somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যেখানে আমরা আসলে কোনোদিনই যাইনি...

০৩ রা অক্টোবর, ২০০৭ দুপুর ১২:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তখন আমার বিবাহপূর্ব প্রেমপর্ব চলছে। বেশিরভাগটাই টেলিফোনে। সারাদিন এখানে ওখানে টো টো করে ঘুরে বেড়িয়ে (পড়ুন শ্যুট করে) সন্ধের পর ভালমতন পান-ভোজন করে শরীফ মেজাজে রাত এগারটা-সাড়ে এগারটায় তিনি ফোন করতেন। আর ফোন ছাড়তেন সকালের আলো ফুটলে। আমি মাঝে মাঝেই ফোন কানে ঘুমিয়ে পড়তাম, এই যাহ... ঘুমিয়েই পড়ল! বলে তিনিও ঘুমুতে যেতেন।

বেশ কয়েকদিন ধরেই তিনি বলছিলেন কোথাও বাইরে বেড়াতে যেতে। বাইরে বলতে যে কোন একটা লোকাল ট্রেন ধরে উঠে বসা আর পছন্দমত একটা ষ্টেশন দেখে নেমে পড়া। রিকশা করে খানিক এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে আবার ফেরত ট্রেন ধরে ফিরে আসা। আমি ঠিক সাহস করে উঠতে পারছিলাম না এধরণের অ্যাডভেঞ্চারে অভ্যস্ত নই বলে। কোথাও একটা গেলাম আর আটকে গেলাম তাইলে তো চিত্তির!

টেলিফোনের বিল প্রতিমাসেই উর্ধমুখী দেখে বিয়ের জন্যে বেশ সিরিয়াসলি ভাবনা চিন্তা চলছিল। বিয়েটা যখন করবই তো করে ফেললেই চুকে যায়! এভাবে ফোনওয়ালদের প্রতিমাসে ১২-১৪হাজার করে দেওয়ার কোন মানে নেই! তো আমরা ঠিক করলাম বিয়েটা করেই ফেলি! তো আমরা মোটামুটি বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে সেদিন বেরোলাম বিয়ের ব্যবস্থা করতে। মোল্লা মৌলভি, কোর্ট কাচারি ঘুরে ফিরে ব্যবস্থাদি করতে বেলা দুপুর । ক্ষিদেও পেয়েছে বেশ। ধর্মতলার এক রেষ্টুরেন্টে ঢুকে রুটি-মাংস খেয়ে বললাম, চল একটু বাজারের দিকে। একটু কেনাকাটা তো করতে হবে, বিয়ে বলে কথা! বাজারের দিকে এগিয়েও তিনি বললেন বাজার তো কালও করতে পারবে, আজকে চল না কোথাও একটু বাইরে! মুখের দিকে তাকিয়ে আমার আর না করতে মন সরল না। তবুও বললাম, বেলা দুটো বাজে, এখন গিয়ে ফিরতে পারব? ত্বরিত জবাব এল, হ্যাঁ হ্যাঁ। চল তো! এগোলাম বাসগুমটির দিকে । এই প্রায় বিকেলে লোকাল ট্রেনে প্রচন্ড ভীড় হবে বলে বাসে যাওয়াই সাব্যস্ত হল। সেটা নভেম্বরের শেষ। ছোট দিন, বেলা দ্রুত ফুরিয়ে যায় কিন্তু ঐ মুখের দিকে তাকিয়ে খুব বেশি ভাবনা চিন্তা করতে মন চাইল না সেদিন আর।

যাব কোথায়? বলল, গাদিয়াড়া যাবে? সেখানে গঙ্গা আছে! আমরা যেখানেই যাব সেখানে একটা নদী তো থাকতেই হবে। শহরের এই ভীড়, ধোঁয়া থেকে দূরে, কোথাও একটা খোলা জায়গায়, নদীর ধারে দু'দন্ড গিয়ে বসব এই আকাঙ্খায় চেপে বসলাম এক বাসে। গন্তব্য গাদিয়াড়া। গঙ্গাপারের এক গ্রাম। বাসগুমটির টিকিটবাবুর কাছ থেকে জেনে নেওয়া হয়েছে, যেতে ঘন্টা দেড় লাগবে। মনে মনে হিসেব করে নিলাম, এখন দুটোর একটু বেশি বাজে, মোটামুটি চারটে-সোয়া চারটে নাগাদও যদি পৌঁছুই তো ঘন্টাখানেক সেখানে ঘুরে-ফিরে সন্ধের আগেই ফেরত বাসে চেপে বসা। একটু রাত হয়ে যাবে হয়ত ফিরতে, ঠিক আছে! বাস ছাড়ল প্রায় তিনটে বাজিয়ে।

সকালে বাড়ি থেকে বেরুনোর সময় একটা চাদর কাঁধে ফেলে নিয়েছিলাম, গলায় একটু ব্যথা ভাব আছে বলে। যদিও ঠান্ডা পড়েনি এই নভেম্বরে পড়েও না কিন্তু আমার আবার ঠান্ডা একটু বেশিই লাগে। তাই চাদর, যদি দরকার লাগে ভেবে। বাস শহর ছাড়িয়ে গ্রামের দিকে এগোতেই হাল্কা ঠান্ডা বোঝা গেল। চাদর ভালমতন জড়িয়ে পাশের মানুষটির কাঁধে মাথা রেখে কত কথা যে বলে গেলাম দুজনে। বাস চলছে তো চলছেই। ঘড়ির দিকে চোখ যায় অজান্তেই। পাঁচটা বেজে গেলো! 'হ্যাঁগো, এখানেই তো পাঁচটা বাজল, আমরা পৌঁছুব কখন আর ফিরব কখন?' 'কী জানি, ঐ ব্যাটা তো বলল, ঘন্টা দেড় লাগবে যেতে!' সামনে ছোট্ট এক নদী দেখা যায়, বললাম, এখানেই নেমে পড়ি, খানিক পরে এই রাস্তা থেকেই ফেরার বাস ধরে ফিরে যাব নাহয়! কিন্তু শুনশান জায়গা দেখে নামার সাহস হল না। আবার মগ্ন হই কথায়। বাস চলে। আর চলে।

শীত আসি আসি করছে। শেষ নভেম্বরের ছোট বেলা দ্রুত ফুরিয়ে যায়। সন্ধ্যা ঘনায়। গাদাগাদি ভিড়ের বাস ক্রমশ ফাঁকা হয়ে যায়। মানুষ নেমে যেতে থাকে যার যার গন্তব্যে। আমাদের কথাও কমে যেতে থাকে ক্রমশ। শহর থেকে বহুদূরে কোন এক গাদিয়াড়ার উদ্দেশ্যে বাস এগিয়ে যেতে থাকে গ্রামের পরে গ্রাম পেরিয়ে। কখনো ফাঁকা মাঠের উপর দিয়ে যাওয়া রাস্তা বেয়ে তো কখনো ঘন বসতিপূর্ণ কোন গ্রামের ভিতর দিয়ে। টিমটিমে বাতি জ্বলে ছোট্ট দোকানঘরে। কৃষকের ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে বেরিয়ে আসে হলুদ আলোর ছিটে। রাস্তার পাশে হাত পা ছড়িয়ে কোথাও কোথাও পড়ে আছে খড়ের কাঠামো, দেবীমুর্তির। কোনটা দেবী সরস্বতী তো কোনটা দেবী দূর্গার। ছোট ছোট মন্দির দেখা যায়, কোনটা শিবের তো কোনটা কোন দেবীমায়ের। দ্রুত পেছনে সরে যায় দু'পাশের দৃশ্য। অন্ধকার ঘন হয়।

অবশেষে বাস এক রাস্তার শেষ মাথায় এসে থামল। ঘড়ির কাঁটা তখন ছ'টা ছুঁই ছুঁই। আমার মুখের কথা থেমেছে অনেকক্ষন। টিমটিমে বাতি জ্বলছে খুঁটির উপর শুধু চালের নিচে। দু-একজন যাত্রী, যারা এই শেষ অব্দি এসেছেন তাঁরা দ্রুতপায়ে বাস থেকে নেমে এগিয়ে গেছেন যার যার গন্তব্যে। গুটিগুটি পায়ে আমরা বাস থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করি, কোথায় এলাম। বাস যেখানে এসে থেমেছে রাস্তার সেখানে শেষ। এখান থেকেই বাস আবার ঘুরবে কলকাতার দিকে। ফেরার টিকিট কাটা হোক আগে ভেবে বাসের কন্ডাক্টরের খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেল পাশের চায়ের দোকানে সে গিয়ে বসেছে জুত করে। টিকিটের কথা বলতে জানা গেল এটা লাষ্ট বাস ছিলো, এখান থেকে কোন বাস আজ আর যাবে না। কাল সকাল ছ'টায় প্রথম বাস!

হাতের আঙুল তুলে ও দেখিয়ে দিল ঐ দ্যাখো, নদী! তাই তো! নদী দেখতেই তো এখানে আসা... কিন্তু নদী দেখা গেল না। ঘুটঘুটে অন্ধকারকে যা খুশি তাই বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। আমি তাই ধরে নিলাম সামনের ঐ অন্ধকারই গঙ্গা।

বাকিটুকু অপরজনের ভাষ্যে:-

...রুমাল তুমি হও না দ্রুতগামী বাস, সে রসিক মানুষ বসে হাসবেন কেবল, জালেতে মুখ লাগিয়ে, এই ভাবে দেখলেই আমার ছাগলের সিং ঘষার কথা মনে পড়ে, উপস্থিত বুদ্ধিবিহীন আমি তাকেই বাসের গতিবিধির কথা জিজ্ঞাসা করি, এই তো এই ঘন্টা দেড়, শীতকাল, যদিও সে হরপ্পা সভ্যতার কথা,আমার বান্ধবীটি সারা রাস্তা তার অলঙ্কার ছড়াতে ছড়াতে যায়, যেন রামচন্দ্র আলসেতে বসে দেখে চলেছেন আনাকারেনিনা,আরে আরে আমাদের জন্য মর্তে ধেয়ে আসছেন নদী, সুতরাং গন্তব্যের শেষে একটা নদী থাকবেই, থাকবেই, আরে সে সব টেলিভিশন মার্কা প্রচার নয়, এই তুলির আঁচড়ে পানেসারজি এঁকে দিচ্ছেন নদী...

... অমাবস্যার রাতে ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে পীচের রাস্তাকেও নদী প্রমাণ করতে পারেন নীলস বোর,সুতরাং ফেরার বাস যে এই সাড়ে ছয়টায় পাওয়া যাবে না, জানা কথা, আরে বিধাতা তো সব জেনেই বসে আছেন কি না,আমরা একটা হোটেলে প্রবেশ করি, হ্যাঁ এখানেও কোন প্রাপ্ত বয়স্ক চিত্রমালা নেই,আপনারা উঠেপড়ুন ...

... এবং আমরা ফিরে আসি,কলকাতায়,এই ভাবে সেই ভাবে, 50 কিমি অটোতে ও খুলে যাওয়া শারীরিক যন্ত্রপাতি কুড়াতে কুড়াতে, যাক সে সব গুরুত্ত্বপূর্ণ নয়। আসলে আমার কিছু-কিছু জিনিস ভালো লাগে না, তা শতবার বলেও,লিখেও আপনি বোঝাতে পারবেন না, তখন বেরিয়ে পড়ুন, টাইটানিক চিরকালই ডুবে যায়, ভরসা রাখুন...

ও শ্রেয়াদি, এর চাইতে বেশী লেখা গেল না আজ, কিছুতেই না,বাইরে বেশ বিদ্যুত্ চমকাচ্ছে, অন্ধকার রাস্তায় হু হু , আরে তোমার খেলা তুমি নিয়ে সাজাচ্ছো, বাতাসে বেশ পুজো পুজো ভাব, দোলনায় আরেকটু দুলে নিন মাধবী...

আমাদের গল্পটা-আমাদেরই থাক, তাই জায়গাটার নাম গাদিয়াড়া হোক, যেখানে আমরা আসলে কোনোদিনই যাইনি...
২০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×