামক একটি সেমিনারে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের উপস্থাপিত প্রবন্ধটিতে। ঐ প্রবন্ধটিতে আমাদের কবিতার প্রবণতা চিহ্নিতকরণের চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু বাংলা কবিতার প্রবণতা চিহ্নিত করতে গিয়ে যখন কবিতা চিহ্নিতকরণের নামে আলতাফ হোসেন, মোস্তফা আনোয়ার, মাসুদ খান, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ,রিফাত চৌধুরী,জুয়েল মাজহার, মজনু শাহ এবং চঞ্চল আশরাফের মতো কবিরা খড়ের গাদায় সূচের মতো হারিয়ে যান, তখন খুব আশ্চর্য লাগে। আশ্চর্য লাগে, শূন্য দশকের কবিতার প্রবনতাকে চিহ্নিত করতে গিয়ে উনি যখন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে পডুয়া ছাত্র ছাড়া আর কাউকেই দেখতে পান না। নব্বই দশকের উল্লেখযোগ্য কবি তার কাছে মনে হয় দুই সাহিত্য সম্পাদককে। এটা একধরনের অসততা
কী না, সে প্রশ্নে আমরা যেতে চাই না। যদিও আমরা জানি, কবিজীবনে দু একটি উজ্জ্বল পংক্তি মানে বিশেষ কোনো প্রবণতা নয়। অথচ সৈয়দ মনজুরের আলোচনায় উঠে আসতে দেখি তেমন কবিদেরই।
তাহলে এখন প্রশ্ন জাগে কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রবণতাকে দেখলে একজন প্রকৃত কবি পাঠকের চোখে ধরা পড়তে বাধ্য। এক্ষেত্রে আমার মনে হয়, একটা জিনিসই আমাদের করণীয় আছে: কবিকে টোট্যালিটি থেকে দেখা। এই টোট্যালিটি তাহলে কী এবং তার রূপ কী, সে মীমাংসায় আসতে হয়।
এককথায় এই টোট্যালিটি মানে কবির ’সম্পূর্ণ কবিত্ব’। কবিত্ব বলতে এখানে আমরা যেন এর ক্লিশে অর্থ কে না ধরি। কবিত্ব বলতে একজন কবি তার পাঠককে কোথায় নিয়ে যেতে চান এবং এই জার্নিটার ভেতর দিয়ে তিনি কী কী করলেন এবং করলেন না- সেটা দেখা দরকার। সবচেয়ে বেশি বোধহয় দেখা দরকার, একজন কবি কী কী লিখলেন না। (সন্দীপণ চট্টোপাধ্যায় এর একটি কথা আছে: একজন লেখক কী কী লিখলেন না, সেটাই তার আর্কেটাইপ গড়ে দেয়।)। আর যেটাকে বলছি টেট্যালিটির রূপ সেটা বোধহয় জলের বহমান ধারার মতোই। কেননা, প্রতিটি কবিই দিনানুদিন নিজের স্থান থেকে সরে যেতে থাকেন। না সরে গেলে নিজের জায়গাতে থেকেই নিজে বদলে যান। আবার এ দুটি কোনো কবির ক্ষেত্রে একসাথেও ঘটতে পারে । যেমন: রণজিৎ দাশ। তাঁর অপরাপর গ্রন্থগুলোর সাথে তার নতুন গ্রন্থটা(সমুদ্র সংলাপ, গত বছর প্রকাশিত) এবং তার প্রবন্ধের বইটা পড়া গেলে এই সরে যাওয়াটা স্পষ্ট টের পাওয়া যায়।
সাজ্জাদ শরিফ প্রায়ই একটি কথা বলেন: 'কবিতাকে গ্রহন করিয়ে নিতে হয়”।' পাঠকের কাছে । কবি এটা যতটা করেন তার কবিতা দিয়ে তার চেয়ে বেশি বোধহয় করে থাকেন তার যাত্রাপথ দিয়ে। একারণেই বোধহয় কাফকার গল্প উপন্যাসের চেয়ে তাঁর ডায়েরি এবং কথোপকথন কিংবা প্রুস্তের উপন্যাসের চেয়ে তার জার্নাল আমাদের কাছে বেশি প্রিয় হয়ে ওঠে। জীবনানন্দ দাশের বোধহয় এমন একটি কথা আছে যে, বুদ্ধি করে বা ফন্দি এটে কবিরা কবিতা লিখতে আসেন না। একটু দুর্বিনীত হলেও এই কথাটা আমার কাছে একটু আপেক্ষিকই মনে হয়। কেননা, জীবনানন্দ পরবর্তী কবিতার যে নতুন যুগটা শুরু হয়েছিলো কিংবা বাংলাদেশে আশির দশকের থেকে যে নতুন যাত্রার দিকে বাংলা কবিতা গেল, সেটা বোধহয় এই আপেক্ষিকতার পক্ষেই কথা বলে। নির্দিষ্ট সময়ের কবিদের নির্দিষ্ট প্রস্তুতি থাকতেই হয়। এক্ষেত্রে বিনয়-উৎপল এবং শক্তির কথা কিংবা গত নব্বইয়ে ছন্দ নিয়ে, পোস্টমডার্নিজম বা নানান দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একদল কবিকে নানান প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে যেতে চাওয়ার কথা উল্লেখ করা যায়। এদের লেখার মূল্য কতটা, এই প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্ন অবান্তর কেননা, মূল বিষয় হলো প্রত্যেক কালের কবিরাই নিজস্ব বিবেচনা মতো কবিতায় কিছু বিষয় বাদ দিয়ে কিছু বিষয় নিয়ে আসতে চাইছিলেন। মানে তারা ‘কী লিখবো,কী লিখবো না’ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রথমত চেষ্টা করেছিলেন। যাকে বলছি প্রবণতা, তা এই সিলেকশন, ডি-সিলেকশন এর মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে।
মিথ, আশি বা নব্বই এর কবিতায় খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। কবিতায় মিথ কে এনে নানা রকমের কাজ করার চেষ্টা হয়েছে কিন্তু আমার মনে হয়, মিথ, ষাট এর পরে বিশ্ব কবিতায় এবং গত দুই দশকের কবিতায় তেমন কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি এবং কবিরাও এই মিথকে দিয়ে আমাদেরকে নতুন কোনো পথে চালিত করতে পারেনি। এটা অবশ্য এলিয়টের ট্র্যাডিশন এ্যাণ্ড ইনডিভিজুয়্যাল ট্যালেন্ট- প্রবন্ধের ও উত্তর উপনিবশবাদের একটা ক্লিশে ফলাফল ও হতে পারে। সবচেয়ে বড় কারণ বোধহয় এই যে, কবিরা মনে করেছিলেন, মিথকে কবিতায় নিয়ে আসাটা তাদের দায়িত্বের পর্যায়ে পড়ে, যেমন দায়িত্বের পর্যায়ের পড়ে কবিতায় ছন্দ রাখা। কিন্তু অনেক কথার মাঝে কবিকে কখনওই একথা ভুলে গেলে চলে না যে, কোনো কিছুই তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। কোনো বক্তব্য ও নেই তার। কেননা, তিনি একজন ইন্টারপ্রেটার। বস্তু ও অবস্তু জগতের বহু কোড এসে তার মাঝ দিয়ে শুধু আরেক ধরনের কোড হয়ে বের হয়ে যায়; প্রবেশের করে কাব্যভাষার সিস্টেমের মধ্যে, যা অভিঘাতী হলে স্বতশ্চলভাবে জড়ো হয় কবিতার ইউনিফায়েড স্ট্রাকচারে।
মজার ব্যাপার হলো যাকে আমরা বলি আবহমান বাংলা কবিতা, তা কিন্তু মূলে এ ইউনিফায়েড স্ট্র্যাকচারই, যাকে আবার প্রতিটি মুহূর্তে নতুন কবিতার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে তার পুরানো আদল ধরে টিকে থাকতে হয় বা নিজেকেই বদলে নিতে হয়। ভাষার যে আবহমান গঠন তার মাঝে দাড়িয়েই নতুন কবিকে কবিতা লিখতে হয়। এখন প্রশ্ন হলো আমাদের সময়ের কবিতা এই চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবেলা করছে বা করতে পারছে না।
(আগামী পর্বে সমাপ্য)
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০০৮ দুপুর ১:৪৪