বেশি দিনের কথা নয়। এইতো সে দিন। আমি হয়তো টু থ্রিতে আর মেজো ভাই সিক্স সেভেনে। আমরা যেমন ছিলাম একে অপরের শত্রু তেমনি বন্ধু। এক টেবিলে হ্যারিকেনের আলোতে পড়তাম। টেবিলের এক পাশে আমি অন্য পাশে ও। ও চাইতো হ্যারিকেনের হাতল টা আমার দিকে থাকুক আমি চাইতাম ওর দিকে থাকুক। লাগতো তুমুল ঝগড়া। বেঁধে যেত মারামারি। ভাংত হ্যারিকেনের চিকনি। মা এসে দিতো রাম ধোলাই। এক সাথে ঘুমাতাম। ও গল্প বলতো আর আমি মন দিয়ে শুনতাম। শুনতে শুনতে যখন ঘুম এসে যেত তখন হুম হুম করা বন্ধ করে দিতাম। তখনই রেগে গিয়ে থাপ্পড় শুরু করে দিতো। ওর ছিল ভীষণ রাগ।
সকাল হলে মা দুই ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিতো আমপারা। দুই ভাইয়ের একই রঙের দুটো খয়েরি পাঞ্জাবি ছিল। পাঁচ কলির টুপি পড়ে মক্তবে চলে যেতাম। কোন কোন দিন ফাঁকি দিতাম। টুপি পাঞ্জাবি রেখে আমরা চলে যেতাম কোলায় (বিলে)। কোলা ভরা আউশ ধান। আউশ ধানের মধ্যে মধ্যে শাপলা ফুটে থাকতো। আমরা শাপলা তুলতে যেতাম। শালুক ফল খেতাম। সব বদমাশির পরিচালক ছিল ও। স্কুল পালিয়ে অন্যের বাড়ির জাম্বুরা ছিরে ফুটবল খেলা। কোলায় রোদে পুরে ট্রাক্টরের পিছনে মাছ ধরা। অন্যের কাদি ধরা কলা গাছ কেটে ভেলা ভানানো। কারো নৌকা ঘাট থেকে চুরি করে নিয়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা। হিন্দু পাড়া মরা পোরানো দেখা। দিন ভর মূর্তি গড়া দেখা। কীর্তনের নিত্য অতিথি। ইঁদুর মেরে জানাজা পড়িয়ে মাটি দেয়া। পুরানো বই কেটে টাকা বানিয়ে ব্যাবসা করা। সব কিছু ওর নির্দেশে হতো। মা মাইর দিলে ওর কিছু মনে হতনা। আমি ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতাম। মা আমাদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে এক সময় লজিন মাষ্টার রাখলো।
আমদের দুটো গাভী ছিল। একটা সাদা আর একটা লাল। লাল টা আমার সাদাটা ওর। ওর সাথে যখন পেরে উঠতাম না তখনই ওর গরুর সাথে পারতাম। বড় একটা লাঠি নিয়ে পাছায় শপাং শপাং বসিয়ে দিতাম। ও ও আমার মত। আমার সাথে খুব রাগ করে আমার লাল গরুটার উপর ঝারত। সে যে কি কাণ্ড। ঝগড়া মারামারি লেগেই থাকতো। এক সময় মা সহ্য করতে না পেরে গাভী দুটো দিলো বিক্রি করে। হায়রে ওর কান্না। আমিও কেঁদেছিলাম।
একদিন মক্তবে আমাকে এক ছেলে মেরেছে। ও কার কাছে শুনে দৌড়ে ছুটে এলো। হায়রে সে কি রণক্ষেত্র। ওতো ছেলেটার নাক ফাটিয়ে রক্ত বের করে দিলো। ও-ই আমার ভালো বন্ধু ছিল। কিছু একটা হলে ভাগ করে কারাকারি করে খেতাম। ও মাঝে মাঝে দিতনা। আমি ঠিক ওর জন্য রেখে দিতাম।
সে সব দিন গুলো এখন আর নেই। আমরা বড় হয়ে গেছি। ওর মনে পড়ে কিনা আমি জানিনা। আমার খুব ভীষণ মনে পড়ে। আমরা এখনো একসাথে থাকি। ঢাকায় ওর সংসারে থাকি আর পড়াশুনা করি। ও এখন রাত দিন খুব ব্যাস্ত। চাকরি করে, বিয়ে করেছে বাচ্চা আছে। (প্রেম করে বিয়ে)। আর রাগটাও খুব আগের মত নেই। কেমন একটা গুরু গম্বির ভাব ধরেছে।