ড. মঞ্জুরে খোদা
রমজান আরবি শব্দ রমজ থেকে এসেছে, যার অর্থ দহন বা পোড়ানো। এ মাসে রোজা পালনের মাধ্যমে মানুষ তাদের ভোগ-বিলাসিতা, লোভ-লালসা, পাপ-পঙ্কিলতা, হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে। মানুষ যদি প্রকৃতই এই বিষয়ে চর্চা করতে পারতো তাহলে বাংলাদেশের মুসলিম সমাজের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি হতো অন্যরকম। কিন্তু এই অবস্থার পোষাকী পরিবর্তন ছাড়া অন্তর্গত কোন পরিবর্তন খুব একটা দৃশ্যমান হয় না। তার একটি সমীকরণ মেলাতে চেষ্টা করেছি ধনবিজ্ঞানের দুটি অতি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব চাহিদা ও যোগান দিয়ে। চাহিদা ও যোগানের সাথে রমজানের মাহাত্মের চর্চার বিষয়টি কতটুকু কার্যকর হয় তার বাস্তব পরিস্থিতিটি মেলাতে গিয়ে আমরা দেখছি বিপরীতিমূখী অবস্থা।
রমজান মাস হচ্ছে সংযমের মাস। তার মানে এই মাসে মানুষের ভোগ-বিলাসিতা কমবে। সেটা কমলে বাজারে ভোগ্যপন্যের চাহিদা কমবে, আর তা কমলে পণ্যের দামও কমবে! আবার পণ্যের দাম যদি বাড়ে তাহলে চাহিদাও কমবে.., এটাই স্বাভাবিক! অর্থনীতির চাহিদা, যোগানের তত্ত্ব ও সূত্র সে কথাই বলে। চাহিদা ও যোগানের এই সমীকরণ সমাজবিজ্ঞানের অতি স্বীকৃত ও প্রমানিত বিষয়।
তাহলে বাংলাদেশে এই মাসে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ে কেন..? তাহলে কি বলতে হয় অর্থনীতির এই স্বীকৃত সংজ্ঞা ও তত্ত্ব এই ক্ষেত্রে কার্যকর নয়? বাংলাদেশে এই তত্বের কোন কার্যকারিতা নেই? এটি কি একটি ভুল সূত্র? তা যদি না হয়, তাহলে কি বলতে হবে তত্ত্ব ঠিকই আছে, আসলে এই মাসে মুসলমানদের ভোগ-বিলাসিতা বাড়ে এবং সেটা মেটাতে গিয়ে বাজারে টান পরে। মানে সেই বাড়তি চাহিদা মেটাতে সরবরাহ সমধিক না থাকায় জিনিষ-পত্রের দাম বাড়ে! সেটা হলে, অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, রোজার মাসে মুসলমানদের ব্যয়, ভোগ-বিলাসিতা বৃদ্ধি পায়..! তাহলে কি আমরা বলতে পারি না বাঙালি মুসলমানের সীয়ামসাধনা যতটা না প্রকৃত, তার অধিক প্রদর্শন মূলক?
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ব্যাবসায়িক সিন্ডিকিট তাদের অনৈতিক বানিজ্যিক কারসাজির মাধ্যমে এই কৃত্তিম সংকট সৃষ্টি করে। যাদের ৯৫ ভাগই মুসলমান এবং অধিক মুনাফাই হয়ে ওঠে তাদের সংযমের অর্থ! এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় ও নাগরিকদের ভোগ ও জীবনের সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনায় ধর্মের নৈতিক বাণী সামান্যই কাজ করে। সেখানে এই ব্যবস্থাপনার পুরোটাই নির্ভরশীল ইহলৌকিক আইনের শাসন, নিয়ন্ত্রন ও কার্যকারণের উপর। এখানের ধর্মের নীতি ও বাণী ইহোলৌকিক স্বার্থের কাছে ভীষন অসহায়।
আমরা যে উন্নত ভোগবাদি সমাজের কথা বলি এবং নানা কারণে তাদের সমালোচনা করি, ব্যক্তি ও সামজিক জীবনে তাদের নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি কেমন? বিভিন্ন দেশের থাকার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এই সব দেশে তাদের কোন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান-আয়োজনকে ঘিরে ভোগ্যপন্যের দাম কমানো এবং নানা ধরণের সুযোগসুবিধা প্রদানের বিজ্ঞাপন অনেক আগে থেকেই প্রচার করা হয়। যার জন্য নাগরিকদের দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হতে হয় না এবং আগে থেকে কোন কিছু কিনে মজুত করে রাখার দরকার পরে না। এই সময়ে বাণিজ্যিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি থাকে যাতে আয়োজনটি সবার জন্য অধিক উপভোগ্য ও আনন্দময় হয়। গতবছর সেপ্টেম্বরে কানাডায় এলে নিজেদের জন্য অনেক কিছু কেনার দরকার হয়, তখন বন্ধু ও স্বজনদের পরামর্শ ছিল ডিসেম্বরে ক্রিসমাসের সেল থাকবে- তখন সবকিছু কিনলে অনেক টাকা সেভ করতে পারবো। সত্যিই তাই ঘটলো, আমারও বেশ কিছু পয়সা সঞ্চয় হলো। আমাদের দেশেও উৎসব-আয়োজন গুলো হোক সবার জন্য দুশ্চিন্তামুক্ত, আনন্দ ও উপভোগের। সেই পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমেই মেলাতে হবে রমজানের মহত্ম ও চাহিদা-যোগান তত্ত্বের সমীকরণ।
মঞ্জুরে খোদা টরিক, প্রাবন্ধিক ও গবেষক।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০১৫ সকাল ১১:৩১