এক ধরনের অনির্দিষ্টতা সম্পন্ন, অসঙ্গতিজ্ঞাপক ও চেতনাচূর্ণের এক বহুবর্ণিল ও বহুরৈখিক কোলাজকে বলা যায় শূন্যদশকের কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য- যাকে নির্দিষ্টতাজ্ঞাপক কোনো একটি শব্দে বেধে ফেলা কঠিন। একটি নির্দিষ্ট সময়ের কবিতার কথা বলতে গিয়ে আমরা সে সময়ের কবিতার বিষয়ে এক বা একাধিক সাধারনীকরণের ফাদে পড়ি। এই ফাদ আবার তরলীকরনের দিকেও টেনে নেয়। ঐ যে লিখলাম ‘অনির্দিষ্টতা সম্পন্ন, অসঙ্গতিজ্ঞাপক ও চেতনাচূর্ণের এক বহুবর্ণিল ও বহুরৈখিক কোলাজকে বলা যায় শূন্যদশকের কবিতা’ তা ও কিন্তু এই ফাঁদের অন্তর্ভূক্ত থেকেই যায়। কবিতায় অনির্দিষ্টতা ও অসঙ্গতি শূণ্যদশকের কবিরা আমদানী করেননি- বিশেষত্ব দিয়েছেন মাত্র; তারা বুঝতে পেরেছেন আধূনিক কবিতার যে শৈলী গত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে যার মূল কাজ একটি কেন্দ্রীয় ভাববস্তু উৎপাদন এবং তাকে অনুসরন করে কবিতাকে স্ফীত করা বা চালিয়ে নেয়া কিংবা মুখস্ত ছন্দের বাতাবরণে গভীরতাশ্রায়ী কিংবা গভীরতাহীন কবিতা সৃষ্টি করা, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এটুকু আবিষ্কার করতে খুব বেশী সৃষ্টিশীল হবার দরকার নেই, পাঠের কিয়ৎ গভীরতা এবং গত পঞ্চাশ বছরের কবিতার দিকে একটু মনোযোগ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু এসময়ের কবিরা তাহলে কীভাবে বিষয়গুলো মোকাবেলা করবার চেষ্টা করছেন বা করছেন না, সে বিষয়ে নজর দিলেই শূণ্য দশকের কবিতার সম্পূর্ণ বাস্তবতাটা পাঠকের কাছে স্পষ্ট হবার একটা উপায় থাকে।
আমাদের ইতিহাস-চেতনা নিয়ে অনেককে প্রশ্ন করতে দেখা যায়। এ বিষয়টির আগে একটা উত্তর দেয়ার চেষ্টা করা দরকার বলে আমি মনে করি। লক্ষ্য করেছি, ইতিহাসচেতনা নিয়ে যারা কথা বলেন, তারা হরহামেশাই লেখাপত্রে বিভিন্ন ঘটনার/প্রতীকের উদ্ধৃতি দেয়াকে ইতিহাসচেতনা বলে দাবি করতে চান, তারা দুটি কথা খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যান। প্রথমত: ইতিহাস ক্ষমতার ছত্রছায়ায় নির্মিত হয় এবং দ্বিতীয়ত: কোনো কবিকে তিনি কেন ইতিহাস-চেতনা নিয়ে কাজ করেন না এটা জিজ্ঞাসা করা এক ধরনের মূর্খতার পর্যায়ে পড়ে। এমন মূর্খতাই হয়, যখন কোনও কালকে জিজ্ঞাসা করা হয় সেই সময়ের কবিতায় ইতিহাসচেতনা কোথায়! কেননা, কবিতায় কবি কী লিখবেন না লিখবেন তা একান্ত তার ব্যাক্তিগত বিষয় এবং এক্ষেত্রে তার মাঝে কী কী নেই তা কোনো প্রশ্ন হতে পারে না। শূণ্য দশকেরই কিছু কবি আছেন, যারা ইতিহাস নিয়ে কাজ করতে চান এবং তাদের এই চাওয়াটাকে আমাদের সবারই উচিৎ প্রকাশ্যে হলেও সম্মান করা। আর অধিকাংশ কবির কথাই যদি ধরি, তাদের মাঝে ইতিহাসচেতনা খুজতে গেলে আমরা তা পাবো প্রবলভাবে, কেননা, আমরা জানি ইতিহাসচেতনার সবচেয়ে বড় কথা হলো মানুষ তার নিজের কাছেই পরাজিত। এই পরাজিত মানুষের অভিজ্ঞতা বিভিন্ন চূর্ণের মধ্যে দিয়ে জড়ো হচ্ছে আমাদের কবিতায়,যার ইংগিত আমি এই গদ্যের প্রথম লাইনেই দিয়েছি।
কোনো ধরনের যুক্তি উৎপাদন করবে না কবিতা এবং প্রশ্রয় দেবেনা এমন কোনো যুক্তিকে যা পাঠককে যুক্তির সেই প্রচলিত গণ্ডিতেই আটকে রাখে। এর ভাষিক অসঙ্গতি, বয়ন আমাদের এমন এক বোধগম্যতার দিকে নিয়ে যাবে, যাতে আমরা আবিষ্কার করতে পারি এক নতুন ভাষাজগতের; আর কবির ভাষাজগৎ বদলে যাওয়ার মানেই তিনি যে তার কবিতায় নতুন কোনো আলোড়নের সন্ধান করছেন, সন্ধান করছেন নতুন কোনো সম্ভাবনার। এক্ষেত্রে, প্রশ্ন আসতে পারে যে অসঙ্গতির কথা আমরা বলছি বা বলছি পংক্তির আপাত অসংলগ্নতার কথা- তার পরিসীমা কতটুকু,বা এই অসংলগ্নতার কথা বলে আমরা কবিদেরকে আরো দূর্বল কবিতা লেখার সুযোগ করে দিচ্ছি কীনা। একটু আগেই লিখেছিলাম যে, কোনও একটি বিষয়কে কেন্দ্রীয় থিম ধরে কবিতা নির্মাণ আমাদের কাছে ক্লিশে লাগছে। এই যে কবিতায় কেন্দ্রীয় থিমের শাসন,একে কেন্দ্র করেই পুরো কবিতার আকৃতি দাঁড়ানো, আমরা আমাদের যুক্তিবিশ্বের সাথে এধরনের কবিতার কোনও সামঞ্জস্য পাচ্ছি না। কেননা, নিজ অভিজ্ঞতায় আমরা দেখছি- যেভাবে কেন্দ্রীয় থিম গোটা একটি কবিতাকে নিয়ন্ত্রন করছে সেভাবে কেন্দ্রীয় কোনো যুক্তি আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণে একেবারেই অক্ষম। নিজ প্রয়োজনেই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আমরা ভিন্ন ভিন্ন যুক্তির শরণাপন্ন হচ্ছি। কোনো সমস্যার এখন আর একরৈখিক কোনো সমাধান আমাদের হাতে নেই। আমরা যারা এতটুকু, খুব সামান্য হলেও অনুধাবন করতে পারছি- তাদের পক্ষে কী করে কেন্দ্রীয় কোনো থিমকে সামনে রেখে কবিতা লেখা সম্ভব- তা আমার বোধগম্য নয়।
এতটুকু লেখার পর আমি অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবেই আশা করবো,কেন আপাত অসঙ্গতির কথা বলা হচ্ছে এবং তার পরিসীমা কতদূর তা আমাদের অনুধাবনে কষ্ট হবে না। কিন্তু এর সাথে এই প্রশ্নও থেকে যায় যে, এই পথে সঙ্গতিহীন পংক্তি রচনা আমাদের কতটুকু সহায়তা করবে বা আমাদের পংক্তিগুলোর মাঝে অন্তর্গত দূরত্ব কতটুকু হবে । আমার মনে হয়, এটাই এখনকার কবিদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা যাকে আমরা অসঙ্গতি বলছি, তা মূলত পরিচিত যুক্তিবিশ্বের বাইরে নতুন এক যুক্তিবিশ্ব তৈরী করার প্রভাস্বর। পার্থক্য হলো একে বুঝতে অভিজ্ঞতা ও কল্পনা, স্বপ্ন ও বিস্মৃতির সহায়তা লাগে। এদের রচনা করাও বেশ আয়াসসাধ্য। কেননা, যে শৃংখল স্বপ্ন ও আকাঙ্খাপূরণের, তাকে একদম নতুনভাবে, প্রায় প্রতিটি কবিতায় তৈরী করে নিতে হয়। এখানে কোনো ক্লিশে বস্তু পাঠকের হাতে তুলে দেয়ার সুযোগ কবির কাছে নেই বললেই চলে। আর তাই, স্বার্থক কবিতায় অসঙ্গতিপূর্ণ পংক্তি রচনা, সঙ্গতিপূর্ণ পংক্তি রচনার চেয়ে বেশি কষ্টকর ও শক্তিমত্তার পরিচায়ক। এই অসঙ্গতির আরেক পিঠকে বলা যায় বহুরৈখিকতা। বহুরৈখিকতাকে নতুন করে ব্যাখ্যা করবার কিছুই নেই । কিন্তু বহুরৈখিকতা যেমন একই পাঠবস্তুতে নানাধরনের জগতের দিকে নির্দেশ করে তেমনি অসঙ্গতি সেই জগতের শরীর থেকে খুলে নেয় যুক্তির শেকল।
স্বার্থক যে কোনো শিল্পই মূলে ও মর্মে হবে অন্তর্ঘাতী- এই কথাটা এখনও ফুরিয়ে যায়নি। কোনো কিছুকে শিকার করবে না সে, এবং তার প্রতিটি শব্দই তার কাছে হয়ে উঠবে আয়ুধ। এই অন্তর্ঘাত, তার জ্বলোচ্ছ্বাসসহ আমাদের উপলদ্ধির দেয়ালে আছড়ে পড়ে। এর ফলেই আমরা নতুন কিছু অনুধাবন করতে শিখি। এখানে একটি কথা লেখা আবশ্যক যে, নতুন কবিতা মানে নতুনদের লেখা কবিতা নয় বরং নতুন/পুরাতন যে কারও লেখা হোক না কেন, সেটি পাঠকের অভ্যাস ও রূচিকে এক সূক্ষ্ম অর্ন্তঘাতের মুখোমুখি করাবে। কিন্তু যখন তা লেখা হতে থাকবে, কবি মানসে এই অর্ন্তঘাত প্রবণতা বইবে অন্তশীলভাবে এবং কবিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে তার কবিতাটি লেখার দিকে। পরে, কবিতাই কবির বাকি কাজটুকু করে দেবে।
কবিতাকে আমরা কি তার পুরো অবয়ব থেকেই দেখবো নাকি দেখবো পংক্তি থেকে পংক্তি বিচ্ছিন্ন করে। মানে, কবিতায় আমরা এখন আর কোনোধরনের টোট্যালটিকে খুজে বেড়াব কীনা। এক্ষেত্রে প্রথম বিষয় হলো, টোট্যালিটিকে তখনই খুজব যখন পুরো কবিতাটা একটা একরৈখিক ধ্যানধারনা বহন করে যাবে। বহুরৈখিকতার কাছে টোটালিটি অবশ্যই নগন্য হতে পারে না বরং বহুরৈখিক কবিতার টোট্যালিটি কবিকে একসাথে কয়েকটি জগৎ নির্মান করতে সাহায্য করে থাকে। তাই বহুরৈখিক কবিতায় পংক্তিগলোকে এমনকি কখনও কখনও কখনও শব্দগুলোও আরেক ধরনের টোটালিটি বহন করতে পারে, বহন করতে পারে তার আশপাশের শব্দগুলোর জন্য আরেকধরনের বিপর্যাস।
ছন্দ ও কবিতার অন্যান্য অনুষঙ্গ নিয়ে কিছুই বিশেষভাবে লেখার কোনো প্রয়োজন নেই । আমারা জানি, কবির জীবনযাপনের ভেতর থেকে গড়ে ওঠে যে ছন্দ, তাকে কবিতায় রূপ দিতে গেলে ছন্দ কোনো শৃংখল হয়ে ওঠেনা এবং কবিতার ধ্বনিশৃংখলা থেকে তাকে আলাদাও করা যায় না। আর যে নতুন কবিতার দিকে আমরা যেতে চাইছি, তাতে যে কোনো অনুষঙ্গই নতুন হয়ে উঠে আসতে বাধ্য, নতুবা নতুন কবিতা বলে তা গৃহিত হয়ে না ওঠার সম্ভাবনাই বেশি। যেমন: নতুন কবিতা বলে আমরা গ্রহণ করিনি ব্রাত্য রাইসু সহ অনেকের কবিতাকে কেননা, আমরা জানি এগুলো ঈশ্বরগুপ্ত বা বাংলা কবিতার নাবালক সময়ে রচিত কবিতাগুলো থেকে তাদের কবিতাগুলো খুব বেশি একটা দূরে নয়। আর বাংলা কবিতা আজ এমন এক স্থানাংকে দাঁড়িয়ে, যেখান থেকে একে ‘বাচাবার’ চেষ্টা করা বাতুলতামাত্র ও হাস্যকর। বাংলা কবিতা এখন শুধু সেই অগ্রসরমানতার দিকে যেতে চায়, যেখান থেকে সে সরাসরি তার ঘাড় ঘুরিয়ে বিশ্বকবিতায় বহমান অপরাপর স্রোতের সাথে নিজে লীন হতে পারে। এই সময়, পিছিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ বা সম্ভাবনাকে খোঁজা মানে এক ধরনের মিডিওক্রিসি, নিজেদের সম্ভাবনা, নিজেদের দূর্বল শক্তিমত্তাকে আনমনে স্বীকার করে যাওয়া।
শূন্যদশক এসব প্রবণতা-উৎপাদন থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত এবং এই সময়ের কবিদের মধ্যে খুব কম কবিই এধরনের ফাদে পড়েছেন বলে আমার ধারনা।
(প্রথম পর্ব সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০০৮ সকাল ১১:০২