হঠাৎই পোড়া গন্ধ পাওয়া গেল। সেই সাথে মানুষের হট্টগোল, দাপাদাপি। কৌতুহলের বশেই এগিয়ে গেলাম ব্যাপার বোঝার জন্য। ব্যাপার বড় ভয়াবহ। রাস্তার ওপারের গার্মেন্টসটায় আগুন ধরে গেছে।
গার্মেন্টসটায় ফায়ার এস্কেপ আছে ঠিকই, তবে সেখান দিয়ে কাউকে নামতে দেখলাম না। এস্কেপের দরজাগুলো বন্ধ। সবাই হুড়োহুড়ি করছে মূল সিঁড়িতে। কলাপসিবল গেট খোলাই ছিল। বেরুবার পথটা খুবই সংকীর্ণ। ঠেলাঠেলি করে বেরুতে চাইছে সবাই। কিন্তু বেরুতে পারছে না। আতংকিত মানুষগুলো চিত্কার করছে তারস্বরে। রক্ত হিম করা চিত্কার। মৃত্যুভয়ে আতংকিত মানুষের অপার্থিব আর্তনাদ।
গেটটায় ভিড় একটু একটু করে কমছে। ঠেলাঠেলিও কমেছে খানিকটা। এমন সময় দেখা গেল দুজন লোক বস্তার মত কি যেন নামাচ্ছে সিঁড়ি দিয়ে। খটকা লাগল। যেখানে নিজেদের জীবন বাঁচাতে সবাই ব্যস্ত সেখানে কি এমন মূল্যবান জিনিস নামাচ্ছে বস্তায় করে? এগিয়ে গেলাম আরেকটু।
ওটা বস্তা নয়। একটা মানুষ। ঠিক যেন মানুষও নয়, যেন সেদ্ধ একটা মাংসপিন্ড। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত ঝলসানো। ভয়ংকর দৃশ্যটা দেখে আশেপাশের মানুষগুলো চিত্কার করতেও ভুলে গেল। লোকটা তখনও বেঁচে ছিল। আমার মুখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে এলো, "লোকটাকে হাসপাতালে নেয়া দরকার।" সম্বিত্ ফিরে পেল লোকজন। তাড়াহুড়ো করে ডাকা হলো একটা সি.এন.জি. স্কুটার। আমরা তিনজন মিলে লোকটাকে সি.এন.জি. স্কুটারে ওঠাচ্ছি। হাতে সেদ্ধ আলুর খোসার মত উঠে আসছে পোড়া চামড়া। গোলাপী গোলাপী মাংস দেখতে পাচ্ছি তার নিচে। সেই সাথে উত্কুট পোড়া গন্ধ। মানুষের চামড়া পোড়ার গন্ধ এত বিশ্রী?!! কোনমতে টেনে হিঁচড়ে ওঠালাম লোকটাকে। ছেড়ে দিল স্কুটার। তীর বেগে ছুটতে লাগল সেটা হাসপাতালের দিকে।
স্কুটারের চাকা ঘুরছে। সেই সাথে ঘুরছে আশার চাকা। যমের সাথে দড়ি টানছি আমরা তিনজন। নিজেদের জন্য নয়। নিতান্ত অপরিচিত একটা মানুষের জন্য। যে কিনা আজ সকাল পর্যন্ত দিব্যি হেঁটে চলে বেড়িয়েছে। যাকে কিনা আগে কোনদিন চোখেও দেখি নি। তবু তাকে বাঁচাতেই হবে। স্রেফ মানুষ বলেই। আমারই মত দু'পেয়ে একটা মানুষ। অতি দুঃখেও আমার কেমন হাসি পাচ্ছে। সেদ্ধ করা মানুষ কি কখনো বাঁচে? তবু হাল ছাড়ছি না। বিকাল ৫ টার পর রাস্তায় ভয়াবহ জ্যাম। সেই জ্যামে বসে আছি আমরা তিনজন। একটা দলা পাকানো পোড়া মাংসের টুকরো কোলে নিয়ে।
সি.এন.জি.-র চাকা বার বার থেমে যাচ্ছে। সেইসাথে ধীরে ধীরে কমে আসছে একটা জীবন প্রদীপের আলো। কখন যে সেটা নিভে গেল টেরও পেলাম না।