চারদিকে শুধু প্রশ্ন ২৫ অক্টোবরের পর কী হবে? বিএনপি'র নেতানেত্রীদের বক্তব্য শুনে মনে হয় মহাপ্রলয় আসন্ন। তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানা না হলে ২৫ অক্টোবরের পর—অর্থাত আর মাত্র ৪ দিন পর তারা এমন আন্দোলন শুরু করবেন যা হবে মহাপ্রলয়ের সমতুল্য। মহাপ্রলয়ের শিঙাটি ফুঁকবেন ইসরাফিল ফেরেশতা। কিন্তু বাংলাদেশে মনে হয় এই দায়িত্বটি নিয়েছেন বিএনপি'র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম। বেশকয়েকদিন আগে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী কিছুদিন পর আওয়ামী লীগ সরকার আর ক্ষমতায় থাকবে না।
আজ থেকে ২৫ অক্টোবরের বাকি আর ৪ দিন। মির্জা ফখরুলের গণনা অনুযায়ী বাংলাদেশে রাজনৈতিক মহাপ্রলয় ঘটতে আর বাকি আছে মাত্র কিছু মুহূর্ত। এই ৪-৫ দিন পর বিএনপির (সঙ্গে জামায়াত ও হেফাজত) নির্দেশে মেঘনা পদ্মা যমুনা গর্জে উঠবে, আওয়ামী লীগের রাজত্ব শেষ! শেখ হাসিনা পলাতক, নিখোঁজ, না বন্দী?
এমন একটা সিনারিও বাংলাদেশে ঘটতে পারে, ঘটনোর জন্য মির্জা ফখরুলেরা ইসরাফিলের শিঙা হাতে অপেক্ষা করছেন এমন শঙ্কা এখন দেশের অনেক মানুষের মনেই। ফলে চারদিকেই ঈদের ছুটি শেষে ঢাকামুখী মানুষের মনে একটাই প্রশ্ন, ২৫ অক্টোবরের পর কী হবে? বিএনপি কি জামায়াতের সঙ্গে মিলে এই প্রলয় ঘটাতে পারবে?
যারা উৎকন্ঠার মধ্যে আছেন তাদের বলছি, বৃক্ষ তোমার নাম কি ফলে পরিচয়। আমরা সকলেই এই প্রবাদটির সাথে পরিচিত। ২৫ অক্টোবরের পরই জানা যাবে, যতো গর্জন হচ্ছে, ততো বর্ষণ হবে কিনা? তবে এই ব্যাপারে বিএনপি'র প্রস্তুতি থাক বা না থাক, তাদের উসকানি দান ও সাহস জোগানোর জন্য নিরপেক্ষতার মুখোশধারী একটি বাংলা দৈনিক আজকাল সদা তত্পর। সম্প্রতি সময় বুঝে, বিএনপির এই তর্জন গর্জনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশে নির্বাচন হলে কী ফল দাঁড়াবে তার একটি জনমত জরিপ দৈনিকটি করেছে। উদ্দেশ্য বিএনপি-শিবিরে এই বলে উত্সাহ জোগানো যে, দেশের মানুষ তোমাদের সমর্থন জানাতে উন্মুখ হয়ে আছে।
আজকাল দেশে বিদেশে এমন বহু সংস্থা ও মিডিয়া আছে, যারা কোনো রাজনৈতিক দল বা অন্য কোনো সংগঠনের দ্বারা কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে বিপুল অর্থের বিনিময়ে তাদের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তাদের পছন্দসই সমীক্ষার ফল প্রকাশ করেন। নিজেদের স্বার্থ ও উদ্দেশ্য পূরণের জন্য এই সমীক্ষাকে ব্যবহার করা হয়। ফলে আজকাল ইউরোপ-আমেরিকায় প্রকৃত নিরপেক্ষ মিডিয়া এবং কিছু ব্রান্ডনেমের পোলসংস্থা ছাড়া অন্য কোনো জনমত সমীক্ষার ফল কেউ আমলে নেন না।
এবার ২৫ অক্টোবরের পর বিএনপি ঘোষিত মহাপ্রলয়ের কথায় আসি। এ বছর মে মাসের ৫ তারিখে হেফাজতি অভ্যুত্থানের আগে বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়া স্বয়ং আওয়ামী লীগ সরকারকে ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনাকে এই ৪৮ ঘন্টার মধ্যে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে বলেছিলেন। হেফাজতি শিবির থেকে কেউ কেউ ঘোষণা করেছিলেন, ৫ মে'র পর মওলানা শফী হবেন দেশের প্রেসিডেন্ট। বলা হয়েছিল তারেক রহমান কুড়ি দিনের মধ্যে দেশে ফিরছেন।
তারপর বহু ৪৮ ঘন্টা পার হয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গায় বহু জোয়ার-ভাটা হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতারা ক্ষমতায়। কেউ দেশ ছেড়ে পালাননি। মওলানা শফী দেশের প্রেসিডেন্ট হননি। বরং তার তেঁতুল তত্ত্বের জন্য দেশ-বিদেশে হাসির খোরাকে পরিণত হয়েছেন। তারেক রহমান এখনো বিদেশে। দেশে ফিরে আসার সাহস দেখাতে পারেননি।
২৫ অক্টোবরের পরের মহা-অভ্যুত্থানের ঘোষণা যিনি সবচাইতে বেশি সরবে দিয়েছেন, সেই ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এখন রোগাক্রান্ত। আগামী ২৫ অক্টোবরের আগেই তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন অথবা দেশে ফিরতে পারবেন বলে মনে হয় না। ফলে আন্দোলনে একজন সেনাপতি অনুপস্থিত থাকবেন। বাকি সেনাপতিদের মধ্যে খোরশেদ আনোয়ার আন্দোলনের সময় আত্মগোপনে পারদর্শী। মির্জা ফখরুল দ্রুত কারাবরণ করেন।
তাহলে শুধু দলের নেত্রী থাকবেন ময়দানে। বিএনপি'র অনুপস্থিতিতে ফাঁকা মাঠে নামবে জামায়াত ও শিবির। তারা আগের মতো চোরাগোপ্তা হামলা চালাবে। গাড়ি ঘোড়ায় অগ্নিসংযোগ করবে। দু'-চারজন নিরীহ পথচারী অথবা পুলিশ হত্যা করবে। এর বেশি কিছু করার ক্ষমতা ও জনসমর্থন কোনোটাই তাদের নেই। গত কয়েক মাস যাবত্ দেশের বিভিন্ন শহরে সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত এবং বহু কর্মী গ্রেফতার হয়ে যাওয়ার ফলে জামায়াতের ব্যাপক সন্ত্রাস সৃষ্টির ক্ষমতাও এখন কম। সম্ভবতঃ অক্টোবরের মহাপ্রলয়ে ব্যবহার করার জন্য তারা মাদ্রাসার ভেতর যে গোলাবারুদ তৈরি করেছিল তাতেও আগেভাগেই বিস্ফোরণ ঘটে সব প্রস্তুতি ব্যর্থ। সুতরাং ২৫ অক্টোবরের পর কেবল শিঙা ফুঁকালেই হবে না, মহাপ্রলয়টা ঘটাবে কারা?
বেগম খালেদা জিয়ার জনসভায় বিশাল জনতার ভিড় হয়। সভায় নাটকীয় ভঙ্গিতে তার গর্জন শুনতে অনেকেই পছন্দ করেন। কিন্তু তার ডাকে সরকারের পতন ঘটানোর জন্য তারা রাজপথে নামবে কি? তিনি তো বহুবার দেশের মানুষকে পথে নামার ডাক দিয়েছেন। কেউ শুনেছে কি? এবারেও শুনবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? মির্জা ফখরুল ইসরাফিলের মহাপ্রলয়ের শিঙা হাতে জনসভায় দাঁড়াতে পারেন। শিঙা বাজানোর হুমকিও দিতে পারবেন। তাতে আগের মতো কিছু সন্ত্রাস, ভাংচুর ছাড়া আর কিছু হবে কি?
আওয়ামী লীগও একবার এই নাটক করেছিলো। বিএনপি'র গত সরকারের আমলে একবার আওয়ামী লীগের তত্কালীন সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা দিয়েছিলেন, সে বছর ৩০ এপ্রিলের মধ্যে বিএনপি সরকারের পতন ঘটবে। বিএনপি সরকারের পতন ঘটেনি বরং আওয়ামী লীগ লোক হাসিয়েছিল। মনে হয়, বিএনপি এখন আওয়ামী লীগের সেই নাটক নিজেরাই পুনরাভিনয় করতে চাচ্ছে। পরিণতি ভিন্ন হবে কি?
কোনো সন্দেহ নেই, প্রধানমন্ত্রীর গত শুক্রবারের সংযত এবং ইতিবাচক ভাষণ এবং প্রস্তাব ২৫ অক্টোবর থেকে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচির আগুনে ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিয়েছে। দেশের বিবেকবান মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এই ভাষণকে স্বাগত জানিয়েছে। এই ভাষণ সম্পর্কে প্রধান বিরোধী দল নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছে এবং দু-দিন পরে তারা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। আমার আশা, তারা জামায়াতের ফাঁদে পা দেবেন না। জামায়াত এই ভাষণ প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা প্রত্যাখ্যান করবে এটা আগে থেকেই জানা কথা।
বিএনপি যদি এই ভাষণকে প্রত্যাখ্যান না করে এর ইতিবাচক দিকগুলোকে ভিত্তি করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অন্যান্য অমীমাংসিত ইস্যুগুলো মীমাংসার জন্য এগোত, সেক্ষেত্রে সেটা হতে পারতো তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার এক বিরাট প্রমাণ। তাদের এই বিজ্ঞতা দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যেক স্থিতিশীল করত এবং আর চাই কি, তারা যা আশা করেন, তাদের সেই নির্বাচন সাফল্যের সম্ভাবনা আরও বেড়ে যেতে পারত।
কিন্তু গোঁয়ার্তুমি করে ৩-৪ দিন ভাবারপর আপনারা জামায়াতীদের ফাঁদে পা দিলেন এবং প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে প্রত্যাখান করলেন।
এখন যদি মহাপ্রলয়ের হুঙ্গাকারে দেশে নন ইস্যুতে আন্দোলনের নামে ভাঙচুর, সন্ত্রাস সৃষ্টির কাজে নামেন, তাহলে সাম্প্রতিক অতীতের মতোই আপনারা ব্যর্থ হবেন এবং প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কষ্টকর হবে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বিএনপি ও জামায়াতের আন্দোলনের ডাকে দেশের মানুষ এখন ভয় পায়, সমর্থন দেয় না।
প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশে দেয়া গতশুক্রবারের ভাষণকে অবশ্যই স্বাগত জানাই। কিন্তু স্বাগত জানাতে পারছি না তার সরকারের দুটি সিদ্ধান্তকে। একটি রবিবার থেকে পুনরায় বিজ্ঞপ্তি না দেয়া পর্যন্ত ঢাকার প্রশাসন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ঢাকায় সর্বপ্রকার জনসমাবেশ, জনসভা, মিছিল-মিটিং নিষিদ্ধ করে দেয়া। তাহলে সরকার কি বিএনপির ২৫ অক্টোবরের মহাসমাবেশের ডাকে ভয় পেয়েছেন? প্রশাসন-কর্তৃপক্ষ বলেছেন, বিরোধী দলের ওই সমাবেশের দিন সরকারি দলও সমাবেশ ডেকেছে। তাতে শান্তি ভঙ্গের আশঙ্কা রয়েছে। ভালো কথা। ওইদিন সরকারি দলকে সমাবেশ করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়াই কি উচিত ছিল না? সরকার সেটা পারতেন।
বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করার গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে। সেই অধিকারের ব্যত্যয় ঘটিয়ে তারা যদি জনজীবনে অশান্তি ও উপদ্রব ঘটাতে চায় তাহলে প্রশাসন-কর্তৃপক্ষ অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নেবেন; কিন্তু শান্তি ভঙ্গ করার আগে নয়। আমার ধারণা, ২৫ অক্টোবর নিয়ে বিএনপি যতো তর্জন-গর্জন করছে, ততোটা বর্ষণ ঘটানোর হিম্মত তাদের নেই। বরং এখন তারা দাবি করবেন, তাদের বিশাল আন্দোলন সফল হবে এই ভয়ে সরকার দমন নীতির আশ্রয় নিয়েছেন। এই দমন নীতি মোকাবিলা করার নামে তারা জামায়াতের সহায়তায় ওই দিন থেকে হয়তো কিছু ভাঙচুরও করবেন, জনজীবনের শান্তি বিনষ্ট করবেন। সরকারও অগণতান্ত্রিক পথে গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনের দুর্নাম কুড়াবেন।
বিরধীদলিয় নেত্রির প্রস্তাব নিয়েও ভাবা যেতে পারে।
আজ বিকেলে গুলশানের হোটেল ওয়েষ্টিন থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া নির্দলীয় সরকার গঠনের যে প্রস্তাব দিয়েছেন তা হলো...................
যেহেতু ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে, তাই ওই ২০ জন উপদেষ্টাদের মধ্য থেকে সরকার দল প্রস্তাবিত পাঁচজন এবং বিরোধীদল প্রস্তাবিত পাঁচজন নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে।
সেই সাথে দেশের সম্মানিত একজন নাগরিককে দুই দলের সম্মতিতে নির্দলীয় সরকারের প্রধান করা যেতে পারে।
(সংগৃহীত ও লিখিত)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০১৩ বিকাল ৫:৩১