somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রুপোষ

১০ ই এপ্রিল, ২০১৩ দুপুর ১২:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



অনেক কষ্টে পাওয়া টিকেটটা বুকের বাঁদিকটায় আবারো অনুভব করে ইরফান। খড়খড়ে, খচমচে কাগজটা বারবার ছুঁয়ে দেখার আগে একটা হিমশীতল ভয়, অনিশ্চয়তা কাজ করে তার ভেতর। আছে তো ওটা? ঠিক আছে তো? স্পর্শটা বারবারই ফিরিয়ে দেয় তাকে অবিশ্বাস্য বাস্তবতায়।

বহু বাধা ঠেলে, বহু স্বপ্নের দিনের কল্পনার নৌকা ভাসিয়ে শেষমেষ আজ তার দেশ পৌঁছেছে স্বর্গের...নাউজুবিল্লাহ...বেহেশতি মেওয়ার কাছাকাছি। কেউ কি ভেবেছে তার দেশ আজ পৌঁছুতে পারবে অকল্পনীয় চূড়ার একটা ধাপ মাত্র দূরে? মনে মনে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে বারংবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে সে পারে না। সেই সাথে শেষতম ধাপটা যেন পেরোয় সেই কামনাও জানিয়ে রাখে সে। যদি সেটা হয়েই যায়, কিভাবে তার হৃদয়ের আবেগ আর ভক্তি জানাবে, সেই চিন্তাতেও সে মশগুল হয়ে পড়ে। আরেকটা খুবসুরত মুখও ভেসে ওঠে মনের আয়নায়, কিন্তু নফসকে প্রবল শক্তিতে দমন করে সে। শুধু যদি একবার...যদি একবার...

তার দেশ উঠেছে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে।

এখান থেকে আর পেছনে নামার যেহেতু সুযোগ নেই, তাই এই অবস্থানটায় তার গর্ব আর স্বস্তির আগুনে সে বাতাস দেয় আরেকবার, বুকটা ফুলিয়ে শ্বাস নেয় বার কয়েক। কতো চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এখানটায় এসেছে তারা। পথক্লান্ত অথচ আত্মতৃপ্ত শেরের মতো এবার সব শক্তি জড়ো করে তার দল প্রস্তুত মরণকামড়ের জন্যে। নিজের চোখে এই সুদুর্লভ, বহুবাঞ্ছিত ব্যাপারটা দেখার জন্যে কতো কাঠ আর কতো খড় পুড়িয়ে যে সে এই টিকেটটা হাতে পেয়েছে! মাদ্রাসায় অন্তত চারটে মাস পড়ার খরচ আর শ্রম গেছে এর পেছনে। একটু শিউরে ওঠে সে। কিছু স্মৃতি মুছে ফেলা যাবে না।

বিপক্ষ দল খুবই শক্তিশালী। কিন্তু তাদের মতো ইমানি তাগদ যে ওই কাফিরগুলোর নেই, সে আর বলতে। দুঃখের বিষয়, পরওয়ারদিগারের পক্ষপাত দেখলে ইমান কখনো কখনো কমজোর হয়ে আসে, ক্ষোভে ফুঁসে উঠতে চায় সিনাটা। গতবার প্রথম রাউন্ডে প্রায় পুরো দেশই ইবাদতে নেমেছিলো, সালাত আদায় করেছিলো, রোজাও রেখেছিলো কতজন। কিন্তু, বেশি দূর পারলো না যেতে। বাঞ্চোত মালাউনদের কাছে হার মেনেছিলো তারা।
ইয়াল্লা! ওই জন্মশত্রুদের কাছে! আল্লাহতা'আলার কি একটুও রহম নেই, রহমানুর রাহিম তিনি। এতো নওজোয়ান, ইমানদার বান্দাদের এতো করুণ আর্তনাদে তাঁর আরশ কি কেপে ওঠে নি একটুও?

অবশ্য এবার সবটাই পুষিয়ে দিয়েছেন তিনি। কে বোঝে তাঁর অপার করুণা। সুসময়ও তিনি দেন সময় বুঝেই। তাই তো সারা দেশ তাঁরই নির্দেশনায় চলে আজ। দুনিয়ার বুকে আজ তারা জ্বলন্ত এক দৃষ্টান্ত ইমানি জজবার, শরা'য়ি রাহবারের, জিহাদি জোশের।

তবে কোন না কোন উসিলাও খুঁজে নেন পাকপরওয়ারদিগার।

এবার যেমন নিয়েছেন দলের ওই ছেলেটাকে, রুপোষ রহমান।

রুপোষ যে কারোর নাম হতে পারে ভাবাই যায় না। অনেকে বেশ মজাও করে ওটা নিয়ে। ছেলেটা কথা বলে বড্ড কমই, তাই তার এই নামকরণের উৎস জানা যায় নি। তবে নাম দিয়ে কী আসে যায়! বেড়াল যে-রঙেরই হোক, চুহা হাসিল করতে পারলেই হলো।

এবার যে তারা ফাইনালে উঠতে পেরেছে, তার জন্যে রুপোষের ভূমিকা অসীম। বলতে গেলে এই বিশ্বকাপের সাতটা খেলার ভেতর অন্তত তিনটে সে একহাতেই জিতিয়ে এনেছে।

দুর্দান্ত তার বোলিং ক্ষমতা!

সাত ম্যাচে তার উইকেট সতেরোটা, সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী সেতো বলাই বাহুল্য। এছাড়া তার গড় ১৬.৭০, রানরেট ২৯.৭০! মাত্র চার বছরের ফার্স্টক্লাস ক্যারিয়ারে এমন দারুণ পরিসংখ্যান ভাবাই যায় না, তারওপর এটা তার প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ।

আজ অনেকটা তার ওপরেই নির্ভর আর বিশ্বাস। জাঁনিসার করে দেবে সবাই, সে জানা কথা। কিন্তু, আজ রুপোষের জিন্দগির সেরা দওড়টা দিয়ে বের করে আনতেই হবে খেলাটা, সেই মেকদার আছে তার।

সবাই জানে, সে কাজটা করবেই। কওমের প্রতি, দেশের প্রতি তার আন্তরিকতার একটি বিন্দু ঘাটতি নেই।

দেখা যাক, কী হয় আজ।

দল নেমেছে মাঠে।

দর্শক গ্যালারি থেকে চিৎকার উঠছে, "রুপোষ, রুপোষ"। সবার তামান্না যেন উচ্ছ্বসিত শব্দে রূপ নিয়েছে। প্রচণ্ড উদ্বেগ, উত্তেজনা আর উন্মাদনা গর্জনের নিচে চাপা দেওয়ার অদম্য ইচ্ছে সবার ভেতরে।

রুপোষের মুখ বরাবরের মতোই নির্বিকার, ভাবলেশহীন। ছেলেটা আসলেই অদ্ভুত। ভাবে ইরফান। কোন সাক্ষাৎকার দেয় না, কোথাও যায় না সাধারণত, এমনকি ছবিও তুলতে দিতে চায় না। অবশ্য ছবির চল এমনিতেই কম দেশে।

টসে জিতেছে তারা।

সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাটের।

দুই ওপেনারের মধ্যে আহনাফ মারকুটে আর ফায়রুজ ঠান্ডা মাথার, কপিবুক স্টাইলে খেলে মূলত। তবে হাতে তারও শট কম নেই।

প্রথম ওভারের প্রথম বলটা গুড লেংথের। অফ স্টাম্পের ছ'ইঞ্চি বাইরে চলে গেলো বেশ আউটস্যুইং করে। ছেড়ে দিলো আহনাফ বলের ওপর চোখ রেখে।

পরেরটা থ্রি-কোয়ার্টার, বল ভালোই আসছে ব্যাটে। একটু পিছিয়ে আহনাফ পেছনের পায়ে ভর দিয়ে কব্জির মোচড়ে সটান স্কয়ার লেগের একটু দেরিতে আছড়ে-পড়া ফিল্ডারকে ফাঁকি দিয়ে বল ছুটলো ডিপ স্কয়ার লেগ হয়ে বাউন্ডারি দড়ির বাইরে।

পুরো স্টেডিয়াম উন্মত্ত হয়ে উঠেছে সব কিছু ভুলে। যেন তাদের দেশে কোন দুর্নীতির মহোৎসব নেই, নেই কোন ধর্মীয় বিধিনিষেধের কালাকানুন, নেই জীবনযাত্রার কষ্টকর পথহাঁটা।
ইরফানও লাফাচ্ছে জনতার জোয়ারে ভেসে। চিৎকার করছে, "মারহাবা, বারদিগর, জাঝাকাল্লাহু খায়েরান..."।

তৃতীয় বল। অফ স্টাম্পের ওপরই। ব্যাটটা একটু উঁচু করে সামনে সামান্য ঝুঁকে ডিফেন্স।

চতুর্থ বলটা বেশ একটু বাইরেই পিচ করেছে। প্রায় কাঁধের কাছে ব্যাটটা বলে ছুঁইয়ে বলের গতিটা ব্যবহার করেই আহনাফ দিকটা পালটে দিলো গালি আর থার্ড ম্যানের মাঝামাঝি ফাঁকা জায়গাটায়। আবারো বল নক্ষত্রবেগে ছুটলো থার্ড ম্যানের ছুটন্ত ও ঝাঁপানো ফিল্ডারকে হতাশ করে আর উল্লসিত চিৎকারের জন্য অপেক্ষমাণ জনতার কণ্ঠ উন্মুক্ত করে।

পঞ্চম বল। থার্ডম্যানে স্টিয়ার করে একটা রান।

শেষ বল ফাইনালের প্রথম ওভারের।

বলটা একটু শর্ট পিচ ছিলো। ফায়রুজ বেশি সময় নিলো না পেছনের পায়ে ভর দিয়ে পুল করে মিড উইকেট দিয়ে আরেকটা চার হাঁকাতে।

প্রথম ওভারেই তের রান! কী অসাধারণ! স্টেডিয়াম জুড়ে তুমুল তাথৈ। ইরফান নাচানাচির ভেতরও টের পায় তার বুকের ভেতর একটা ছোট্ট খালি জায়গার গভীরতা, কেউ পাশে থাকলে কী ভালো লাগতো তার। কিন্তু এখানে তো সম্ভব নয়, কোন মেয়ের পক্ষেই সম্ভব নয় এখানে আসা। হায় আশা...

ভালোই খেললো তারা। কুড়ি ওভার পেরিয়ে তাদের সংগ্রহ দাঁড়িয়েছে ১৯৫/৫। আহনাফ হাঁকিয়েছে ৫৭, বল ব্যয় করেছে ৪৮টা। রাহিল ২৫, ৩৩ বলে। অধিনায়ক বাসাম-এর উইলোতে এসেছে ৪৪, ৫২ বলের খরচায়।

আশা বহ্নিমান। স্বপ্ন প্রজ্জ্বলন্ত। উচ্ছ্বাস নির্বাধ।

শুরু হচ্ছে শেষার্ধের শূন্যস্থান পূরণ।

মাঠ জুড়ে অনন্ত আপ্লুত আবাহন, রুপোষ, রুপোষ, রুপোষ। এই আকুলতা শুধু একটা খেলায় জয়ের নয়। এই ব্যাকুলতা অন্ধকারের অতল গহ্বর থেকে বেরুনোর, এই উন্মাদনা জাতীয় ব্যর্থতা ভুলে নতুন আলোয় একটু জেগে-ওঠার, এই কাতরতা অনন্যশরণ হয়ে অন্তত কিছুতে জয়ের আত্মবিশ্বাস জন্ম দেয়ার।

প্রথম ওভার আলবুকার্ক-এর।

প্রথম বলটা মিডল স্ট্যাম্পের ওপরেই ছিলো। খুব খাটো লেংথেরও বলা যাবে না। ওপেনার থিরুমল বুঝিয়ে দিলো কেন তাকে টি-টোয়েন্টিতে এতো ভীতিকর বলে মনে করা হয়। স্রেফ সামনের পায়ে ভর রেখে একটা সোজাতম ব্যাটে অবহেলায় বোলারস ব্যাক ড্রাইভ, শটটা নিয়ে সে ব্যাটটা কিছুক্ষণ সর্বশেষ ভঙ্গিতে ধরে রাখলো পিচের সাথে ষাট ডিগ্রি কোণ করে। বলটার ডানা গজালো চকিতেই। বিস্ফোরণ ঘটালো সাদা পিণ্ডটা গ্যালারিতে, রানের খাতায় সর্বোচ্চ সংখ্যাটা যোগ হচ্ছে, নিশ্চিত।

প্রথম ওভার শেষে ভরপেট হতাশা ইরফানদের মুখে আর বুকে। ওদিকে স্কোরকার্ড আর তাদের বিপক্ষের গ্যালারিতে বলাকার ছোঁয়া। প্রথম ওভারেই ১৯টা রান!

ইরফানেরা দোজাহানের মালিকের কাছে উদ্ভ্রান্ত বুনোহাঁসের মতো পাখা ঝাপটায়, দিক খোঁজে। ভরসার নোঙর নামাতে চায় গভীরে।

নির্ভরতার পুরনো প্রতীক হিসেবে রুপোষের হাতে দ্বিতীয় ওভার তুলে দিয়েছে অধিনায়ক।

গ্যালারিতে তরঙ্গ উঠছে নির্ভরতার জোয়ারের অদম্য শব্দের, রুপোষ, রুপোষ, রুপোষ।

বাসাম রুপোষের সাথে কিছু বাগবিনিময় করলো। ফিল্ডিং সাজিয়েছে সে চারজন অনসাইডে রেখে। একটু ঝুঁকি নিচ্ছে সে। রুপোষ বল করবে রাউন্ড দ্যা উইকেট। থিরুমলকে আটকাতেই হবে। গত ওভারের উনিশ রানের ভেতর সে-ই নিয়েছে পনেরো।

ছুটছে রুপোষ তার প্রথম ওভারটা শুরু করতে। প্রতিটা পদক্ষেপের সাথে সাথে বুনো দর্শকেরা ছুঁড়ে দিচ্ছে আশাবাদী ধ্বনি, তার বিরলতর নামটা উচ্চারণ করে।

সাত পায়ের মাঝারি দূরত্ব পেরিয়ে রুপোষ তার পোষমানা বলটা ছুঁড়লো সাদা বল্লমের গতিপথে। গুড লেংথের বলটা ইন সুইং করে অফ স্টাম্পের ওপরে যাওয়ার সময় পিছিয়ে থিরুমল একটু বেঁকে, একটু হেলে সজোরে স্কয়ার কাট করলো।

বারুদ ছাড়াই বলটা দিব্যি কাভার পয়েন্টের পথ ধরে চার লাফে অতিক্রম করে গেলো ডিপ কাভারের সীমানা।

বিপক্ষের গ্যালারি তারা ঝলমল, হাসি উন্মাতাল। ইরফানেরা চুপসে গেছে স্যালাইনের খালি খোসার মতো।

কিন্তু বিশ্বাস হারায় নি বাসাম-রা। বরং করতালি দিয়ে তাকে স্বাগত জানালো তার সহক্রীড়কেরা।
দ্বিতীয় বল।

এবারও গুড লেংথ থেকে অফ স্টাম্পের ওপর। দেখে শুনে ছেড়ে দিলো ব্যাটসম্যান বলটা।

একটু যেন আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে খেলোয়াড়েরা আর সমর্থকেরা। শংসাশব্দে আবারো ভরিয়ে তুলছে তার ছুটন্ত গতিরেখা।

এবারের বলটা বেশ জোরেই ছুটেছে আউট সুইং করে একটু বাইরে বেরিয়ে যেতে। বেরুনোর মুখেই সামান্য খোঁচা দিয়ে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টের কাছাকাছি ঠেলে দুটো রান তুলে নিলো থিরুমল।

চতুর্থ বলটা প্রায় সরলরেখায় অফস্টাম্পের ওপর, হয়তো ছেড়ে দিলে স্টাম্পটাই মুড়িয়ে দিতো। কিন্তু ব্যাটসম্যান চোখধাঁধানো এক কাভার ড্রাইভে কাভারের ফিল্ডারকে নড়তে না-দিয়েই বলটা ছোটালো চারের বাড়িতে।

এর পরের বলটা করার আগে কপালের ঘাম বাঁহাতে মুছে নিলো রুপোষ। বাদামি মুখটা এখনো নিশ্চিন্ত। দৃঢ়, অদম্য মনোবলের ছাপ সেখানটায়।

এবারও ডট।

শেষ বল। রুপোষ চারপাশটা একটু দেখে নিলো।

ছোট্ট লেগকাটার। ডিফেন্স আর ব্যাট ফাঁকি দিয়ে অফ স্টাম্পের ওপরের বেলটা ধাক্কা দিয়ে বলটা ছিটকে কোথায় গেছে সেটার খবর নেয়ার সময় বা সুযোগটা আর থাকলো না কারোর। দলের সবাই বুলফাইটের এরিনার ভেতরকার অন্ধ খুনে ষাঁড় হয়ে ছুটে আসছে রুপোষ-কে তুলে নিতে।

সারা খেলায় মাত্র চারটেই ওভার তার। কিন্তু রুপোষ যেন সেসবে নিংড়ে দিলো তার আত্মা, শয়তানের কাছে বাঁধা দিয়েছে কি সে?

বল তার হাতে আগুনের কৌশলী তোপ, দাগছে সে নির্মমভাবে। কখনো লাফিয়ে উঠছে সেই সাদা বিদ্যুৎ, কখনো স্রেফ পিচের মাটিবালু ঘষে প্রায় মাটির সমান্তরাল সেই নিঃশব্দ ঘাতক বিপক্ষের প্রাণবায়ু শুষে নিচ্ছে, কখনো আচমকা বিষাক্ত এ্যানাকোন্ডার মতো হানছে ওজনদার মারণ আঘাত।

এমনকি ফিল্ডিংয়েও সে অতুলনীয় আজ।

দরিয়ার দানো হয়ে অনায়াসে সাঁতরে যাচ্ছে দূরত্ব, বাজ হয়ে ছোঁ মেরে তুলে নিচ্ছে সীমানাবিরহকাতর বলটা, দুহাতের ডানা ছড়িয়ে বুকে তুলে নিচ্ছে বলটা পরম মমতায়। তার এই উগ্র প্রাণময়তা ছড়িয়ে পড়েছে অন্যদের ভেতরও। বিপক্ষের সাধ্য কি তাদের সাথে টক্কর দেয়!

শেষ উইকেটটা পড়লো রুপোষের হাতেই। তার দল আর দেশের সবাই ওই মুহূর্তে সেটাই চাইছিলো। বলটা কুড়িয়ে নিলো রুপোষ। চোখে তার আনন্দাশ্রু, কঠিনতার খোলস ছেড়ে সে এক লহমায় সাধারণ একজন যুবকে পরিণত হয়েছে সে।

আর ইরফান ঠিক জানে না সে কী করবে। সারাদেশের দুর্ভাগা মানুষগুলোর সব বিপন্নতা ভুলে এই অর্জনের মাহেন্দ্রক্ষণে সেও ভেসে যাচ্ছে, ভুলে যাচ্ছে, সব কিছু তুচ্ছ করে তার শুধু মনে হচ্ছে, এই নিমেষ জেগে থাক চিরকালের মতো। কখনো যেন ম্লান না হয়, মুছে না যায়, হারিয়ে না যায় এই সময়।

পুরস্কার বিতরণীর আসর।

ম্যান অব দ্য সিরিজ ঘোষণার পালা। রুপোষ। ম্যান অব দ্য ম্যাচ। সেও রুপোষ।

রুপোষকে কিছু বলার সুযোগ দেয়া হলো। সারা জাতি আজ দুচোখ ভরে, দুকান ভরে চেয়ে আছে তার দিকে, অকল্পনীয় বিজয়ের স্বপ্নসারথির দিকে। সবটুকু উজাড় করে দিয়ে যে দেশকে অবিস্মরণীয় আনন্দমুহূর্ত উপহার দিয়েছে, তার মুখ থেকে যা-ই আসুক, সেটাই হবে তাদের উপাদেয় ভোজ্য, তৃষ্ণার অমৃত।

মাইকটা মুখে ধরে নাসারাদের ভাষায় রুপোষ শুরু করলো তার অবিচল, জোরালো, স্পষ্ট ভাষণ।

"আমি নাস্তিক।"

বিমূঢ় দেশ আর দর্শক আর আবিশ্বমণ্ডল। পৃথিবীর আবর্তন যেন গেছে থেমে। আদ্যোপান্ত ধর্মভিত্তিক একটা দেশের নাগরিক হয়ে সে যে এই কথাটা বলবে, সেটা কেউ এখনো বিশ্বাস করে নি। হয়তো ভাবছে ভুল শুনেছে তারা। নিস্পন্দ ও বজ্রাহত সমর্থকদের খোলা কানে সে গড়িয়ে দিচ্ছে তার গোছানো বাক্যবন্ধ।

"বাবা আমায় খেলা শিখিয়েছিলো, স্বাধীনভাবে চিন্তা করতেও। বোলিং করতো বাবাও। এমনকি জাতীয় পর্যায়ের কাছাকাছিও গিয়েছিলো। দিনের পর দিন কিভাবে লক্ষ্য ঠিক রেখে অবিচল থেকে বোলিং তীক্ষ্ণধার করে তুলেছিলো বাবা, সেই গল্প আমায় শুনিয়ে উদ্দীপ্ত করতো। আমায় প্রেরণা দিয়ে গেছে অবিশ্রাম। দেশকে অসম্ভব ভালোবাসতো বাবা। বিদেশ থেকে পড়াশুনো শেষ করে মা-বাবা দুজনেই দেশে ফিরে এসেছিলো এখানে থাকবে বলে, কিছু দেবে বলে। খোলা মন নিয়ে সব যাচাই করে দেখতো, কিন্তু দেশে থাকতে পারে নি শেষমেষ।

শুধু মনের কথা, নিজের বিশ্বাস বলার জন্যে নির্যাতনের ভেতর দিয়ে যেতে হয় আমাদের পুরো পরিবারকে। শেষে টিকতে না পেরে আমরা সবাই বাইরে চলে গেলাম। পরিচয় বদলে নিলাম যেন কেউ আমাদের খুঁজে না পায়। তারপর...ক্রিকেট ভালো করে শিখে আমি অন্য পরিচয়ে দেশে ফিরে এলাম।

বাবারা যেমনটা চেয়েছিলো, দেশটা তেমন হয় নি। সম্পূর্ণ উল্টো দিকে গেছে এর নিয়তি। কিন্তু, তারপরও বাবা বলতো, আশা না ছাড়তে। লড়াই করে যেতে।

আমি করে গেছি। বাবা দেখে যেতে পারে নি।

আমার আজকের পুরো কৃতিত্ব, আমার দলকে, দেশকে জেতানোর পুরো অবদানই আমার বাবার। আমার হাত দিয়ে বাবাই খেলে গেছে দেশটা বাঁচাবে বলে, যেরকম লড়াই করেছিলো বেঁচে-থাকার সময়ও।

আমি জানি, আজকের পর আমি দেশে থাকতে পারবো না, হয়তো বেঁচেও থাকবো না। তাতে কিছু আসে যায় না। আমার দায়িত্বটা পালন করেছি আমি। বাবাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি দেশের সবচেয়ে বড় একটা সম্মানের সামনে। দেশপ্রেম আর ধর্ম-দুটো বিরোধী নয়, কখনোই ছিলো না, হয়তো এটা আমি আজ প্রমাণ করতে পেরেছি।"

সঞ্চালক যেন মোহমুগ্ধ হয়ে যন্ত্রের মতো প্রশ্ন করলো, "আপনার আসল নাম? আর আপনার বাবার নাম?"

"ঋক। বাবার নাম রাসেল পারভেজ।"

[বন্দী ব্লগার রাসেল পারভেজের জন্মদিন আজ। গল্পটা তাঁকেই উৎসর্গ করা হলো।]
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×