Racism এর বঙ্গানুবাদ হয় ‘বর্ণবাদ।’ তবে ব্যাপারটা শুধু গাত্রবর্ণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ- তা নয়। সীমাবদ্ধতাটুকু অনুবাদের, অর্থের নয়। রেসিজম শুধু চামড়ার রঙ না- গোত্র, ধর্ম, পেশা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার মাঝেও সমান ভাবে বিদ্যমান।
জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ড নিয়ে তো অনেক কিছুই দেখে ফেলেছি আমরা; সামাজিক গণমাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, বিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমে এসেছে হাজারো মানুষ। আপামর জনতা প্রতিবাদীদের সহমত আর সহমর্মিতা জানিয়েছে নিহত ফ্লয়েডের জন্য।
খুব বেশি অবাক হবেন, যদি জানতে পারেন আমাদের চারপাশেই শত শত, হাজার-লাখো জর্জ লুকিয়ে আছে? আপনার-আমার ভেতর নীরবে দম বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছেন একের পর এক জর্জ ফ্লয়েড? ফ্লয়েডের ঘাড়ে হাঁটু দাবিয়ে রাখা পুলিশ অফিসারের মতো আরও অনেকেই দাবিয়ে রেখেছে আমাদের ভেতরের মনুষ্যত্বটাকে। ফ্লয়েডের মতো ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড না, পুরো জীবন জুড়েই নানা ভাবে রেসিজমের শিকার হয়েছি চলেছি আমরা।
কীভাবে- তা জানতে হলে আগে বর্ণবাদী মনোভাব প্রকাশের কিছু নিদর্শন দেখে আসি চলুনঃ
প্রথমেই আসি ব্যক্তি-নির্ভর বর্ণবাদের কথায় (Individual Racism)। গায়ের রঙ ফর্সা নয় বলে হেনস্থা হননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বিয়ের সময় ফর্সা পাত্রী আর (মোটামুটি) সুপুরুষ ছেলে না হলে অভিভাবকদের মুখে রুচি আসে না। মেয়ে শ্যামলা কিংবা উজ্জ্বল শ্যামলা হলে তাকে কালো বলতে গিয়ে জিভে আটকায় না বহু মানুষের। আর তার ফায়দা লুটে বিউটি ক্রিম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। আর যদি ভুলেচুকে কালো মেয়ে জন্মেই যায়, সে তো শত জনমের পাপ! ছেলে সিনেমার নায়ক না হোক, মুখখানা সমাজে দেখিয়ে গর্ব প্রকাশের উপযুক্ত না হলে মন খারাপ হয়ে যায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসা লোকদের। ছেলে বা মেয়ে খাটো কিংবা লম্বা- যেটাই হোক না কেন, শারীরিক বৈশিষ্ট্যকে লক্ষ করে ছোঁড়া তীর্যক বাক্য জীবনে কখনও না কখনও সহ্য করতে হয়েছে। প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা কালো হলে বন্ধু-বান্ধবের কাছে লজ্জা পাবার ভয়ে আক্রান্ত হয়নি কেউ, স্ত্রী সুন্দরী কিংবা স্বামী সুদর্শন না বলে আত্মীয়স্বজন বা ভাবীরা মুখ টিপে হাসাহাসি করেনি - এটা বলতে নিখাদ মিথ্যে বলা হয়ে যাবে।
এবার আলোকপাত করা যাক আঞ্চলিকতা ও গোষ্ঠীপ্রীতির ব্যাপারে। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব দেখাবার জন্য কেউ অমুক এলাকার লোক বলে অহংকার প্রকাশ করছে- এমনটা কিন্তু হরহামেশাই দেখা যায়। ঐ মানুষটা তমুক অঞ্চলের অধিবাসী বলে তাকে নিয়ে কখনও ঠাট্টা করা হয়নি- এও বলা অসম্ভব। এগুলো সূক্ষ্ম কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রেসিজম-ই হয়ে যাচ্ছে তা রসিকতায় মশগুল ব্যক্তিটির খেয়ালই নেই, কিন্তু সেই মজাটুকু ভিক্টিমের শরীর-মনে আরও একটা অদৃশ্য ক্ষত তৈরি করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। এখানেই শেষ না- ছেলে বা মেয়েটা দেশের সেরা প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা করতে পারেনি বলে তার শিক্ষার ফেস ভ্যালু কম হয়ে যায়। বন্ধুমহল, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের মনোভাবও খুব একটা ইতিবাচক হয় না তার প্রতি। এই প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ (Institutional Racism) কিন্তু ক্যান্সারের মতো ছড়িয়েই যাচ্ছে কেবল, যা সমাজ কিন্তু বুঝেও বুঝতে পারছে না।
উচ্চবংশের সন্তান, তাই একজনের অধিকার নিম্নবংশের সন্তানটির চাইতে বেশি- এই মানসিকতাও বর্ণবাদেরই বহিঃপ্রকাশ। ‘চৌধুরী সাহেব’-এর মতো পারিবারিক সম্মানের গর্বে অন্যকে পায়ে ঠেলবার মানসিকতা দেখা যায় সমাজের প্রায় সর্বত্র। কাঠামোগত বর্ণবাদ (Structural Racism) দেখতে হাই-পাওয়ারের চশমার দরকার পড়ে না কিন্তু।
একটা মানুষের কাজকে, তার পেশাকে বৈষম্যের আওতায় ফেলে দেয়াও রেসিজমের অংশ। কোনো পেশাকেই ছোট মনে না করবার শিক্ষা প্রায় প্রতিটি ধর্ম আর ইতিহাসে দেখা যায়। কিন্তু মানুষ সেটা ভুলে যায় নৈতিক শিক্ষা বইয়ের পাতা উল্টাবার সাথে সাথেই। পেশাগত কাজের ফলাফলকে প্রয়োজনমাফিক সমালোচনা করা ইতিবাচক কিন্তু পেশাটাকেই হীন ভাববার মানসিকতাটুকু বড্ড নেতিবাচক। অর্গানাইজেশনাল হায়ারার্কিতে একজন পেশাজীবী নিম্নে অবস্থান করেন বলে সমাজে সম্মান প্রদর্শনের মাপকাঠিতেও তার জায়গা নিচেই হবে- এটাকে সভ্যতা কীভাবে বলা যায়? একটু ভেবে দেখুন কীভাবে, কোথায়, কার সাথে এহেন আচরণ করা হয় সমাজে।
‘কেন মা? কেন তুই ওকে বিয়ে করবি না? বাড়ি-গাড়ি, স্ট্যাটাস- কী নেই এই ছেলের?’- ছেলেবেলায় এরকম ডায়লগ বাংলা চলচ্চিত্রে নায়িকার অহংকারী মা’র মুখে বহুবার শুনেছে দর্শকরা। তখন তাকে চক্ষুশূল লাগলেও সমাজে এমন ঘটনা বা এর কাছাকাছি ঘটনা কিন্তু ঘটছে-ঘটবে। কোনটা বুদ্ধিমানের কাজ- অর্থনৈতিক অবস্থানের ভিত্তিতে মানুষকে বিচার করা নাকি ব্যক্তি জীবনে সে কেমন সেটা দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া? নিজের বিবেককে প্রশ্ন করলেই উত্তরটা জানা হয়ে যায়।
আদিবাসীদের নিচু সম্প্রদায় বলে মনে করা, তাদের অচ্ছুৎ ভাবা যে বর্ণবাদ এটা প্রায় সাধারণ জ্ঞানের অংশ। কিন্তু তারপরেও এই বৈষম্য এখনও ‘নাক-বোঁচা’দের যন্ত্রণা দেয়। তাদের উপর চালানো নির্যাতন ও অধিকার ক্ষুণ্ণ নিয়ে সচেতন নন সাধারণ নাগরিকরাই। তাদের পক্ষে কথা বলবার মতো কণ্ঠও শোনা যায় খুব কম।
এবার আসা যাক ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে। এই জায়গাটা নিয়ে কথা শুরু করলে তর্ক ফুরায় না কোনোদিন, ফুরাবেও না। হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের মাঝে উগ্রবাদীরা সদা ও সগর্বে বিদ্যমান। সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার, বৈষম্যের ঘটনা তো এদেশে নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। যা চোখে পড়তে পড়তে অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে বিধায় এখন মোটা চামড়ায় তা স্পর্শই করতে পারে না। পাশের দেশ কিংবা পশ্চিমা বিশ্বে যাবার দরকার নেই, এদিক-ওদিক তাকালেই দেখা যাবে জাজ্বল্যমান বর্ণবাদ দাঁত কেলিয়ে হাসছে। এ প্রসঙ্গে ছোট্ট একটা তথ্য জানা যাক- বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ৩১ হাজারের উপর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অত্যাচার করা হয়েছে, কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাদের ভূমি। ‘অত্যাচার’ শব্দটা অনেক সংক্ষিপ্ত, ভয়াবহতাটা বিস্তৃত।
কেন এত বর্ণবাদী লুকিয়ে আছে আমাদের মাঝে?
প্রথমত, উত্তরটার শিকড় প্রোথিত আছে একদম জন্মলগ্ন থেকে। একটা শিশু-কিশোর এসব বৈষম্যমূলক কর্মকাণ্ড দেখে দেখে বড় হয়, নিজের চারপাশে ঘটতে থাকা ঘটনাকেই স্বাভাবিক-সামাজিক নিয়ম বলে ধরে নেয় সে। যখন তার বুদ্ধি-বিবেচনা পরিপক্ক থাকে না তখনই এই আচরণগুলো সে পরিবার আর সমাজের প্রতিটি স্তরে দেখে, শেখে, নিজের ভেতরে গেঁড়ে বসতে বাধা দেয় না। একজন কিশোর যখন তরুণ বা পরিণত বয়সে উপনীত হয় তখন সে চাইলেও অভ্যাসটা মুছে ফেলতে পারে না। শিরায় শিরায় জমে থাকা ময়লা একদিনে পরিষ্কার করা সম্ভবও না। দ্বিতীয়ত, বর্ণবাদের শিকার হওয়া মানুষটা কিন্তু বিচার পায় না। কারণ গালি দেবার জন্য, নেতিবাচক আচরণ প্রকাশ কিংবা মন্তব্য ছুঁড়ে দেবার অপরাধের কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা বা আইনগত কঠোর শাস্তি ও তার প্রয়োগ নেই। এই চাপা ক্ষোভ সে উগরে দেয় আরেকটা মানুষের উপর। হয়তো অন্য কোনো উপায়ে কিংবা একই রাস্তা অবলম্বন করে। এক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা ছড়াতে থাকে চেইন রিয়্যাকশনের মতো। যার সহিংস-অহিংস দুই রূপই আছে। তৃতীয়ত, বর্ণবাদের সংজ্ঞাই অনেকে বোঝে না। বেশির ভাগ মানুষের বর্ণবাদের প্রশ্নে জ্ঞান চর্চা ও সচেতনতার দৌড় বর্ণবাদ বিরোধী আলোচনা-সমালোচনা পর্যন্তই। কিন্তু বর্ণবাদের সীমানা যে শুধু দেহের রঙে আবদ্ধ না- এই শিক্ষাটা কেউ হাতে-কলমে দিতে আসে না।
তাহলে এর থেকে উত্তরণের উপায় কী হতে পারে?
বাংলাদেশে বসে আমেরিকায় জর্জ ফ্লয়েডের মতো আরও হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা সম্ভব না। আবার পরিবর্তন আনাটা খুব খুব জরুরী। আর সবার আগে সেটার শুরুটা হোক আপনার মাঝে। আগে নিজের পরিবারকে সচেতন করে তুলুন, বর্ণবাদের সূচনা করতে পারে- এমন আক্রমণাত্মক ভাষা ও আচরণ পরিহার করুন ও অন্যকে করতে বলুন, বোঝান যুক্তি দিয়ে, আবেগ দিয়ে। আজকে, এখন থেকেই শিক্ষাটা ছড়িয়ে দিন, যাদের মাঝে ছড়াতে পারেন- তাদের মাঝে বিলিয়ে দিন। একজন মানুষকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে শিখুন। তার গায়ের রঙ, পেশা, জাতি, ধর্মকে দেখে না। নইলে বর্ণবাদের বীজ লুকিয়ে থাকবেই কোথাও না কোথাও। এক কদম না ফেললে দ্বিতীয় কদম ফেলা যায় না। আর সেখানে এটা দীর্ঘ সময়ব্যাপী একটা রেস, ১০০ মিটারের প্রতিযোগিতা নয়। একদিনেই সমাজ পাল্টে ফেলা যায় না, কিন্তু ধীরে ধীরে নিজেকে বদলানো যায়। আর সেই প্রবাদটা মনে আছে তো?
ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ, সাগর অতল।
ছোট ছোট প্রচেষ্টার মাধ্যমেই স্থাপন করা হোক সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত নতুন এক বিশ্ব তৈরির ভিত্তিপ্রস্তর।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:০২