somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইচ্ছে পূরণ

০৬ ই আগস্ট, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আমাদের রেশন নিয়ে আসে যে কপ্টারটা প্রতি সপ্তাহে তার কো-পাইলট আমার বাল্যবন্ধু। ছোটবেলা থেকেই ওর মাঝে নিয়ম না মানার কিছুটা ঝোঁক আছে। ওর কাছ থেকেই শোনা, এখান থেকে ফেরত যাবার সময় ও প্রায়ই অফ রুটে চক্কর কেটে যায়। পরে বেস-এ ফিরে বাসা থেকে আনা খাবার দিয়ে পাইলটকে শান্ত রাখে!
প্রতি সপ্তাহে ওর কাছে নতুন নতুন লোকেশন এর স্বর্গীয় বর্ণনা শুনে এই বান্দরবানটাকেই মনে হয় রহস্যময় অ্যামাজন এর কোন বিচ্ছিন্ন টুকরো। এই যেমন প্রতিদিন বিকেলে কোন এক উঁচু ঝরনাতে নাকি একসাথে দুটো রংধনু দেখা যায়, এক ঝিরিতে জলকেলিরত হাতিরা নাকি গাছের গুড়ি দিয়ে ফুটবল খেলে! এরকম আরও আরও কতকিছু!
প্রতিদিনের একঘেয়ে রুটিন টহলের সময় মনে হয় দলছুট হয়ে যাই। হারিয়ে যাই অজানা কোন পথে।

মনের ইচ্ছেটা যে এত তাড়াতাড়ি পূরণ হয়ে যাবে কল্পনাও করিনি। এইচকিউতে বদলির আদেশটা আজ সকালেই পেলাম। তাই আজই ছিল আমার শেষ টহল। পরিচিত ট্রেইলে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল এক মশা ছাড়া এখানকার সব কিছুই আমি ভালবাসি! ছেড়ে যেতে মন কেমন করছিল। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে দল থেকে পিছিয়ে পড়েছি খেয়ালই করিনি। আরে! এ ট্রেইল তো আমি চিনি না। ভুলপথে অনেকটা চলে এসেছি। ভয়ের কারণ নেই, এরকম মুহুর্তে কী করতে হবে তা মুখস্ত। আর এই ক্যামো ইউনিফর্মে নিজেকে এই পাহাড়-জংগলের একটা অংশই মনে হয়। মশা, হ্যাঁ মশা ছাড়া আর কাউকেই আমি ভয় পাই না। ম্যাপটা একটা পাথরের উপর বিছিয়ে সবে কম্পাসটা বের করেছি(জিপিএস এখনও আমাদের কাছে বিলাসিতা), এমন সময় পিঠে খোঁচা পেলাম।
ঘাড় ঘুরিয়েই বুঝলাম আমি বর্ডার এর সে সব এলাকা গুলোর মাঝে এসে পড়েছি, যেখানে আমাদের যাওয়া আনঅফিসিয়ালি নিষেধ। কোন সন্দেহ নেই আমি এখন বার্মিজ বিদ্রোহীদের জিম্মায়। তবে আশার কথা এই যে, তাদের হাতে কখনও আমাদের সরকারি বাহিনীর কোন ক্ষতি হয়নি।

আমি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালাম। তার আগেই আমার কার্বাইনটা বেহাত হয়ে গেল। অবশ্য ওটার মূল্য একটা গাছের ডালের চেয়ে বেশ নয় এই মুহুর্তে। একটা সুন্দর ছোটখাট ছেলে সোজা আমার বুক বরাবর বেয়নেট উচিয়ে রেখেছে। পিঠে একটা টিনের বাক্স ঝোলানো। পাঁচ জনের একটা টহল দল। সবার পড়নে জলপাই ইউনিফর্ম। অনেকের হাটুর কাছটায় ছেড়া। কারো কারো বুট ছিঁড়ে আঙ্গুল বের হয়ে আছে। একজনের ঘাড়ে গামছা। কেন যেন সাহস পেলাম গামছাটা দেখে। আমার হাত আর চোখ বেঁধে ফেলা হল ঝটপট। তারা কোন কথা বলছে না। পিঠে আবার খোঁচা খেয়ে বুঝলাম হাঁটা শুরু হল।

ঘন্টা তিনেক ট্র্যাকিং করার পর এক জায়গায় থামলাম আমরা। আমার চোখ খুলে দেয়া হল। এটা একটা অস্থায়ী ক্যাম্প। সব মিলিয়ে জনা বার জনের একটা দল। সবার হাতে চাইনিজ মেশিনগান। দুএকটা ইউএস মেড অস্ত্রও দেখলাম মনে হল। আমার পুরো শরীর আবার তন্ন তন্ন করে সার্চ করা হল। এবার এগিয়ে এল সুন্দর ছেলেটা। পিঠে সেই টিনের বাক্সটা এখনও ঝুলছে।
“"আমরা ঝামেলা চাই না। তোমাদের সাথে কোন শত্রুতা নেই।“" স্পষ্ট দক্ষিণি টান। টেকনাফের দিকে যেমন শোনা যায়। আরে এক সেকেন্ড। এটা তো একটা মেয়ে!
“"তোমার কোন ক্ষতি হবে না, যদি যা বলি তাই কর। তোমাকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেয়া হবে।“" মেয়েটা আবার বলে উঠল।
"“তোমার বাংলা খুব ভাল।"“ আমার উত্তর।
“"আমার বাবা বাঙালি। আমি ঢাকায় ছিলাম দেড় বছর।“" শুনে আমি অবাক চোখে তাকালাম।
“"ঢাকায় কী করতে?”"
"“গার্মেন্টসে কাজ করতাম। আমি সুয়েটার বানাতে পারি।“" আমার মুখ হা হয়ে গেল। কৌতুহলে ফেটে পড়ছিলাম। কিন্তু মেয়েটা বলে উঠল,
"“আর কোন কথা নয়। পালাবার চেষ্টা করবে না। তাহলে আমি নিজের হাতে জবাই করব তোমাকে।“" এই প্রথম বাস্তবতা কিছুটা বুঝতে পারলাম। নিরস্ত্র, হাত বাঁধা অবস্থায় পালানোর চিন্তা করাটা পাগলামি হবে।

অন্যেরা বোধহয় বাংলা তেমন পারে না। আর কেউ কথা বলতে এল না। শুধু একবার একটা মাঝবয়সি লোক কলাপাতায় কিছু ভাত আর কলার তরকারি দিয়ে গেল। বুঝতে পারছি আমাকে তারা একটা বাড়তি ঝামেলা ছাড়া আর কিছু মনে করছে না। বাংলাদেশ আর্মিকে চটানোর কোন ইচ্ছে তাদের নেই। আমি শুধু ভুল করে তাদের এলাকায় না চলে এলে আজ এসব কিছুই হত না।
ওদিকে কী হচ্ছে? আমাকে খুঁজতে সার্চ পার্টি বের হয়ে যাওয়ার কথা এতক্ষণে। কিন্তু আমি জানি কাল সকালের আগে কেউ কিছু করতে পারবে না এই দুর্গম এলাকায়।

তখন সন্ধ্যা ছ’টা হবে। কিছুটা শীত শীত লাগছে। কাছে কোথাও থেকে মৃদু কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছে। আবার শুনতে পাচ্ছি। চাঁদের আলোয় সবকিছু অপার্থিব লাগছে। সাতটা নাগাদ আবার মেয়েটা এল। হাতে ঢাকনা দেয়া কেরোসিন ল্যাম্প। দুচোখ ফোলা। এই কি কাঁদছিল এতক্ষণ? হাতে ভাত আর কলার তরকারি। টিনের বাক্সটা এখনও দেখতে পাচ্ছি। এবার আর কৌতুহল চেপে রাখতে পারলাম না।
“"ওই বাক্সটায় কী?”"
এই একটামাত্র প্রশ্নে এমন প্রতিক্রিয়া হল যা আমি ভাবতেই পারিনি। হঠাত মেয়েটার চোখদুটো জ্বলে উঠল। চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠল। মুষ্টিবদ্ধ হাত যেন তীব্র আক্রশে কাউকে পিষে ফেলতে উন্মুখ। কিন্তু এটা ছিল কয়েক মুহুর্তের জন্য। তারপরই একটা বিকট আর্তনাদ করে কাটা গাছের মত এলিয়ে পড়ল মেয়েটা। একটা গাছ ধরে কোন রকমে দাঁড়িয়ে রইল।

আমি কী করব বুঝতে পারলাম না। সত্যিই নিজেকে বোকা বোকা লাগছে। এদিকে শব্দ শুনে দুজন সেন্ট্রি চলে এসেছে। কিন্তু আমার দিক থেকে কোন বিপদ না দেখে আবার নিস্পৃহভাবে চলে গেল। যেন তারা এতে অভ্যস্ত। মেয়েটা এবার একটু ধাতস্ত হয়ে আমার দিকে তাকাল।
“"আমার স্বামী।" বলল মেয়েটা।
“"মানে? মানে তোমার স্বামী কোথায়?”"
"“বাক্সে।"
কিছুটা হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। তারপরই মনে পড়ল, অনেক সম্প্রদায়ে মৃতদেহের ছাই সংরক্ষণ করা হয়। এরকমই কিছু হবে হয়ত।
আমি কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। মেয়েটাই নিরবতা ভাঙল।
"ও ছিল স্বাধীন আরাকান আন্দোলনের কর্মি। গত মে’মাসে ধরা পড়ে বার্মিজ বাহিনীর হাতে। অনেক অত্যাচার করে তারা তাকে হত্যা করে। তার মাথা কেটে ঝুলিয়ে রাখে আমাদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের মাঠে। আমি তখন ঢাকায় পালিয়ে আছি। খবর পেয়ে বর্ডার পার হই। তারপর চুরি করে নিয়ে আসি মাথাটা। তারপর থেকে আমার সাথেই আছে। ওর খুব ইচ্ছে ছিল, স্বাধীন আরাকানেই ওর কবর হবে। আমি তারপর থেকে ওর ইচ্ছে পূরণ করার জন্য লড়াই করে যাচ্ছি।" বলতে বলতে মেয়েটা চোখ জোড়া আবার ভিজে উঠল। এতদিন সামরিক বাহিনীতে থাকার পরও আমার শরীর শিউরে উঠল।

“"কাল সূর্য ওঠার আগেই তোমাকে নিরাপদ এলাকায় পৌঁছে দেয়া হবে। আশা করব তোমাদের আর্মি আর আমাদের খোঁজার চেষ্টা করবে না। বিদায়।" বলে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। আমি মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলাম।

আবার আমি ফিরে যাচ্ছি আমার পরিচিত লোকালয়ে। পরশুর মধ্যে হয়ত থাকব ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের কোন সুরক্ষিত ফ্ল্যাটে। আমার অনেক খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু আমার মাঝে কোন অনুভূতিই কাজ করছে না। বারবার চোখ চলে যাচ্ছে ওই বাক্সটার উপর। ওখানে কেউ একজন অপেক্ষা করছে তার একটা ইচ্ছে পূরণ হবার জন্য। এই অপেক্ষা কত লম্বা হতে পারে আমার কোন ধারনা নেই। কিন্তু আজকের রাতটা আমার জন্য অনেক লম্বা হতে যাচ্ছে; কোন সন্দেহ নেই।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:৪৬
৯টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×