১৯৭৩ সালের ঘটনা। সন্ধ্যা সাতটার কনসার্ট, অথচ মানুষ এসে বসে আছে সেই বিকেল পাঁচটা থেকে কিন্তু শিল্পী-কলাকুশলীদের টিকিরও দেখা নেই। এমনিতে আমাদের দেশে টিকিট কেটে যারা কনসার্ট দেখতে আসেন সময়মতো শিল্পীর দেখা না পেলে তারাই সেখানে কেয়ামত ঘটিয়ে দেন কিন্তু সেদিনের অবস্থা ছিল একেবারেই উল্টো। কনসার্ট কখন শুরু হবে তা নিয়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের মাঠে প্রায় ত্রিশ হাজার জনতার সে কী তীব্র অপেক্ষা, কিন্তু তাদের কারো মধ্যে শিল্পীর প্রতি একরত্তিও অভিযোগ নেই। রাত সাড়ে আটটায় খবর এলো এয়ারপোর্ট থেকে শিল্পী এরমধ্যেই রওয়ানা হয়ে গেছেন কনসার্টের উদ্দেশ্যে, কলাকুশলীরা রওয়ানা দিয়েছেন তারও আগে। খানিক বাদেই স্টেজে উঠলেন হাবলু ভাই। ব্যায়ামবিদের মতো মাসলওয়ালা শরীর। স্টেজে উঠেই হাবলু তার সেই বিখ্যাত ড্রাম বাজানো শুরু করলেন। মিনিটখানেক পরেই উত্তেজনার বশে নিজের টি-শার্টও ছিড়ে ফেললেন হাবলু। এরমধ্যেই সবার কাছে খবর চলে এসেছে, চলে এসেছেন শিল্পী।
সারা মাঠের জনতার মুখে তখন একই রব 'গাউসুল আজম, হু! হা!' 'গাউসুল আজম, হু! হা!'। মুহুর্তেই তাদের সেই গণরবে গরম হয়ে উঠল গোটা প্রাঙ্গণ। এরমধ্যেই খালি পায়ে দর্শকদের মাঝ থেকে দৌড়ে এসে স্টেজে উঠলেন তিনি। শুরু করলেন তার সেই বিখ্যাত গাণ 'এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না গো, হায় আল্লাহ! হায় আল্লাহ! রে'
এতোক্ষনে কারো নিশ্চয়ই আর বুঝতে বাকী নেই যে সেদিনের সেই মানুষটিই আমাদের পপসম্রাট, গুরু আজম খান।
পুরো নাম মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান হলেও এই নামে কখনোই তিনি পরিচিত হননি, সারা দেশের মানুষের কাছে তিনি আজম ভাই কিংবা গুরু নামেই সর্বাধিক পরিচিত। উনসত্তরের গণঅভ্যুথানে যেমন ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর হয়ে গণসঙ্গীত গেয়েছেন, তেমনি দেশের প্রয়োজনে সশস্ত্রভাবে যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কখনো সুবিধা নেয়া তো দূরে থাক, মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটটিও নেননি কোনদিন।
দেশবরেণ্য এই শিল্পীর ছিলনা কোনো উচ্চতর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, পড়ালেখার পাট চুকিয়েছিলেন এইচএসসি পাস করেই। কোন যন্ত্রসঙ্গীত বাজানো তো দূরে থাক সঙ্গীতের উপর তালিমও নেননি কোনদিন। তার প্রতিটি গানের রচয়িতা তিনি নিজেই,অথচ কোন গানই তাকে লিখে রেখে সুর করতে হয়নি। যখনই সমাজের কোন অসঙ্গতি দেখেছেন অথবা কোনকিছু দেখে ভালো লেগেছে ওমনি সেটা নিয়ে গান বেঁধেছেন। তার গাওয়া 'রেল লাইনের ওই বস্তিতে' গানটি লিখেছিলেন ১৯৭৪ সালে। দুর্ভিক্ষে সারা দেশ তখন টালমাটাল। না খেয়ে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে অগণিত মানুষ। গান গেয়ে যে টাকা পেতেন তা অকাতরেই বিলিয়ে দিতেন গরীব-দুঃখীদের মাঝে। নিজে যুদ্ধ করে স্বাধীন করা দেশের এমন পরিণতি দেখে আর ঠিক থাকতে পারলেন না। লিখে ফেললেন গানটি। পরবর্তীতে গানটি সারাদেশে দারুন জনপ্রিয় হয়।
সারা পৃথিবীতে পপ সঙ্গীতকারদের ধারে কাছে তার ভক্তরা ঘেঁষারও সুযোগ পান না অথচ আমার জানামতে আজম খানই সারা পৃথিবীতে একমাত্র পপ সঙ্গীতশিল্পী যিনি নিজে বাজার করতেন, এলাকার সকল কাজেকর্মে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতেন, একবার তো স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরেই টেলিভিশনে গোটা একটা ইন্টারভিউ দিয়ে দিলেন।
আজম খান বাংলাকে ভালবাসতেন অন্তর দিয়ে। সেই অস্থির সময়ে সবাই যখন ইংরেজির দিকে ঝুকছে তখন তিনি ঝুকেছেন বাংলার দিকে। নিজের ব্যান্ডটির নামও ছিল একেবারে খাটি বাংলায়, 'উচ্চারণ'।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুবকেরা যখন ক্রমাগত হতাশার পথে নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছিল তখন এই আজম খানই তাদের সংগঠিত করে সংস্কৃতি চর্চায় উদ্বুদ্ধ করে তোলেন। এই তরুণরাই তাকে গুরু নাম দেয়, যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি হয়ে ওঠেন সারা বাংলার সঙ্গীত জগতের অবিসংবাদিত গুরু।
আজকে তোমার জন্মদিনে গুরু তোমার প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধাভরা ভালোবাসা।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১:২৯