ঢাকা থেকে সদ্য সদ্য কিনে আনা বিদিত লাল দাসের সিডি চালিয়ে সুমেরুকে গানও শুনিয়ে দিলাম আর ঠিক করলাম যাব গান শুনতে! সুমেরুর সেদিন শ্যুট ছিল, বললো, তাড়াতাড়ি শেষ করে পৌঁছে যাবে হল'এ। আমি আগে থাকতে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানলাম, টিকিট দিয়ে নয়, অনুষ্ঠানটি সকলের জন্যে অবারিত দ্বার। অপেক্ষার সময়টুকু হলের বাইরের সিঁড়িতে বসে ঝাল ঝাল 'ঘটিগরম' (গরম গরম মশলা চানাচুর) খেয়ে কাটিয়ে দিলাম। অপেক্ষা অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার, অপেক্ষা সুমেরুর শ্যুট সেরে হলে আসার।
ঢাকায় গীতালীতে যখন পুরনো লোকসংগীতের সংগ্রহ দেখছিলাম তখন হঠাৎই চোখ পড়ে 'বিদিত লাল দাস' নামটির উপর। এক বিস্মৃত নাম। নামটি দেখামাত্রই একসাথে ভিড় করে এলো অনেক স্মৃতি। এক পিচ্চি টেলিভিশনের সামনে বসে আছে বিশেষ করে লোকসংগীতের অনুষ্ঠানের সময় ধরে। টিবি রুমে আর কেউ নেই। প্রতিদিন একই সময়ে একই চিত্র। তখন ভাল মন্দ বুঝতাম না, গানের কথাও খুব একটা বুঝতাম না শুধু গান শুনতাম। ভাল লাগত সুর। লোকসংগীতের সুর। সিডিতে ঐ নামটি দেখামাত্র কিনে ফেললাম, গান কেমন হবে, ভাল কী মন্দ কোন চিন্তা না করেই। এমনকি ওখানে সিডি চালিয়ে গান শুনিওনি যেমন অন্য সব সিডি শুনে তারপরে কিনেছি।
২৯শে জুলাই সিলেটের আরেক কৃতী সন্তান, প্রয়াত লোকসংগীত শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরীর জন্মতিথি। সেই উপলক্ষ্যে ৩১শে জুলাই মধুসুদন মঞ্চে লোকভারতী ও পশচিমবঙ্গ সরকারের যৌথ উদ্যোগে এই অনুষ্ঠান। 'লোকভারতী' নির্মলেন্দু চৌধুরী'র নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান যা এখন চালাচ্ছেন উৎপলেন্দু চৌধুরী। উৎপলেন্দু চৌধুরী নির্মলেন্দু চৌধুরীর সুপুত্র। বিদিত লাল দাস আর নির্মলেন্দু চৌধুরী প্রায় সমসাময়িক ছিলেন, উৎপলেন্দু বিদিত লাল দাসকে নিজের গুরু বলে অভিহিত করলেন। তো নির্মলেন্দু চৌধুরীর এই স্মরণ সভায় লোকভারতী নিয়ে আসে বিদিত লাল দাস'কে। তাঁকে সম্বর্ধনা দেয় লোকভারতী ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার। পশ্চিমবঙ্গের ক্রীড়া ও সংস্কৃতি মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী হাজির ছিলেন বিদিত লাল দাস'কে সন্মান জানাবেন বলে। ফুলের তোড়া, মানপত্র আর একটি স্মারক দেন সুভাষবাবু। বিদিত লাল বাবুর গায়ে শাল জড়িয়ে দেন উৎপলেন্দু চৌধুরী।
অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার বেশ আগে পৌঁছে গেছিলাম বলে জায়গা পেয়ে যাই একেবারে সামনে, দ্বিতীয় সারিতে। প্রথম সারিতে বসে বেশ কয়েকজন নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় মগ্ন সিলেটি ভাষায়। এঁরা সব সিলেট থেকে এসেছেন বিদিত লালবাবুর সঙ্গে। সে এক অদ্ভুত অনুভব। সেই কোনকালে ছেড়ে চলে আসা সিলেটের মানুষ আর সিলেটি ভাষা তাও এই খোদ কলকাতায় বসে! সেই অনুভূতির কথা বলে বোঝানো যায় না।
গাঢ় নীল পাঞ্জাবী আর সাদা পাজামা পরা বিদিত লাল দাস এলেন অনুষ্ঠান শুরুর ঠিক আগে, সামনের সারিতে এসে বসলেন। যথেষ্ট বয়েস হয়েছে, কথা বলতে গেলে গলা কাঁপে, হাত দিয়ে কিছু ধরতে গেলে কাঁপে হাত। শুধু যখন গান গাইতে শুরু করেন তখন উদাত্ত গলার আওয়াজে গমগম করে হলঘর। আর নাগাড়ে গেয়ে যান আটখানি গান। তাঁর গানের সাথে তবলা বাজাবেন বলে সিলেট থেকে সঙ্গে এসেছেন তাঁরই গানের স্কুলের তবলা শিক্ষক টিংকু। হৃদরোগী বিদিত লাল দাস একা গান গাইতে পারেন না বলে মঞ্চে তাঁর সাথে থাকেন গানের সঙ্গী ( নামটি ভুলে গেছি), যদিও বিদিত লাল দাসের গলা ছাপিয়ে তার গলা একবারও শোনা যায় না, আলাদা করে বোঝা যায় না।
বন্দনা গান দিয়ে শুরু করেন তিনি,
পরথমে মে বন্দনা করি আল্লা রসুল
হজরত ওয়ালীরে দিলাম .....
মাই ফাতেমা হযরত আলী হাসান আর হুসেন
মাতার উপর তুইলা রইলাম...
তার বাদে বন্দনা করি বাবা শাজলাআআআআআআআআআললললললললললল
তিনশ ষাইট আউলিয়া বন্দি...
(কথাগুলো মনে পড়ছে না বলে ডট ডট দিয়ে দিলাম, ক্ষমা করবেন)
এই 'বাবা শাজলাল' বলে তিনি গলা যে উচ্চতায় নিয়ে যান এখনো, সেটা না শুনলে বলে বোঝানো যাবে না। একে একে গেয়ে যান আটখানি গান। প্রতিটি গানের পরে করতালিতে ফেটে পড়ে হল। মঙ্গলবারের সন্ধ্যায়ও সেই হল পুরো ভর্তি ছিল। চরম মুগ্ধতায় শুনে যাচ্ছিলাম একের পর এক গান। মনে হচ্ছিল, এই গান যদি এভাবেই চলতে থাকত! পরক্ষণেই নিজেই লজ্জা পাচ্ছিলাম নিজের এই স্বার্থপর চিন্তায়। অসুস্থ শিল্পী এতদূর থেকে এসেছেন আটখানি গান শুনিয়েছেন, এই কী যথেষ্ট নয়! সেই কোন ছেলেবেলায় যাঁর গান টেলিভিশনে দেখেছি-শুনেছি আজ সামনে বসে তাঁর গান শুনছি-দেখছি তাও কলকাতায় বসে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী কিছু হতে পারে!
(আরও কয়েকজন সেই অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন, মুগ্ধ করেছেন আগরতলার এক কিশোরী শিল্পী। তার কথা পরে অন্য কোনদিন, অন্য কোন সময়ে।)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০০৭ বিকাল ৫:১০