ড. মঞ্জুরে খোদা
২০০৮ সালে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল জাপান এলে বাঙালি কমিউনিটির উদ্দেশ্যে একটি বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রন জানাই। সেখানে তিনি প্রবাসীদের ভূমিকা, কৃতিত্ত্ব ও করণীয় নিয়ে একটি সাবলীল প্রেজেনটেশান দেন যা উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। যাইহোক এই অনুষ্ঠান ঘিরে আমাদের বাসায় স্যার এবং ম্যাডাম ইয়াসমিন হকের সাথে অনেক সময় একান্ত আড্ডার সুযোগ হয়। দেশে থাকতেও বিভিন্ন সামাজিক ও ছাত্র ইউনিয়ন সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচীতে স্যারের অংশগ্রহন ও সহযোগিতার কথা খুব মনে পড়ে। কিন্তু সেদিনই প্রথম উনার সাথে আমার ব্যক্তিগত আড্ডার সুযোগ হয়। নিত্য হাসিমাখা অসম্ভব সহজ, সাবলীল ও বিনয়ী একজন অনন্য কৃতি মানুষের কথা কখনো ভোলার নয়।
সেদিনের সেই আলাপচারিতায় তাঁর ব্যক্তি মানসিকতার সামান্য কিছু বিষয় জানার সুযোগ হয়েছিল। আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা শেষ করে সেখানে বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান বেল কমিউনিকেশন রিচার্সের গবেষক হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় ১৯৯৪ সালে চাকুরী ছেড়ে দেশে চলে আসেন। তিনি ঢাকামুখী না হয়ে শিক্ষক পেশায় নিবেদিত প্রাণ মানুষ হিসেবে চলে যান সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশ-বিদেশের অনেক বড় বড় সুযোগ পায়ে ঠেলে তিনি রয়ে গেলেন সেই সিলেটেই। কি অসাধারণ দৃঢ়তা, অঙ্গীকার, দায়িত্ব ও দেশাত্ববোধ। এই সময়ে এই বেপরোয়া চরিত্র কেবল গল্প ও উপন্যাসেই পাওয়া সম্ভব বাস্তবে বিরল।
সেই সত্যটি আরও পোক্ত হয়েছিল তাঁর মুখে এই গল্পটি শুনে! তিনি বলছেন, আমি যখন ৯৪তে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেই তখন আমার কিছু শখ পূরণের ইচ্ছে হয়, প্রবাসে নিজের বাড়ীতে থাকতে এবং পছন্দের গাড়ীতে চড়তে কেমন লাগে, তার সাধ নিতে। তাই দেশে যাবার কয়েক মাস আগে একটি চক্চকে ফ্লাট ও নতুন গাড়ী কিনলাম! তারপর আমার সামর্থে যা যা শখ ছিল তা এক এক করে পুরণ করলাম। আমার তরুণ বয়সের সঞ্চয় দিয়ে আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে ভাল রেস্টুরেন্টে খেলাম, নতুন গাড়ী চালিয়ে পছন্দের স্থানগুলোতে ভ্রমন করলাম। আমার এই কান্ড দেখে অনেকেই বলেছে দেশে ফেরার আগে কেউ তাঁর ‘মূল্যবান সঞ্চয়’ এভাবে খরচ করে? আমার বন্ধু ও শুভাকাঙ্খীরা কেউ সন্দেহের চোখে তাকিয়েছিল, আর কেউ বলেছিল ‘জাফর একটা পাগল’! সবাই অবাক হয়েছিল, কারণ যে মানুষটি নিশ্চিত দুদিন পরে একবারে দেশে ফিরছে সেই কি’না নতুন বাড়ী ও গাড়ী কিনেছে! আপনাকে পাগল বলবে না তো কি বলবে? এটা আমাদের বাস্তবতা ও সংস্কৃতিকে অস্বাভাবিক ও বেমানান। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল তাঁর লেখা অনেক এডভেনঞ্চারের সাথে এর যোগসূত্রের কথা! এই জন্যই তো আপনি ‘ড. মুহম্মদ জাফর ইকাবাল!’ যারা জীবনে বড় হয়, বিখ্যাত হয় তাদের জীবনে এমন পাগলামি না থাকলে চলে? তাহলে সাধারণের সাথে তাদের পার্থক্য কোথায়?
শুনলাম তাঁর স্বপ্ন ও সংকল্পের কথা। আমার যেটুকু অর্জন ও সামর্থ তার প্রয়োগ ও চর্চাটা বাকী জীবন আমি আমার নিজ দেশেই করতে চাই। আমার স্বপ্ন যুক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, গণিত, শিক্ষায় তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে নিতে হবে। তাদের অমিয় শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। তাদের হাতে বই ও উন্নত প্রযু্ক্তি তুলে দিতে হবে। সারাদেশ না হোক প্রত্যেকটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নিদেন পক্ষে প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয় ইন্টারনেট-ওয়াইফাইয়ের আওতায় আসবে। আমি দেখতে চাই, প্রত্যেকটা ছেলে-মেয়ে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে, করিডরে, ছাদে, খোলামাঠে সবুজ ঘাসে বসে ল্যাবটপ হাতে অবারিত বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে দারুণ বিস্ময় ও মুগ্ধতা নিয়ে মগ্ন আছে। তথ্য-প্রযুক্তির মহাসমুদ্র থেকে তুলে আনছে নিত্যনতুন বিষয় যার চর্চা ও প্রয়োগে সহসাই দেশ হবে উন্নত বিশ্বের কাতার বন্ধী। আমি স্বপ্ন দেখি, উচ্ছাস ভরা বেপরোয়া তারুণ্যের। কূপমন্ডুকতা ও ধর্মের সংস্কার তাদের শৃংখলিত করবে না। এই বয়সে তরুণ-তরুনীরা বাঁধভাঙ্গা আবেগ-উচ্ছাস ও সৃষ্টির আনন্দে মুখরিত করবে চতুর্দিক।
একটি আধুনিক, উন্নত সংস্কারমুক্ত বিজ্ঞানমনস্ক সংস্কৃতিবান জাতির স্বপ্নই দেখি আমি। তরুণদের দেখতে চাই তরুণদের মত, দেশের তরুণের প্রতি সেদিন আপনার দারুণ আস্থা, বিশ্বাস, স্বপ্ন ও ভালবাসার কথা জেনে দারুণ উৎসাহিত হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি। আপনার ভিতরে সেদিন দেখেছি দারুণ উত্তাপ ও যন্ত্রনা। যে উত্তাপ আপনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন সব সকল তরুণের মাঝে।
বিশ্বের অন্যতম পশ্চাৎপদ, দরিদ্র ও সংস্কারাচ্ছন্ন একটি দেশে আপনি চেয়েছেন যুক্তি, বিজ্ঞান, সভ্য ও মর্যাদাপূর্ণ সমাজ! যে দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ ধর্মভিত্তিক শিক্ষার্থী যাদের সাথে যুক্তি ও বিজ্ঞানের কোন সম্পর্ক নেই! যেখানে রাজনৈতিক কারণে সরকারী অর্থে শত শত মসজিদ তৈরীর ঘোষণা দেয়া হয়, যার কোন কমতি নেই! যে দেশের পাঠ্য বইয়ে কৌশলে ধর্মের নানা অনুসঙ্গ ঢোকানো হয়। আগে বাঙালি না মুসলমান সেই বিতর্কের আড়ালে জ্যামিতিক হারে বাড়ে দেশে হিজাব-নিকাব ও ইসলামি করণ!
বঙ্গবন্ধু যে কোন কাজে মায়ের দোয়াকে দিতেন সর্বোচ্চ গুরুত্ব সেখানে পাশ্চাত্য শিক্ষায় তাঁর শিক্ষিত অনুসারীরা ধর্মান্ধ মাদ্রাসার হুজুরদের পানিপরা চান তাদের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুষ করতে। যেখানে আপনি ভুমিকম্পের সহজবোধ্য বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষনের মাধ্যমে জনসচেতনতার চেষ্টা করেন, সেখানে মাদ্রাসাগুলোতে, জনসমক্ষে তার ব্যাখ্যা দেয়া হয় নারীদের বেপর্দা চলাফেরাই প্রধান কারণ! যে তারুণ-তরুণীকে দেখতে চেয়েছেন কাঁধেকাঁধ-হাতেহাত মিলিয়ে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার.. তাদের একটা বড় অংশ ধর্মান্ধ, কূসংস্কারাচ্ছন্ন, অনৈক্য ও বিভক্তির স্বীকার! তাদের শেখানো হয় মুক্তবুদ্ধি ও বিজ্ঞান চর্চা হচ্ছে নাস্তিকতা ও ধর্মহীনতা, তাদের হত্যা করতে পারলে পাবে পরকালের অনন্ত সুখের ছাড়পত্র! যে গ্রহের একপ্রান্তে চলছে ২০২০ সালে ভিন্নগ্রহে স্থায়ী বসবাসের আনজাম, সেখানে এই কোনে বিতর্ক চলে চাঁদে কার মুন্ডুর ছায়া! যে দেশের মানুষকে সভ্যতা ও নৈতিকতা শিক্ষায় আইন অসহায়, আরবি হরফ হয়ে ওঠে রক্ষাকবচ! সেখানে আপনি যে স্বপ্ন ও সংকল্প নিয়ে কাজ করছেন, আপনার সেই শুভাকাঙ্খীরা আপনাকে এখনও পাগলই বলবে! যে অপবাদ নিয়ে অনেক লেখক, বিজ্ঞানী দার্শনিককে অস্বাভাবিক বিদায় নিতে হয়েছে। আপনিও কি তাঁর বাইরে?
লেখালেখি করে অপবাদ পেয়েছেন আওয়ামী লীগের দালাল বুদ্ধিজীবী, কারো কাছে আপনি ঘৃণিত গৌড়গোবিন্দ, নাস্তিক, ব্লগার! হুমকি-ধামকি তো আপনার পায়ে পায়ে জড়ানো। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়েও আপনাকে শুনতে হয় রাজাকারদের বিচার বাধাগ্রস্থ করার অভিযোগ! যে আপনি বুক ফুলিয়ে স্বাক্ষী দিয়েছেন কুখ্যাত রাজাকাদের বিরুদ্ধে। হায়রে স্বদেশ, হায়রে ক্ষমতার রাজনীতি! যার ঘাড়ের উপর নিজের ছায়ার মত সুতোয় বাঁধা কতগুলো মৌলবাদী চাপাতি প্রতিনিয়ত তাড়া করছে। সজীব ওয়াজেদ জয়ের বক্তব্য ও সিলেটে আওয়ামী লীগের এমপি’র কর্মকান্ড তাঁর জীবনকে করল আরও অরক্ষিত ও অনিরাপদ। আর অনন্ত বিজয় দাসের হত্যাকান্ডকে করল প্রশ্নবিদ্ধ।
বাংলাদেশে এমন কোন শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে যে দেশের প্রধান বিজ্ঞান লেখক ও কিশোর সাহিত্যিক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের বই/লেখা পড়ে নি! যিনি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন অধিকার আন্দোলনেও শিক্ষার্থীদের পক্ষে সরাসরি অংশগ্রহন করেছেন! সিলেটে তাঁর এতবড় অসম্মান-অমর্যদার ঘটনায় সারা দেশের কোথাও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কোন প্রকাশ্যে প্রতিবাদ দেখলাম না! একটি আধুনিক, আত্মনির্ভরশীল জাতি গড়ে তুলতে হলে প্রথমে দরকার আত্মমর্যাদাবোধ কিন্তু কোথায় সেই উপাদান? আমি তো দেখছি কেবল আত্মসমর্পনের উৎসব। এই ঘটনায় হাজার-হাজার শিক্ষক-শিক্ষার্থীর প্রতিবাদ আশা করেছিলাম। এটা কি আমাদের সেই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ! আমরা কি এমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? যে দেশে গুণীর সমাদর নেই সেখানে গুণী জন্মাবে কিভাবে..?
মঞ্জুরে খোদা টরিক, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও প্রক্টর (খন্ডকালীন), ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় ও রায়রসন বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যানাডা।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০১৫ সকাল ১০:২৭