somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্প : মেঘ ফুল হাওয়াঘর

২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১০:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মেঘ

হাতের মুঠোয় অরণ্য এবং অন্ধকার । দৃষ্টি-সুদূর - ছায়াচ্ছন্ন পাখি , অতল চোখে বিষণ্ণতা । আমি হেঁটে হেঁটে পার হয়ে যাই একটা মনোটোনাস দুপুর ; রৌদ্র-শায়িত ঘাস-বাগান । বুকের গভীর থেকে বেরিয়ে আসে হলুদ পাখির দীর্ঘশ্বাস ; উড়ে যায় অনির্দিষ্ট দিকে - ধূসরতায় । আমি হাটি , আমি দৌড়াই , আমি থামি । সে আমার পিছু পিছু আসে ,
- ও দাদা , কয়েকটা ফুল নেন না !
আমি দেখি - উজ্জ্বল দুপুরটা ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে মোমের মত , অদূরে রঙ্গন-গাছটা ক্রমশ রূপান্তরিত হচ্ছে মেঘে – ধোঁয়াশা । এখনই কি বৃষ্টি হবে , ধেয়ে আসবে সুদীর্ঘ-প্রাচীন ঝড় ? হায় ! , একটা শীতল পুকুর খুঁজতে এসে কোথায় যে হারিয়ে গেলাম !
- ফুল ? কি ফুল ?
সে আমার হাতে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা ফুল ধরিয়ে দিয়ে চলে যায় । আর আমি জ্বরগ্রস্তের মত কাঁপতে থাকি । হাতের মুঠোয় ফুলগুলো ক্রমশ উত্তপ্ত হতে থাকে । উত্তপ্ত হতে হতে সেগুলো হয়ে যায় – কয়েকটি বালিহাঁস । আমি ছুড়ে ফেলি । বালিহাঁসগুলো অস্ফুটে বলে – ব্যথা । তারপর পাখা মেলে উড়ে যায় । আর আমি একটি মনোরম ভোরের অপেক্ষায় সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ি ।

ফুল



প্রতিটি অনিন্দ্যসুন্দর ভোরে আমি আসলে একজোড়া নূপুরের শব্দ শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে থাকতাম । আমাদের ঘরের পেছনে ফুল বাগান , আমাদের ঘরের পেছনে জল-পুকুর , আমাদের ঘরের পেছনে এক মস্ত সকাল আটকে আছে । । সে চুপি চুপি বাগানে আসে , ফুল তুলতে । শিশিরে পা ফেললেই চমকে উঠে নিক্বণ , ঘাসে পদছাপ । তার বিষণ্ণ চোখ , বিষণ্ণ নাক-ফুল । আমার পাশের ঘরে মা সুরেলা কণ্ঠে কোরান পড়েন , সে সুর উড়ে আসে হাওয়ায় । আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেখি - সে সুর ছড়িয়ে পরছে বাগানে , নিমতলায় তারপর পুকুরপাড় হয়ে ডানা মেলে দিচ্ছে আকাশে । আমি সে সুর এবং নূপুরকে পাশাপাশি রেখে বের হয়ে আসি ঘর থেকে । মা ঘর থেকে চেঁচিয়ে বলেন
- ও বাজান কই যাসরে ... ?! মার আহ্বান প্রশ্নচিহ্ন হয়ে আনুভূমিক ঝুলতে থাকে বাতাসে ।

আমি সেই আনুভূমিক প্রশ্নচিহ্ন কে পাশ কাটিয়ে নিরুত্তর পৌঁছে যাই বাগানে । তাকে দেখি , সে হাসে , সে মাথা ঝাঁকায় , সে ফুল তোলে । আর নিশ্চুপে ছড়িয়ে দেয় নিক্বণ ।
- এত ফুল দিয়ে কি হয় ?
- ঠাকুরকে পুজো দেই , দাদা ।
- আচ্ছা , তুমি আমাকে দাদা ডাক কেন ?
- এমনি , হি...হি...
তার হাসি ছড়িয়ে পরে ফুল বাগানে । প্রতিধ্বনিত হয় পাতায় , পাপড়িতে । চারপাশে ভেসে বেড়ায় কেবল- হি...হি...হি ...........................
আমি সে হাসির গভীর অতলে ডুবে যেতে যেতে উঠে আসি । প্রতিধ্বনি থেকে তুলে রাখি কিছু শব্দসমষ্টি ।

- আমাকে মালা গাঁথা শিখাবে ?
- হ্যাঁ , শিখাব । আপনি আমাকে ছবি আঁকা শিখাবেন ?
- শিখাব । দুপুরে চলে এসো বারান্দায় ।
তুমি বলতে অন্যকোন জন্মে তুমি পাখি ছিলে । তোমার পিঠে সেই পাখিজীবনের পাখার দাগ রয়ে গেছে এখনো । একদিন এই দাগ থেকে আবার পালক গজাবে , পাখা উঠবে । আর তুমি উড়ে যাবে মেঘ থেকে মেঘান্তরে ।
- দ্যাখো , এখানে একটি নদী থাকলে সমস্ত দৃশ্যপট পাল্টে যাবে ।
- হুম ! আর নদীর উপর সারি সারি হলুদ পাখি ।
- হলুদ কি খুব পছন্দ ?
- হ্যাঁ , আমি তো বেছে বেছে কেবল হলুদ ফুলই তুলি !
হলুদ বালিকা আমার ! তুমি কেন পাখি হতে চেয়েছিলে ? তুমি কেন হাতের মুঠোয় একটি রৌদ্রস্নাত দুপুর নিয়ে ঘুরতে ? তুমি কেন হাসতে , ফুল তুলতে ?
কতদিন ছবি আঁকা শিখাতে শিখাতে ভেবেছি , একদিন দৃশ্যপটে হারিয়ে যাব অনির্দিষ্ট , উদ্দ্যেশ্যহীন ।


- আচ্ছা , আপনি না কবিতা লিখেন ?
- মাঝে মাঝে লিখি দু একটা !
- একটা পড়ে শুনাবেন ?
- তুমি কবিতা ভালোবাস ?
- হুম ! রবি ঠাকুর প্রিয় । তার অনেক কবিতা পড়েছি ।
- একটা শুনাবে ?

সে চলে গ্যালো লজ্জিত হয়ে । আমি একটা অশ্রুত কবিতার বেদনা নিয়ে বসে রইলাম । আমি দেখলাম আমার বেদনার প্রান্ত বেয়ে ঝরে পরছে অজস্র বাতাবিলেবু ফুল , অনিঃশেষ তার সুঘ্রাণ । আমি ফুসফুসে কিছু সুঘ্রাণ জমা করে ছবি আঁকতে শুরু করি !

তারপর হয়তো বহুকাল তার সাথে দেখা হয়না । মা বলতেন – ওরা হিন্দু ! ওদের সাথে মিশতে নেই । পাপ হয় ! তবুও কোন নিঃসঙ্গ দুপুরে ছবি আঁকতে আঁকতে , হায় ! আমার কেবল তার কথাই মনে পরে । মনে পরে তার চোখের বিষণ্ণতা , হাওয়ায় ভেসে যাওয়া এলো-চুল !



হাওয়াঘর



কোন কোন সন্ধ্যায় আমাকে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হয় । আমি ফিরতে ফিরতে গান গাই , কবিতা আওড়াই , দৃশ্য-কল্প আঁকি । আমাকে ফিরতে হয় ফুলবাগান দিয়ে ,আমাকে ফিরতে হয় পুকুরের পাশ ঘেঁষে ! আমি দেখি একটি মনোহর সন্ধ্যা ক্রমশ পুকুরের অইপারে ডুবে ডুবে যাচ্ছে , নেমে আসছে সুদীর্ঘ শীতল রাত । হেঁটে হেঁটে আমি ফুল বাগানে এসে শুনি – কেউ একজন কাঁদছে । তার কান্না বিলাপের মত ছড়িয়ে পড়ছে সন্ধ্যার বাঁকে বাঁকে । আমি কাছে গিয়ে দেখি – সে , বসে আছে ধুসর ঘাসে , মৃদু কাঁপছে ।

তার চুল এলোমেলো , তার গালে গলায় দাঁতের গভীর ক্ষত । তার ঠোঁট থেকে ঝরে পরছে রক্ত , তার শাদা শাড়ী এলোমেলো । তার পিঠের অদৃশ্য ডানা লুটিয়ে আছে কিছুদূর , হয়তো উড়তে চেয়েছিলো ! এমন আহত পাখি আমি আর একটিও দেখিনি ! কোন এক ব্যাধ তাকে হরণ করে চলে গ্যাছে সুদূরে রাতের পাতায় । তাকে কি আর কোনদিন খুঁজে পাব ?

আমি তার আশ্চর্য বিষণ্ণ দৃষ্টির সামনে মৃত ফুল হয়ে টুপ করে ঝরে পরি !



***
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ৮:৪৮
৭৭টি মন্তব্য ৭৫টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×