রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) সংস্কৃতি চর্চার উর্বর ভূমি হিসাবে ঐতিহ্য থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদাসীনতায় এখন সেই সংস্কৃতিক ইতিহাস বিলীন হওয়ার পথে। বিভাগগুলোর নবীনবরণ ও বিদায় এবং হলগুলোতে বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ছাড়া সারা বছর তেমন কোন কর্মকা-ই লক্ষ্য যায় না। এছাড়া হাতেগোনা কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন নিজ উদ্যোগে তাদের কর্মসূচি পালন করলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের তেমন সাড়া মেলেনা। পর্যাপ্ত সাংস্কৃতিক চর্চার অভাবে অনেক শিক্ষার্থী অনৈতিক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ঠ অনেকে মনে করেন।
সাংস্কৃতিক সংগঠন সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিরা বলছেন, প্রশাসন সাংস্কৃতিক সংগঠন গুলোর সহযোগিতা না করা, রাজনৈতিক মতদর্শভিন্ন অন্য সাংস্কৃতিক সংগঠন গুলোকে কোন অনুষ্ঠান করতে না দেওয়ার কারণে সংস্কৃতিক চর্চার ঐতিহ্য হারাচ্ছে। বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা এবং বিকল্পের কাজে বাধা দেওয়া হচ্ছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা বলছেন, সংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতি সংগঠনগুলোকে পর্যপ্ত সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিমালায় একাডেমিক শিক্ষার সঙ্গে সাংস্কৃতিক কর্মকা-কে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে উল্লেখ করা হলেও বিভাগ গুলো এ বিষয়ে এক প্রকার অনীহায় লক্ষ্যে করা যায়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় উদাসীন হলেও কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠনকে এ ক্ষেত্রে তৎপরতা লক্ষ্যে করা যায়। তাদের এই তৎপরতা নাম মাত্র বলা চলে। অন্তত এক দশক আগে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যতটা সরব ছিল, তার তুলনায় এখন মোটেও আশাবাদী হওয়ার মত নয়।
অতীত ইতিহাস
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ, বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন, বিভিন্ন বিভাগ ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো সারা বছরই সংস্কৃতিক আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণকে আলোকিত করেছে। এক সময় সুন্দরম নামে ঘরোয়া অনুষ্ঠানে গান করতেন, প্রখ্যাত গায়ক মো. রফিকুল আলম, নারগিস পারভীন, দীপা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ আরো অনেকে। এছাড়া নাট্যকর হাবিবুর রহমান, গিয়াসউদ্দীন সেলিম প্রমুখ। তাঁরা প্রত্যেকেই এখন জাতীয় ও আন্তার্জতিক পরিম-লে খ্যাত।
১৯৭০ সালে ছাত্রলীগের আয়োজনে মন্নুজান হলে রবি ঠাকুরের ‘শ্যামা’ ‘৭২ এ ‘শামমোচন’ ৭৬-৭৭ এ ‘বসন্ত’ ‘তাসের দেশ’। রাকসুর উদ্দ্যেগে ‘দিনে দিনে বহু’ ১৯৭৮ সালে জুবেরী ভবনে; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের আয়োজনে ‘তিন পয়সার পালা’সহ বিভিন্ন সময় বহু নাটক আভিনীত হয়েছে; আয়োজিত হয়েছে নানা ধরণের হয়েছে সাংস্কৃতিক আনুষ্ঠান। এই সমস্ত আয়োজন সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সমৃদ্ধ ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেয়।
এদিকে সংস্কৃতিক ধারকে এগিয়ে নিতে আশির দশকে বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন যাত্রা শুরু করে। ১৯৭৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ‘অনুশীলন’ নাট্যদল আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৮১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম পথনাটক ‘যদি আমরা সবাই’ অনুশীলনের প্রযোজনায় অভিনীত হয়। সংগঠনটি শত প্রতিকূলতার মধ্যে আজও নাট্যচর্চা অব্যহত রেখেছে এবং দেশে বিদেশে নাটক প্রদর্শন করে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছে। সংস্কৃতিক চর্চাকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিতে ১৯৮১ সালে সমকাল নাট্যচক্র ও আবৃত্তি সংগঠন স্বনন, ১৯৮৩ সালে বিভিন্ন গণশিল্পী সংস্থাসহ বিভিন্ন সংগঠনের আবির্ভাব ঘটে। ১৯৮৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয় সব সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক জোট’ যা এখন ‘কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোট’ নামে পরিচিত। এসকল সংগঠনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিয়ত কোন না কোন সাংস্কৃতিক কর্মকা- পরিচালিত হত। এভাবে সংস্কৃতি চর্চার সরব হওয়ার কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের বিভিন্ন মহল ও সাধারণ মানুষের কাছে দৃষ্টি লাভ করতে সক্ষম হয়। সংস্কৃতি চর্চায় নিবেদিত থাকার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় এক সময় বহু গুনী শিল্পী ও সাংস্কৃতিককর্মীর জন্ম দেয়। যারা আজকে জাতীয় ও আন্তার্জাতিক পরিম-লে কৃতিত্তের সাক্ষর রাখছে।
বর্তমান সাংস্কৃতিক কর্মকা-
কিন্তু সেই সাংস্কৃতিক কর্মকা- শুধু ইতিহাসেই সমীবদ্ধ। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি সংগঠনের সাংস্কৃতিক কর্মকা- চোখে পড়ে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগ থাকেলও, তাদের কর্মসূচি চোখে পড়ার মত নয়। আবার সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে সহযোগিতা না করার অভিযোগও পাওয়া যায়। এছাড়া টিএসসিসি কার্যকর ও স্থান স্বল্পতার কারণে এক স্থানে একাধিক সংগঠন স্বাভাবিক কর্মকা- পরিচালনা ব্যাহত হচ্ছে।
সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিগণ মনে করেন, রাকসু, টিএসসি, ছাত্রসংগঠনগুলো সহ অবস্থান, নিরাপত্তহীনতা ও দেশের সার্বিক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে সাংস্কৃতিক চর্চা আগের সেই অবস্থান নেই।
সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কর্মসূচিতে নেই শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ
বিশ্ববিদ্যালয় হাতেগুনা যে সমস্ত সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে, তাদের কর্মসূচিত সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নেই। ক্যম্পাসে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কর্মসূচিতে সরেজমিনে দেখা গেছে, সাংস্কৃতিক ব্যাক্তি ব্যাতীত সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোন উপস্থিতিই নেই। অনেকে মনে করনে, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ভালো মানের কর্মসূচি করতে না পারায়, সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের থেকে বিমুখ হয়ে যাচ্ছে। তবে সংগঠনগুলোর এ কথা মানতে নারাজ, তারা বলেন প্রশাসনের সহযোগিতা না করার কারণে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
প্রশাসনের সহযোগিতা না করার অভিযোগ
এদিকে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর দাবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে থেকে পর্যপ্ত সহযোগিতা না পাওয়া। রাজনৈতিক কর্মকা-ে নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের কর্মসূচিতে বাধা প্রদান করে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি বাসুদেব বলেন, প্রগতিশীল চেতনার প্রশাসন হওয়া সত্ত্বেও আমরা প্রশাসনের কাছ থেকে আশানুরুপ সাড়া পাই না। এছড়া প্রশাসন মাঝে মধ্যে প্রোগ্রম করতে বাধাঁ প্রদানও করে থাকে।
সাংস্কৃতিক চর্চার বিরুপ প্রভাবের কারণ, ক্যাাম্পাসে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সহঅবস্থান না থাকা। সরকার দলীয় ভিন্ন মতের সাংস্কৃতিক সংগঠনকে কর্মসূচিতে পালন করতে না দেওয়া। প্রশাসনের পছন্দের বাহিরে অন্য সংগঠনগুলোকে মুক্ত চর্চার কেন্দ্র ক্যম্পাসে তাদের সংস্কৃতিক কর্মকা- করতে বাঁধা দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন জাতীয়তাবাদী মূল্যেবোধে বিশ্বাসী শিক্ষকরা।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয়তাবাদী সমাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস) এর সদস্য সচিব ডি এম নাসীর উদ্দিন বলেন, ‘প্রশাসনের এক রোখা নীতির কারণে আমাদের কর্মকা- করতে পারছি না। প্রশাসনের এই পথ পরিহার করতে হবে। একই ভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জাসাসকে একটি রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন হিসাবে না দেখে সাংস্কৃতি সংগঠন হিসাবে দেখার অহ্বান করছি। প্রশাসন যাদি আমাদেরকে স্বাভাবিক ভাবে কাজ করতে দেয়, তাহলে একদিন আমরা রাবি ক্যম্পাসের সাংস্কৃতিক চর্চার হারানো গৌরাব ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হব’।
ক্যম্পাসে বিধি নিষেধ
এছাড়া ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের উপর প্রশাসনের বিধি নিষেধ এর কারণে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কাজ ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পরে মেয়েদের হলের বাহিরে অবস্থান করা নিষেধ থাকায় তারা সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক কনিকা গোপ বলেন, ‘একটা মেয়েকে যদি সন্ধ্যার মধ্যে যদি হলে প্রবেশ করতে হয়। তাহলে সারাদিন ক্লাস করা, সেই মেয়েটি কখন সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবে’?
টিএসসি কর্যকর ও মহড়া কক্ষ না থাকা
সাংস্কৃতিক সংগঠন গুলোর দাবি টিএসসি কর্যকর না থাকার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক চর্চা বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। যদি বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি কর্যকর যায়, সেক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক কর্মকা- আরো বেগবান করা সম্ভব বলে মনে করেন সংগঠন গুলোর নেতৃবৃন্দ।
এছাড়া স্থানস্বল্পতার কারণে সংগঠনগুলো তারা নিজেদের মত করে কর্মকা- করতে ব্যার্থ হয়। সংগঠনগুলোর নিজেদের মহড়া কক্ষ না থাকায় এক স্থানে একধিক সংগঠনগুলো অবস্থান করতে হয়। এদিকে কিছু সংগঠন বিভিন্ন একাডেমিক ভবনে তাদের কার্যক্রম করতে গেলে, ক্লাস বা অন্য কোন কারণে মহড়া করতে পারে না।
এব্যাপারে সমকাল নট্যচক্রের সভাপতি সাজু সরদার বলেন, টিএসসি কার্যকর থাকলে আমাদের সাংস্কৃতিক সংগঠন গুলোর কাজ করতে সুবিধা হত। এছাড়া প্রশাসনের কাছে প্রত্যেক সংগঠনের জন্য আলাদা করে মহড়া কক্ষ নির্মাণের দাবি জানাচ্ছি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বক্তব্য
সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর প্রশাসনের বিরুদ্ধে সহযোগিতা না করার অভিযোগের কথা অস্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ছাত্রউপদেষ্টা প্রফেসর ড. ছাদেকুল আরেফিন মাতিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সাংস্কৃতিক সংগঠনকে নানা ভাবে সাহিত করে থাকে। অতীতের যে কোন প্রশাসনের চেয়ে আমরা সংগঠনগুলোর সার্বিক সহযোগিতাও করে থাকি।