মনে পড়ে সেই দিনটির কথা, টেলিভিশনের সামনে অধীর আগ্রহে বসে আছি কসাই কাদের মোল্লার রায়ের ঘোষণা শুনার জন্য। সকাল থেকে অপেক্ষা করছিলাম, একসময় অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। হঠাৎ শুনলাম রায় ঘোষণা হয়েছে....অত:পর আর কী! যে রায় হয়েছে তা আর লিখতেও ইচ্ছা করছে না। ক্ষোভে আর হতাশায় নিজেকে আটকে রাখতে না পেরে তাৎক্ষণিক ফেইসবুকে একটি স্ট্যাটাস আপডেট করলাম।
সেদিন শুধু আমি নয়, সারা বাংলাদেশের সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক যারা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে, তারাও ক্ষোভ আর হতাশা প্রকাশ করেছেন যে যার অবস্থানে থেকে। কারোটা মিডিয়ার মাধ্যমে শুনতে পেয়েছি কারোটা পায়নি।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর দেশে বিভিন্ন সময় অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর রাজাকারদের উৎপাত লাখো মানুষের ভিতর চাপা ক্ষোভ আর হতাশার জন্ম দিয়েছে। এই রায়ের পর মানুষ সেই চাপা দু:খ আর ধরে রাখতে না পেরে রাজপথে নেমে এসেছে।
শুরু হয় আন্দোলন। রাজধানী ঢাকার শাহবাগ চত্বরে হাজার হাজার মানুষ মোমবাতি জ্বালিয়ে, প্রতিবাদী গান ধরে, স্লোগানে মুখরিত করে এবং প্লাকার্ড, পোস্টার, ফেস্টুন দিয়ে নানাভাবে তাদের তীব্র ক্ষোভ আর হতাশাকে একটি ভিন্নধর্মী শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে রূপ দেয়। মাসটি ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি। এর মূল সংগঠক ব্লগার এ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নেটওর্য়াকের আহ্বায়ক ডা: ইমরান এইচ সরকার। আন্দলনটির অন্যতম নারী সংগঠক; যে পরবর্তীকালে স্লোগান কন্যা নামে খ্যাতি পেয়েছেন দেশে এবং বিদেশে, তার নাম লাকী আক্তার।
এই আন্দোলনে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি ছাড়া সরকার থেকে শুরু করে দেশের সকল আমজনতা, প্রবীণ, নবীন, শিশু, মিডিয়া জগতের তারকা, বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, দেশের বাইরে অবস্থানরত প্রবাসী বাঙালী তাদের সংহতি প্রকাশ করেছেন ।
আন্দোলনের কিছুদিনের মধ্যেই এর অন্যতম সংগঠক ব্লগার রাজীব হায়দারকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তার বাসার সামনে। সন্দেহের তালিকায় থাকে রাজাকার জামায়াত-শিবির। এবং এর কিছুদিন পর সন্দেহভাজনরা ধরাও পরে পুলিশের হাতে। তারা স্বীকারও করে যে শিবিরের একজনের উষ্কানীতেই তারা খুন করেছে রাজীবকে। এছাড়াও এই আন্দোলের সংগঠকদের মধ্যে আরো কয়েকজন অসুস্থ হয়ে মারা যান।
এছাড়াও এই আন্দোলন নিয়ে দেশের কয়েকটি মহল ও কিছু মিডিয়া বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়াতে শুরু করে। হুমকি আসে এর মূল সংগঠকদের হত্যা করার। কিন্তু এই সব বাঁধা বিপত্তিকে জয় করে নানা চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে ও ভিন্নধর্মী কর্মসূচী পালন করে প্রায় ৩০ টি দিন পার করতে চলেছে এই নির্ভীক নিরস্ত্র যোদ্ধারা।
তাই এই যোদ্ধাদের স্যালুট যারা, নানা দূর্যোগ কাটিয়ে, লাশ কাধে নিয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, প্রখর রোদে পুড়ে, নিজের সংসার রেখে, চাকরি, পড়াশুনা ফেলে, নারী-পুরুষ সকলে একত্রিত হয়ে রাত-দিন জেগে আছেন এই শাহবাগ চত্বরে। স্যালুট তাদেরকে, যারা দৃঢ় সংকল্প বদ্ধ, যে তারা এই শাহবাগ চত্বর ছেড়ে যাবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না সকল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকর হয় এবং জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয়। স্যালুট তাদেরকে যারা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে ব্লগিং করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগিয়ে রেখেছেন এবং ভার্চূয়াল দুনিয়া থেকে এই চেতনাকে রাজপথে রূপ দিয়েছেন। এরা অকুতোভয় সৈনিক। দেশের জন্য, দেশের পবিত্র মাটির জন্য তারা নিজের রক্ত আর মূল্যবান জীবনকে উৎসর্গ করতেও অকুতোভয়।
১৯৭১ সালের পর সময় এসেছে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী রাজাকার-দালালদের বিরুদ্ধে আরেকটি যুদ্ধ ঘোষণা করার। এই যুদ্ধ ধর্মের বিরুদ্ধে নয়, এই যুদ্ধ ধর্মের নামে যারা সংখ্যালঘুদের আক্রমণ করে, রাজাকারদের আশ্রয় দিয়ে দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়, দেশের জাতীয় পতাকা ছিড়ে ফেলে, শহীদ মিনার ভাংচূড় করে, মসজিদে জায়নামাজ পুড়িয়ে ফেলে তাদের বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধের একমাত্র শক্তি জনতা ও তাদের কন্ঠে উচ্চারিত হওয়া মুষ্টিবদ্ধ হাতে প্রেরণা যোগানো স্লোগান।
জয় বাংলা...জয় আমাদেরই হবে।