এমন একটি দিনও বোধহয় অতিক্রান্ত হয় না, যে দিন পশ্চিমা গণমাধ্যমের শিরোনাম হয় না এই দেশটি। পিপড়ের সমান এই দেশটির পশ্চিমা ডায়নোসরদের কাছে মাথা না নোয়ানোর কারণে দেশটি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী আলোচিত ও বিতর্কিত দেশ। বাংলাদেশের চেয়েও ছোট্ট লিলিপুট সাইজের এই দেশটি যখন দানবাকৃতির আমেরিকার হুংকারেও কাবু হয় না, বরং মাথা উচিয়ে গর্জে উঠে তখন বিশ্ববাসী অবাক হয়ে তাঁকিয়ে থাকে ছোট্ট এই সাহসী দেশটির দিকে। এই দেশটির নাম হলো উত্তর কোরিয়া। ১৯০৫ সালে রুশো-জাপানিজ যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে কোরিয়া হারায় এর স্বাধীনতা। এই যুদ্ধে জয়ী হয় জাপান, ফলে জাপানের অধীনে চলে আসে কোরিয়া।
১৯১০-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এই ৩৫ বছর ধরে কোরিয়ান মেয়েদের বানানো হয় জাপানিদের ভোগ্য পণ্য আর ছেলেদের করা হয় জাপানিদের গোলাম। ২য় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে কোরিয়া স্বাধীনতা লাভ করে, কিন্তু ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোরিয়ার দুই প্রান্ত দুই পরাশক্তির অধীনে থাকায় যুদ্ধশেষে কোরিয়া দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আমেরিকার অধীনে থাকা কোরিয়ার দক্ষিনাংশ হয়ে যায় গণতান্ত্রিক দেশ দক্ষিন কোরিয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে থাকা কোরিয়ার উত্তর অংশ হয়ে যায় সমাজতান্ত্রিক দেশ উত্তর কোরিয়া।
জাপানের শোষন থেকে কোরিয়াকে মুক্ত করার জন্য যাদের অবদান সবচেয়ে বেশী তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা কিম ইল-সং। জীবনের দীর্ঘ সময় কোরিয়ার স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সখ্যতা থাকার কারণে উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতা লাভ করেন কিম ইল-সং। কিম ইল-সং এর মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন তাঁর ছেলে কিম জং ইল এবং কিম জং ইল এর মৃত্যুর পর উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান হন তার ছেলে কিম জং উন।
আমেরিকা ও এর ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলো কখনোই চায়নি এশিয়া মাথা তুলে দাড়াক। সেজন্য জাপান যখন চল্লিশ এর দশকে এশিয়াকে ইউরোপের দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে চাইছিলো তখন ১৯৪৫ সালে পারমানবিক বোমা মেরে জাপানের ঘাড় মটকে দেয় আমেরিকা, বুঝিয়ে দেয় আসল রাজা কে। এই ঘটনার পর থেকে আমেরিকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে গোটা এশিয়াকে। যেসব দেশ আমেরিকার কথা শুনেনি কিংবা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কথা বলেছে সেসব দেশকে হয় তছনছ করে দেওয়া হয় কিংবা সে দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে সরিয়ে দিয়ে এমন কাউকে ক্ষমতায় বসানো হয় যিনি কাজ করবেন আমেরিকার পুতুল হিসেবে।
২য় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা যখন কোরিয়ার উত্তরাংশকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি তখন থেকেই পরাজয়ের আগুনে জ্বলছিল আমেরিকা। আমেরিকা কোনভাবেই মেনে নিতে পারে না যে তার বিরুদ্ধে কথা বলার মতো কোন দেশ পৃথিবীতে থাকুক। আমেরিকার কাছে উত্তর কোরিয়া হলো চোঁখের কাটা, যতক্ষন পর্যন্ত না এটিকে উপড়ে ফেলা যায় ততক্ষন পর্যন্ত শান্তি পাবে না এটি। তাই ৫০ এর দশকে কোরিয়ান যুদ্ধে গোটা উত্তর কোরিয়াকে লন্ডভন্ড করে ফেলে আমেরিকা এবং হত্যা করে দেশটির ২০ ভাগ মানুষকে যার পরিমাণ ২-৩ মিলিয়ন মানুষ।
যুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়েও কিংবা স্বজন হারিয়েও উত্তর কোরিয়ার জনগণ ভেঙ্গে পড়েনি। বরং নিজেদের অবস্থা বদলাতে মরিয়া উত্তর কোরিয়ার মানুষ কয়েক বছরেই তাদের অবস্থা একেবারে বদলে ফেলে। তখন উত্তর কোরিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা দক্ষিন কোরিয়ার চেয়েও ভালো অবস্থানে ছিল। কিন্তু প্রথমে জোসেফ স্টালিন ও পরে মাও জেদংয়ের মৃত্যু ও সবশেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের মধ্যদিয়ে উত্তর কোরিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা একেবারেই শোচনীয় পর্যায়ে এসে দাড়ায়। ওদিকে জাতিসংঘকে দিয়ে আমেরিকা একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারি করে আসছিলো উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে।
কিন্তু এতকিছুর পরেও উত্তর কোরিয়া ভেঙ্গে পরেনি। পরনির্ভরতা বাদ দিয়ে নিজেরাই সবকিছু উৎপাদন করা মানে স্বনির্ভরতা, উন্নত প্রযুক্তির ব্যাবহার, কঠোর পরিশ্রম, বিনামূল্যে জনগণের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিতকরণ, শতভাগ স্বাক্ষরতা বাস্তবায়ন অর্থাৎ দেশের কেউ নিরক্ষর বা অশিক্ষিত থাকবে না, এগুলো হলো উত্তর কোরিয়ার উন্নয়নের মূলনীতি। এই দেশটি হলো পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে গৃহহীন বলতে কোন শব্দ নেই, এখানে কাউকে শিক্ষা গ্রহণ, চিকিৎসা সেবা পাওয়া কিংবা বাসস্থানের জন্য টাকা দেয়া লাগে না।
এদেশটিতে কোন পরিত্যক্ত শিশু নেই, মাতা-পিতাহীন শিশুদের সকল দায়িত্ব রাষ্ট্র বহন করে। কিম পরিবার শাসিত একনায়কতান্ত্রিক এই দেশটিতে খুবই কঠোর আইন থাকতে পারে, কিন্তু পশ্চিমা গণমাধ্যম যেভাবে গোটা বিশ্বের মানুষের কাছে দেশটিকে অদ্ভুতভাবে হাসির পাত্র হিসেবে তুলে ধরে সেরকম কোনকিছুই নেই, বলছেন উত্তর কোরিয়া পরিদর্শন করে আসা কানাডিয়ান আত্মনির্ভর সাংবাদিক ইভা বার্টলেট।
গুগল কিংবা ইউটিবে যখন উত্তর কোরিয়া লিখে সার্চ করবেন তখন যে বিষয়গুলো দেখলে আপনার বিদঘুটে মনে হবে সেটি হলো চুল কাটা নিয়ে নিষেধাজ্ঞা কিংবা খাদ্যাভাবে মানুষের মৃত্যু। চুল কাটা নিয়ে কোন দেশ নিষেধাজ্ঞা জারি করে এটি বিশ্বাস হচ্ছিলো না দুই অস্ট্রেলিয় যুবকের। আর তাই তাঁরা দুজন পাড়ি জমিয়েছিলেন উত্তর কোরিয়ায়, নিজের চোঁখে দেখে আসবেন বলে। উত্তর কোরিয়া থেকে ঘুড়ে এসে তাঁরা একটি তথ্যচিত্র বা ডকুমেন্টারী ইউটিউবে আপলোড করলেন যার নাম দ্যা হেয়ারকাট। এখানে তাঁরা দুজন বর্ননা করেছেন কিভাবে গণমাধ্যম সম্পূর্ণ ভিত্তিহীনভাবে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করে উত্তর কোরিয়া ও কিম জং উন কে গোটা পৃথিবীর কাছে ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করছে।
কিম ইল সং বুঝতে পেরেছিলেন আমেরিকার হাত থেকে তাঁর দেশকে রক্ষা করতে গেলে একটি জিনিস থাকা দরকার, পারমানবিক অস্ত্র। সেজন্য তিনি বেঁচে থাকতেই পারমানবিক প্রকল্প চালু করেছিলেন যা এখনও চলমান। কিন্তু আমেরিকার চাপের মুখে কি উত্তর কোরিয়া আদৌ এতে সফল হবে? রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে উত্তর কোরিয়া যদি আমেরিকার কথা শুনে পারমানবিক প্রকল্প বন্ধ করে দেয় তাহলে কিম জং উন এর পরিণতি হতে পারে সাদ্দাম হুসেন কিংবা গাদ্দাফির মতো।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুন, ২০১৯ রাত ৩:০৫