somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রানা চাচা

৩০ শে এপ্রিল, ২০২৩ ভোর ৫:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ষাটের দশক। আমরা তখন মিরপুর পল্লবীর বাড়িতে থাকি। মিরপুর পল্লবী, কলাবাগান, মোহাম্মদপুর সহ ঢাকার প্রায় এলাকার বাড়ি ঘর তখন ছিলো অনেকটা গ্রামের মতো পরিবেশ। এই বাড়ির মানুষ সেই বাড়িতে যান, সেই বাড়ির মানুষ এই বাড়িতে আসেন। বাড়িতে মেহমান আসলে এক বাড়ির মানুষ আরেক বাড়িতে ট্রান্সফার হয়ে যেতেন এমন অবস্থা। আর রান্না করা তরকারি প্রায় নিয়মিত দেওয়া-নেওয়া হতো। মিরপুরে - রূপনগর নামে কোনো জায়গা ছিলো না। জয়গাটির নাম ছিলো দো-আড়ি পাড়া (দুয়ারীপাড়া), পুরোটা পানিতে ডুবে থাকা ঝিল মাঝে মাঝে পানিতে ভাসমান ডিবি তাতে মাটির ঘর।

আমান চাচা ছিলেন আমাদের একজন প্রতিবেশী, খুবই সজ্জন মানুষ। আমান চাচীর ছোটবোন নাসরিন ফুপু, - চাচীর বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করতেন। নাসরিন ফুপু প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতেন। নাসরিন ফুপু বেশী বেশী আসতেন তখনই - যখন রানা চাচা পল্লবীর বাড়িতে আসতেন। রানা চাচা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে পড়ালেখা করছিলেন, তিনি থাকতেন আমাদের কলাবাগান বাড়িতে। কলাবাগান থেকে পায়ে হেটে - মুড়ির টিন বাসে করে তিনি প্রায় প্রতিদিন পল্লবী চলে আসতেন, কারণ - নাসরিন ফুপু।

জীবন স্মৃতি: পল্লবী আমাদের বাড়ি যেই লাইনে সেই লাইনের প্রায় সকলে বিষয়টি কম বেশী জানতেন। বিষয়টি নিয়ে বিরক্ত ছিলেন একমাত্র একজন। হয়তো তিনি বুঝতে পারতেন এই লবে (LOVE) ভালো ফলাফল দিবে না। তিনি আমার আব্বা। বাড়িতে একদিন দুপুরে খাবারে বসে ভাত খাচ্ছেন মেজর কাদির, মেজর হান্নান, মেজর খালেদ মোশাররফ (বীর উত্তম খালেদ মোশাররফ) ও আমার আব্বা মেজর . . . । সবাই খাকি ইউনিফর্মড ফুল ডেকোরেটেড। কোনো দাওয়াত টাওয়াত না, কোথাও যাচ্ছেন, জীপ থামিয়ে বাড়িতে খেতে এসেছেন - ঘরে যা আছে তাই। খাবার টেবিলে ইংরেজীতে কথা হচ্ছে যার অর্থ দাড়ায়: - মেজর কাদির জানতে চাইলেন - তোমার ভাই আর্মিতে জয়েন করছে না কেনো? আব্বা উত্তর দেওয়ার আগে মেজর খালেদ মোশাররফ উত্তর দিলেন “ইয়ংম্যান লবে পড়েছে”। আব্বা ছোট করে বললেন রানা বোকার স্বর্গে বাস করে। মেজর কাদির বিরক্ত হয়ে বললেন - তুমি হয়তো ভুলে গিয়েছো, বোকারা পরিবারের জন্য বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করে। (জীবন স্মৃতি - আল্লাহপাক উক্ত সকলকে বেহেস্ত নসীব দান করুন)

মাস তিন চার পরের কথা, হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই নাসরিন ফুপু গ্রামের বাড়িতে গিয়ে আর ঢাকা ফিরে আসেন না! রানা চাচা পল্লবী এসে সারাদিন চুপচাপ বসে থেকে সন্ধ্যায় মন খারাপ করে কলাবাগান ফিরে যান। আমান চাচীর সাথে অন্ধগ্রামের সহজ সরল আমার আম্মা কথা বলে কোনো সদুত্তর খোঁজে পাননা। রানা চাচা আমার সাথে বেশ গল্প গুজব করতেন। এখন ভর দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছাদে দাড়িয়ে থাকেন। আব্বা সিলেট ক্যান্টনমেন্ট থেকে ঢাকা ফিরে বাসায় এসে বিস্তারিত শুনে উনার ধারণা জানালেন - নাসরিন ফুপুর বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এবং অবশ্যই তাঁরা ভালো বর পেয়েছে। কথা সত্যি, আমান চাচা বিচিত্র কোনো কারণে চাচীকে ভয় পেতেন। তিনি আব্বাকে পেয়ে বিস্তারিত জানালেন। নাসরিন ফুপুর বর প্রবাসী মানুষ, তিনি বাগদাদে চাকরি করেন। সেই সময়ে বাগদাদে থাকা বি-শা-ল ব্যাপার স্যাপার ছিলো।

মাস খানেক পর যথারিতি রানা চাচা আব্বার মুখোমুখি! আব্বা আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছেন তাঁর ছোট ভাইয়ের দিকে! চুল দাড়ি গোঁফ রেখে প্রায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবস্থা! আব্বা চিরুনি কেঁচি নিয়ে নিজ হাতে চুল কাটলেন সেভেন ও ক্লক ব্লেড রেজর দিয়ে শেভ করে দিলেন। আব্বা রানা চাচার সাথে খুব রাগ করলেন, আসে পাশের বাসা বাড়ির মানুষজন মনে হয় সবই শুনতে পেয়েছেন। আব্বা আস্তে কথা খুব কমই বলতেন। ইংরেজিতে খুব ধমকালেন, যার কিছু অর্থ হয় এমন - তোমার উচিত হবে আবার ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা শুরু করা। তোমার মতো বোকা মানুষের সাথে কথা বলাও বিপদ। নাসরিনের বিয়ের বয়স হয়েছে তাঁর পরিবার তাঁর যোগ্য পাত্র পেয়েছে। আর তুমি এখনও ছাত্র, তোমার কোনো আয় রোজগার নেই আর তুমি লবে করে বেড়াচ্ছো! রানা চাচা মাথা নিচু করে অপরাধী হয়ে দাড়িয়ে রইলেন।

আব্বার হাত থেকে বাঁচার জন্য রানা চাচা পল্লবী আসা বন্ধ করলেন, কলাবাগান ছাড়লেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সিট নিয়ে মোটামোটি পালিয়ে থাকেন। কিন্তু চাচা সমস্যা থেকে পালাতে পারলেন না। নাসরিন ফুপু রিতিমতো নিয়ম করে বাগদাদ থেকে চিঠি পাঠান হলের ঠিকানায়। গাড়ি নিয়ে বেড়াচ্ছেন, বড় গগলসে (সানগ্লাস) চোখ মুখ ঢাকা হাসি হাসি মুখে সুখী সুখী চেহারার পোলারয়েড ক্যামেরায় তোলা ছবি পাঠাতে থাকলেন চাচার হলের ঠিকানায়! রানা চাচার পড়ালেখা লাটে উঠে গেলো। সংবাদ পেয়ে আব্বা আবার হলে গিয়ে তাঁর ছোট ভাইকে ধরে আনলেন। চাচা আবারও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! চুল দাড়ি গোঁফ এলাহি অবস্থা। সেই সময়ে রাত আটটা নয়টা অর্থ গভীর রাত। আব্বা চাচার সাথে রাত একটা দুইটা পর্যন্ত কথা বললেন। ঘুমে জাগরণের মাঝে মনে হলো একজন বাবা তাঁর সন্তানের সাথে কথা বলছেন, একজন বড় ভাই তাঁর ছোট ভাইয়ের সাথে কথা বলছেন, একজন শিক্ষক তাঁর ছাত্রের সাথে কথা বলছেন।

রানা চাচা ও আমার জায়গা হলো এক রুমে। আমি রানা চাচার পাহারাদার। চাচা গভীর রাত পর্যন্ত পড়েন। নাসরিন ফুপুর চিঠি আমাদের পল্লবীর ঠিকানায়ও এসেছে, কিন্তু সেইসব চিঠি কখনো চাচার হাতে আর পৌছেনি। নাসরিন ফুপু বিয়ের পর ভালো আছেন, প্রবাসে স্বামী সংসার করছেন, তারপরও কেনো রানা চাচাকে চিঠি দিতেন সুন্দর সুন্দর হাসি খুশির ছবি পাঠাতেন এই রহস্য নাসরিন ফুপু হয়তো ভালো জানতেন। আমি কখনো জানার চেষ্টা করিনি। রানা চাচার রাত জেগে পড়ালেখা কাজে দিয়েছে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়ে পাশ করেন।

পরিশিষ্ট: টানা সপ্তাহ দশদিন ধরে ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টি কমে আবার বাড়ে। পাকিস্তান সরকারের রাস্তায় হাটু সমান পানি। যেই সব সন্ধ্যায় রানা চাচা খুব মন খারাপ করে পল্লবী থেকে কলাবাগান ফিরে যেতেন, তেমনি এক সন্ধ্যায় রানা চাচা বৃষ্টিতে ভিজে কাঁদায় মাখামখি হয়ে পল্লবী এসে হাজির। বিচিত্র কারণে কাকতালীয় ঘটনাগুলো আমাদের জীবনে বার বার ঘটে, হয়তো আমরা অনেক সময় তা লক্ষ্য করি না। আব্বা সেদিন বাসায়। রানা চাচা আব্বাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। আব্বার জামা কাপড় চাচার গায়ের কাঁদায় মাখামাখি, চাচার হাতে অফ হোয়াইট রেডিও বন্ড সরকারি কাগজে সিএসপি অফিসার পদে জয়েনিং লেটার। রানা চাচা ১৯৭১ এ বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে বীর দর্পে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে দায়িত্ব নিয়ে নানান দেশে কাজ করেছেন। মজাদার বিষয়, তিনি বাগদাদে নিযুক্ত বাংলাদেশ অ্যাম্বাসিতে কনস্যুলার হিসেবে কর্মরত ছিলেন দুই বছর। সর্বশেষ রানা চাচা জাপানে নিযুক্ত বাংলাদেশ অ্যাম্বাসিতে সর্বোচ্চ পদ অ্যাম্বাসেডর হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতা সততা ও নিষ্ঠার সাথে দেশের জন্য দায়িত্ব পালন করে চাকরি হতে অবসর গ্রহণ করেন। জীবন সত্যিই রহস্যময়!


বিশেষ দ্রষ্টব্য: সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা অলম্বণে লেখা। শুধুমাত্র গল্পের প্রয়োজনে নাসরিন ফুপুর নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।

ছবি: https://fineartamerica.com






সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০২৩ রাত ১১:৫১
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×