ঘড়িতে রাত দু'টার বেশি, প্রাইভেট হোস্টেল কাম মেসে রুদ্রের ফোন বেজে উঠল। এমন ফোনে মানুষ যতটা বিরক্ত হয় তার চাইতে বেশি হয় চিন্তিত। বিপদের বা অশুভ কোন খবরের ভয়ে ।
- হ্যালো? কে?
- আপনি ফোন ধরলেন কেন?? আমি গানটা শুনছিলাম ! !
- মানে?? কি গান শুনছেন??? কই গান শুনছেন??
- আপনার মোবাইলের ওয়েল-কাম টোনটা শুনছি। খুব সুন্দর গান। কে গেয়েছে??
- ওই মাইয়া, ফাইজলামি লাগে? রাইত দুইটায় কল দিয়া গান শুনতে ইচ্ছা হয়??? নেট থেইকা নামায়া শুনলে কি গুনাহ হয়???
- আমার কম্পিউটার নেই, আর মোবাইলেও নেট ব্রাউজিং করা যায় না। আর আম্মুও বেশি টাকা দেয়না। তাই এমনটা করলাম। সরি ! ! !
রুদ্রের মনটা কেমন জানি হয়ে গেল। অতীত ভেসে উঠলো চোখের সামনে।
এসএসসি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেই বাসার সবার বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের মেধাবলে রুদ্র ঢাকার স্বনামধন্য কলেজে ভর্তি হয়। বিত্তবান বাবা চাননি ছেলে তাকে ছেড়ে দূরে যাক। তবুও রুদ্র ঢাকায় পড়তে আসে। কমলাপুরে কলেজের পাশে একটা হোস্টেলে উঠে। গোপনে মা যে টাকা পাঠাতো, তা দিয়ে থাকা-খাওয়া কোনমতে চলে যেত। কিন্তু ঢাকা বড় চালু জিনিস, চলতে গেলে আক্ষরিক অর্থেই এখানে টাকা লাগে। কলেজের বেতন, বই, হালকা নাস্তা বা প্রাত্যহিক সামগ্রী কেউ কাউকে দেয়না। তাই রুদ্র ঢাকায় এসেই টিউশনি শুরু করে, সাথে একটা কোচিং এ ব্যাচ পড়ানো। সকালে কলেজ, দুপুরে কোচিং এ ব্যাচ আর সন্ধ্যায় টিউশন। রাতে নিজের পড়া। প্রতিটা দিন রুদ্রের যুদ্ধ চলে।
কিন্তু গভীর রাতটা রুদ্রের নিজের। রুমের বারান্দায় তার প্রিয় গীটারটায় সুর তুলে রুদ্র গেয়ে যেত তার প্রিয় গানগুলো।
হঠাৎ করেই ছবি তোলার প্রতি ঝোঁক সৃষ্টি হয় রুদ্রের, বিধাতা তাকে এবার নিরাশ করেননি। গুরু পেয়ে যায়। এমন এক গুরু যিনি পুত্রস্নেহে জীবন থেকে সময় থামানোর মন্ত্র দেয় রুদ্রকে।
এরপর আবার তার জীবনে আসে তার দাদা, ক্যামেরার অভাবে কাজ করতে না পারা রুদ্রের হাতে তুলে দেয় নিজের পুরানো রীল এসএলআর ক্যামেরাটা। চিত্রশিল্পী সেই দাদা বুঝতে পেরেছিলেন রুদ্রের তৃষ্ণা। মোড় ঘুরতে থাকে রুদ্রের জীবনে.....
- হ্যালো, আমি সরি, আর ফোন করবো না।
- না না, আমি সরি, এভাবে বলা ঠিক হয়নি, তুমি যখন খুশি ফোন দিয়ে গান শুনবে, আচ্ছা??
- থ্যাংকস... কিন্তু ফোন ধরবেন না খবরদার ! ! !
এভাবে দিন গড়িয়ে মাস, মাস গড়িয়ে বছর যায়, প্রতিরাতে ফোন আসে, যা রুদ্র রিসিভ করে না, গানটাও পাল্টায় না। তাদের মাঝে কথাও হয়না। রুদ্র বা মেয়েটাও কেউ কাউকে চেনে না, হয়তো ! ! !
এক রাতে রুদ্র গীটার রেখে সিগারেট ধরানোর সময় মেসেজ এল-
" ফোন রিসিভ করো"
রুদ্র ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে শুনতে পেল,
- তুমি কি আবার তোমায় নিয়ে গল্প হোক গানটা গাইবে?? গীটার ছাড়া, খালি গলায়??
চমকে উঠে রুদ্র আশেপাশে খুজতে থাকে, কোথায় সে, কে সে, কি নাম তার ? ? ?
- সামনের বিল্ডিঙের ৩ তলায় তাকাও?
রুদ্র তাকাতেই দেখতে পায় সেই অজানা মানুষটাকে, সেই শ্যামলা মেয়েটা, যাকে সে হাজারবার বৃষ্টিতে ছাদে বা রাস্তায় ভিজতে দেখেছে, কখনো বা ফুচকা, কখনো বা ছাদ থেকে অন্যের আঁচার চুড়ি করে খেতে দেখেছে, কখনো বা কবুতর নিয়ে খেলতে। কতবার ভেবেছে রুদ্র, একটা ছবি তুলি, কিন্তু যতবার চেষ্টা করেছে, ততবার শাটার, অ্যাপারচার মিলিয়ে এক্সপোজারই ঠিক করতে পারেনি, তাল-গোল পাকিয়ে একাকার করেছে। কর্ণের ন্যায় গুরুবিদ্যা লোপ পেত রুদ্রের।
সেবার রুদ্র প্রথমবারের মতো নিজের গলা শুনে চমকে উঠে, ভারি, পুরুষালী গম্ভীর গলায় গেয়ে উঠে রুদ্র।
গান শেষে রুদ্র মেয়েটাকে আর দেখতে পায়নি। সারারাত না ঘুমিয়ে থেকেও কিভাবে যেন ভোরে ঘুমিয়ে পরে সে, বেশ বেলায় উঠেই লাফিয়ে বারান্দায় গিয়ে দেখে কেউ নেই, নিচে নেমে কিছু না বুঝে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে, মেয়েটার মান "মানসী"। লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত মেয়েটা আজ সকালেই চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে গেছে। আশেপাশের মানুষদের বলতে শুনল, বাচবে না মানসী।
রুদ্রের সব এলোমেলো হয়ে যায়, তাও সে আশায় বুক বেঁধে বসে থাকে। দিন গড়িয়ে আবার মাস গড়ায়।
একদিন রাত দু'টায় মানসীর বাসার সামনে একটা এ্যাম্বুলেন্স এসে দাড়ায়। রুদ্র দৌড়ে নিচে নেমে শুনতে পায়, মানসীর শব নিয়ে এসেছে এ্যাম্বুলেন্সটা।
রুদ্র নিজের রুমে ফিরে গিয়ে তার ক্যামেরাটা কাঁধে ফেলে হেটে চলে চিরচেনা রাস্তায় অচেনা গন্তব্ব্যে......
মানসীর মৃত মুখ রুদ্র দেখেনি। কেননা রুদ্রের স্মৃতিতে মানসীর বৃষ্টিভেজা মুখটাই বেশি সুন্দর আর জীবন্ত, সেখানে রুদ্র মৃত মানসীর স্মৃতি রাখতে চায়নি। তার স্মৃতিতে মানসী বেঁচে থাকুক প্রাণবন্ত সৌন্দর্যে।
রুদ্রের শিল্পে মানসীর সৌন্দর্যই প্রতিফলিত হোক......
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ১০:২৫