somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"বাছুরি" গল্পের আকারে সত্যি কাহিনী।

২৮ শে নভেম্বর, ২০০৯ রাত ২:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[কুরবানি নিরুৎসাহিত করবার জন্য লেখাটি লেখা হয়নি। নিতান্তই বন্ধুর অতীতের একটি কাহিনীকে গল্পের আকারে সাজানো হয়েছে। এর পরেও কেউ মনে দুঃখ পেয়ে থাকলে সবিনয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে নিচ্ছি]



বাড়ির ছোট ছেলেটি তখন বছর খানেক হয়েছে। ওদিকে বাজারে গুড়ো দুধের আকাল। বেশি দামে যাও পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেও ভেজাল। গৃহকর্তা অবস্থা সম্পন্ন মানুষ। তাই গিন্নিমা আর আত্মীয় স্বজনের পরামর্শে একটা দুধেল গাভি কেনাই সার্বস্থ হলো।

কিন্তু খোদ ঢাকা শহরে গরু দেখভাল করবেটা কে? বিঘা খানেকের জমির বাড়িটির আর্ধেকটাই উঠোন। সেখানে সব রকম ফলের গাছ। গিন্নিমার গাছ লাগানোর শখ তো ছিলই, সাথে কর্তার মায়েরও আদেশ ছিল যেন বাড়িটা গাছ গাছালিতে ভর্তি থাকে। সেখানে দিব্যি একটি গরু চড়ে খেতে পারে।

টাকা থাকলে সবই সম্ভব। পুর্ব কোনে টিনের চালের গোয়াল ঘর তৈরি হলো। পাশে একটি খড়ের গাদা। মাইল খানেক পরে যে বস্তিটা আছে, সেখান থেকে জোগাড় হলো গরু দেখভাল করার মনিষ। একজন গোয়ালাও পাওয়া গেলো। মোদ্দা কথা সব আয়োজন সম্পন্ন করেই তবে কোন এক গোধুলি লগ্নে লাল রঙের সিন্ধি গাভি আর তার টলমল পায়ের কয়েক মাস বয়সি সাদা বাছুরের ওই বাড়িতে আগমন।

গিন্নিমা রেশমের মত পশমের তুলতুলে বাছুরটির একটা নামও দিয়ে দিলেন। বাছুরি। মা গাভিটির মেজাজটি বেশ কড়া। বাছুরির আশে পাশে কেউ ঘেষে সাধ্য কি? চোখের আড়াল হলেই হাম্বা হাম্বা রবে মাতৃশাসনে কাছে ডেকে নেয় বাছুরিকে।

গিন্নিমা অবশ্য পশু অন্তপ্রাণ। কর্তার হাজার বারণ অনুযোগ কিংবা বিরাগের পরেও বেড়াল কিংবা উকটো কাক, কেউকেই খাবার না দিয়ে পারেন না। আর এতো পয়মন্ত গাভি। সেখান থেকে পাড়া প্রতিবেশি থেকে আত্মীয় স্বজন সবাই খানিকটা একদম খাটি দুধের স্বাদ পেয়ে থাকে। তাই গিন্নিমা অন্তত সকাল আর রাতের খাবারটি নিজের হাতেই খাওয়ান গাভিটিকে। সে ফাকে মায়ের স্নেহেই আদর করে দেন বাছুরিকে। কদিনেই ঘরের আসল মালিককে চেনার ফলে মা গাভিটিও আর শিং উচিয়ে তাড়া করে গিন্নিমাকে। তবে শুধু গিন্নি মা-ই এই রেয়াত ভোগ করে থাকেন। এমন কি ঘরের বাকি দুটি ছেলে মেয়েকেও তাড়া করতে ছাড়ে না গাভিটি। একবার এমন হলো, পত্রিকার হকার বিল দিতে এসে কি করে জানি উঠোনে এসে পড়েছিল। পড়বি তো পর একেবারে গাভির সামনে। সে যাত্রায় কোনমতে হকার বেঁচে গিয়েছিল। এর পর থেকে মাস শেষে পত্রিকার ভেতরেই বিল ঢুকিয়ে কর্তব্য সেরে ফেলতো সে। কেউ বেড়াতে এসে উঠোনে বায়ু সেবন করতে চাইলে, আগে থেকেই গাভিটিকে বেশ ভাল করে বেঁধে রাখা হতো। নইলে নির্ঘাত কেলেঙ্কারি।

ঘরের ছেলে মেয়ে দুটিও ত্যাদর কম না। কি করে জানি কলার খোসা কিংবা শাক পাতা দেখিয়ে বাছুরিকে বশ করে ফেলেছিল। ফলে ছেলে মেয়ে দুটি স্ক্বুল থেকে ফিরলে, বাছুরিকে দেখা যেত গুটি গুটি পায়ে ওদের কাছে এসে আদর উপভোগ করতে। আর সারা দিন কাজে ফাঁকে ফাঁকে গিন্নিমার বাড়তি আদর তো ছিলই। আর কি করে যেন বাছুরিও তার নামটি জেনে ফেলেছিল। ফলে উঠোন লাগোয়া রান্না ঘর থেকে, গিন্নিমা বাছুরি বলে ডাকলেই, সে চলে যেত দরজার কাছে। সে জানতো নিশ্চই গিন্নিমা ভালো কিছু খাওয়াবেন। সেটা হতে পারে, খানিকটা নুন গোলানো উষ্ণ ভাতের মাড়। কিংবা টাটকা ফুলকপির কচি ডাটা।

আর এভাবেই কেটে গেলো দুটি বছর। যার কারণে গাভি কেনা, সেও বাছুলি বাছুলি বলে ডাকতো। মায়ের স্বভাবটি পায়নি বলে বাছুরিকে শুধু রাতের বেলায় বেঁধে রাখা হতো। সারা দিনমান উঠোনেই চড়তো। এর মধ্যে অবশ্য কর্তার বন্ধুরা বাছুরির গর্ভধারণ করানোর পরামর্শ দিলেন। কিন্ত সন্তান বড় হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে আরো এক জোড়া প্রাণী পোষার মত হ্যাপা নেবেন কি নেবেন না সেটাই একটা উটকো চিন্তার মত জুড়ে বসলো কর্তাকে। আর গিন্নিমাকে কিছু বলেও লাভ নেই। সারাদিন সংসারের নানা ঝামেলা করে এই দুটির পেছনে সময় দিয়েই ক্লান্ত। এর পরে আবার আরো সংখ্যা বাড়ানো?

প্রানীদের ভাগ্যের সাথে নিয়তি যেন আষ্টেপিষ্টে জড়ানো। বাছুরিকে একবার বাইরে দেখে নজর পড়লো প্রাক্তন চেয়ারম্যান সাহেবের। তার সাতটি "গুণধর" ছেলে। তাই ক্ষমতায় না থাকলেও প্রভাব কমেনি। সেই তিনিই যখন মুখ ফুটে বললেন, আসন্ন কোরবানিতে তিনি বাছুরিকে চান, সেই অনুরোধ ফেলার সাধ্য ছিল না কর্তার। গিন্নিমা কোনমতেই রাজি ছিলেন না। কিন্ত স্বামির অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে তাকেও অশ্রুজলে নীরব সম্মতি দিতে হলো। আর বাড়ির বড় ছেলে মেয়ে দুটিও বেশ কান্নাকাটি করলো।

কোরবানির আগের দিনও সারাটি দিন গিন্নিমা বাছুরির কাছে কাছে থাকলেন। বাড়তি আদর, সাথে চোখের জল মিলে, এই বোবা পশুটিও যেন বুঝতে পেরেছিল, বিচ্ছেদ আসন্ন।

বেশ কয়েক জন তাগড়া লোককে সাথে নিয়ে চেয়ারম্যান সাহেবের দুপুত্র বাছুরিকে নিতে সেই সাত সকালেই হাজির। কর্তা তার চাকরটিকে নিয়ে সব ব্যাবস্থা করলেন। আর মা গাভিটিও খুরাঘাতে মাটি আচড়ে শিং নাড়িয়ে তীব্র হাম্বা রবে প্রতিবাদ করলো। কিন্ত এর বাইরে তার করার কিই বা ছিল। তাকে যে খুব শক্ত বাধনে বেধে রাখা হয়েছিল। তাই মাতৃত্বের সেই তীব্র স্নেহকে মাড়িয়ে ওরা বাছুরির টেনে হেচড়ে নিয়ে গেলো। বাছুরির প্রস্থানের দৃশ্য সহ্য করার ক্ষমতা গিন্নিমার ছিল না। তাই তিনি আড়ালে থেকে শুধু চোখের পানি মুছতে লাগলেন।

কর্তাদের পৈতৃক বাড়িতেই কোরবানি হয় বলে, এবাড়িতে কোন আয়োজন নেই। অন্যান্যবার নামাজের আগেই সেখানে কর্তা তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে সেখানে যান। কিন্ত গিন্নিমার শোকাহত চেহারা দেখে সে প্রস্ততির কথা তুলতে পারলেন না কর্তা। শুধু ফোন করে জানিয়ে দিলেন তার সেখানে যেতে কিঞ্চিত বিলম্ব ঘটবে।

ঘরের ছেলে মেয়ে দুটিরও ঈদের কোন প্রস্তুতি নেই। ওরাও উদ্ভ্রান্ত দৃস্টিতে আচল ঢেকে মায়ের কান্নার দৃশ্য দেখছে। কর্তা কর্তব্যের খাতিরেই খালি মুখেই চলে গেলেন ঈদের নামাজে।

নামাজ শেষ। ঘরে ঘরে দলে দলে ফিরছে মানুষ। একটু পরেই কোরবানি শুরু হয়ে যাবে। এমন সময় সেই বাড়ির বাইরে লোকজনের হৈ চৈ শোনা গেলো। । হাম্বা হাম্বা ডাকটি আম্মা আম্মা বলেই যেন মনে হলো গিন্নিমার। উঠোন লাগোয়া বারান্দায় আসতেই তিনি দেখলেন, দড়ি ছেড়া অবস্থায় খুব জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলা উত্তেজিত বাছুরিকে। কর্তা যাবার সময় বেখেয়ালে সদর দরজা বন্ধ করতেই ভুলে গিয়েছিলেন/ আর কসাইয়ের ছুরিকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে বাছুরি ঠিকই উপস্থিত হয়েছে গিন্নিমার কাছে। বেঁচে থাকার তীব্র আকুতি আর মৃত্যুর আতংক দুইই যেন সমানতালে চোখ ফুটে বেড়ুচ্ছে বাছুরির।

"আমি ওকে নিয়ে যেতে দেবো না" গিন্নিমার নরম চেহারার খুব শক্ত কথায়, বাছুরিকে ধাওয়া করা মানুষগুলি থমকে দাড়ালো। গিন্নিমার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে যেন চরম ভরসা পেলো বাছুরি। এযাত্রায় ফাড়া কি তবে কাটলো? কিন্ত মনুষ্য জীবনের হিসেবটা বেশ জটিলই বটে ! ততক্ষণে নামাজ শেষে কর্তা বাড়িতে ফিরতেই ওরা অনুযোগ করলো। ওদিকে বাছুরিকে বুকে নিয়ে পর্বতের মত স্থির হয়ে থাকলেন গিন্নিমাকে।

লোকজনের হৈ চৈ এর শব্দে পাড়ার আরো কিছু মানুষও উপস্থিত। কোরবানির নিয়তে পশু দিয়ে দেবার পরেও এভাবে আকড়ে ধরে রাখাটা অন্যায় বলে কেউ কেউ মন্তব্য করলো। ওদিকে চেয়ারম্যান সাহেবেও স্বয়ং উপস্থিত। তিনি রাজনীতি করা মানুষ। উত্তেজনা ছড়াতে দিলেন না। তার সাথে থাকা মওলানা সাহেব গিন্নিমাকে বোঝালেন, প্রিয় বস্তুকে কোরবানি দেয়াতেই তো কোরবানি ঈদের মাহত্ব্য। আল্লাহ নিশ্চই এজন্য উপযুক্ত পুরস্কার দেবেন।

একদিকে ধর্ম আর স্বামীর অসহায়ত্ব, অন্যদিকে একটি অসহায় একটি বোবা প্রাণীর প্রাণ বাচানোর আকুতি, কোন দিকে যাবেন গিন্নিমা? বছর বছর কোরবানিতে ছুরির নীচে পেতে দেওয়া পশুগুলির গলাকাটা দৃশ্য ভেসে আসলো গিন্নিমার চোখে। বাছুরির যে গলায় অনেক অনেক আদর করে দিয়েছিলেন এক সময়, সে গলাটিকে কসাইয়ের ধারালো শানিত ছুরির নীচে কি করে দিতে পারবেন তিনি? এসব ভাবতে ভাবতেই মুর্ছা গেলেন গিন্নিমা। তাই শক্ত করে ধরে থাকা, বাছুরির গলার ছিন্ন রশিটা একটু হলেও আলগা হয়ে গেলো।

সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক !!
৯টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×