ড. মঞ্জুরে খোদা
কারা পড়ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে?
এ বছর উচ্চমাধ্যমিক থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭ লাখ ২১ হাজার ৯৭৯, এরমধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬১ হাজার ১৬২ জন। এই শিক্ষার্থীর একটি বড় অংশের আশা থাকে কোন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল বিষয়ে লেখাপড়া করার। কিন্তু ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আসনের সংখ্যা প্রায় ৩৮ হাজার। তারমানে কেবল জিপিএ ৫ প্রাপ্য অর্ধেকই প্রায় বাদ পড়ে যাবে, অন্যদের কথা না হয় বাদই দিলাম। বাকী থাকে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভিন্ন কলেজ। সেই সুযোগও প্র্রায় সারে ৩ লাখের মত। সবমিলে মোটামুটি ৫ লাখ শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার সুযোগ হলেও বাকী ২ লাখের কোন গতি নেই!
কৃতকার্য হয়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীরই আকাঙ্খা থাকে কোন পাবলিক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। কিন্তু অপযাপ্ত প্রতিষ্ঠান, আসনের সীমাবদ্ধতা, পছন্দের বিষয় না পাওয়া ও ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হতে পারার কারণে একপ্রকার বাধ্য হয়েই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গুলোতে যায়। উদ্দেশ্য, এই সব বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান লেখাপড়া করে চাকুরীর বাজারে নিজেদের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা।
কিন্তু এদের সবাই কি ধনী, উচ্চবিত্ত? এখানে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের ছেলেমেয়েরাও লেখাপড়া করে এবং তাদের সংখ্যা প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ। সেক্ষেত্রে তাদের অভিভাবকদের অনেক কষ্ট করেই সেই অর্থের সংস্থান করতে হয়। পরিস্থিতির কারনে যারা সেখানে পড়তে পারল না, তাদের প্রতি সরকারের সহানুভূতি নয়- উল্টা চাপিয়ে দিল ভ্যাট।
শিক্ষা নিয়ে যারা বাণিজ্য করে তারা শিক্ষাকে একটি পন্যের বেশি ভাবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যে রাষ্ট্র-সরকার নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকারী তারাও কি একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান? শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করবে? তাহলে ক্ষমতার রাজনীতির যে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড আছে তার উপরও এই ভ্যাট বসাতে বললে কি অন্যায় হবে? প্রশ্ন হচ্ছে এই বিষয়ের অনেক কিছুই গোপন ও অদৃশ্য!
বাংলাদেশের ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী দেশে এখন কোটিপতি একাউন্টের সংখ্যা ৫১ হাজার ৫৫০। বাস্তবে এর সংখ্যা অনেক বেশী হলেও তাদের কত জনের ছেলেমেয়ে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে পড়ে? প্রায় ৪ লক্ষ শিক্ষার্থী এই প্রতিষ্ঠান গুলোতে পড়ছে। তাহলে সরকারের এই আর্থিক মানদন্ডের বিবেচনা কতটা যুক্তিসঙ্গত? শিক্ষার্থীদের আর্থিক সঙ্গতি কতটুকু এই বাড়তি খরচ মেটানোর? এই বিষয়ে সরকারের কোন জরিপ ও পরিসংখ্যান আমার চোখে পরেনি।
এই সিন্ধান্ত শিক্ষাখেত্রে যুক্ত করল আরেকটি বৈষম্য
কেবল আর্থিক মানদন্ডই যদি হয় ভ্যাট আদায়ের শর্ত- তাহলে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কি ধনী ও উচ্চবিত্তের সন্তানেরা পড়ে না? পরিসংখ্যান বলছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী উচ্চবিত্ত ও ধনী ঘরের ছেলেমেয়ে। তাহলে তারা কেন ভ্যাট আওতার বাইরে থাকবে? এবং তারা কেন ভ্যাট না দিয়ে পড়বে? এর কি জবাব দেবেন অর্থমন্ত্রী? না’কি সেই অংক কষছেন পরের বছরের জন্য!
এক দেশের এক সরকারের আওতায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই ব্যবস্থার প্রবর্তন নিসন্দেহে একটি বৈষম্যমুলক দ্বিমূখী নীতি। একজন ছাত্রের পরিচয় সে ছাত্র এবং তাদের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভোঙ্গি থাকবে অভিন্ন। সবাই রাষ্ট্রের সন্তান। কিন্তু অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রের এই বিমাতাসুলভ আচরণ তরুণ শিক্ষার্থীদের মনোভাব বিরুপ করবে। কারন এমনিতেই শিক্ষায় তাদের বিনিয়োগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে অনেক গুণ বেশী। তার উপর আবার সারে ৭ শতাংশ ভ্যাট সত্যিই হতাশাজনক। আর এই ক্ষোভ তরুণ শিক্ষার্থীদের বয়ে বেড়াতে হবে বাকী জীবন যে পরিস্থিতি একটি সুস্থ সমাজ গঠনের আকাঙ্খাকে বাধাগ্রস্থ করবে।
সংবিধানে শিক্ষার অধিকার সকলের জন্য সমান হিসেবে স্বীকৃত। এমন কি ১৯৯২ সালে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশেও স্পষ্ট উল্লেখ আছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হবে অলাভজনক ও সেবামুলক। ২০১০ এ মালিকদের স্বার্থে বেসরকারী অধ্যাদেশ বিভিন্ন ধারার শব্দ ও ভাষার কৌশলগত পরিবর্তন এনে স্কুলের খরচ, মালিকদের মুনাফা শিক্ষার্থীর ফি’র উপর নির্ভরশীল করা হয়। সরকারও নিজেকে সেই বাণিজ্যে শরিক করে তার শাইলকের চরিত্র প্রকাশ করল। উচ্চশিক্ষা নিয়ে তার উদ্দেশ্য আর গোপন থাকলো না এক. শিক্ষাখেত্রে তার দ্বিমূখী নীতি দুই. প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষার্থীদের প্রতি বৈষম্যমুলক আচরণ তিন. শিক্ষাকে বিশুদ্ধ বাণিজ্যের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান চার. উচ্চশিক্ষাকে অধিক ব্যয়বহুল ও সংকচন করা পাঁচ. শিক্ষা বাণিজ্যকে উৎসাহিত করা।
ভ্যাটের আওতা হবে অধিক বিস্তৃত, এটা তার মহড়া
অধিকাংশ রাজনীতিক, এমপি, মন্ত্রী, আমলা, উচ্চবিত্ত ও ধনীদের সন্তানের দেশের বাইরে লেখাপড়া করে। কানাডার ২টি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কাজের অভিঙ্গতা থেকে বলছি। এই সব ব্যক্তিদের পরিবারদের জন্য প্রবাসে কিছু কিছু এলাকাই গড়ে উঠেছে। যা নিয়ে পত্রিকায়ও সংবাদ এসেছে। কারণ তাদের পরিবারের অর্ধেক সেখানে থাকে এবং ছেলেমেয়ে সেখানে লেখাপড়া করে। যাদের সামর্থ ও সুযোগ হয় না দেশের বাইরে যাবার তাদের প্রধান অংশই দেশের এই বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। এবং তারা তাদের অর্থ দেশেই বিনিয়োগ করছে আর তাদেরকেই দিতে হচ্ছে ভ্যাট নামক এই বাড়তি কর!
সরকার যদি শিক্ষার উপর ভ্যাট বসাতেই চান তাহলে সেটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল-ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের উপর না করে বরং সমাজের ধনী ও উচ্চবিত্তদের উপর “শিক্ষাকর” আরোপ করতে পারেন, তাতে আয় অনেক বেশী হবে। উচ্চবিত্তের সন্তান পাবলিক-প্রাইভেট যেখানেই পড়ুক সরকার কর পাবে সব ধনীদের কাছ থেকে। সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই বিষয়ক বৈষম্য অন্তত থাকবে না।
ইংলিশ মিডিয়ামের বিষয়টিকে একটু ভিন্ন ভাবে দেখা যায়, কারণ সেটা বিদেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বর্ধিত (বাণিজ্যিক) অংশ যাদের আয়ের একটা বড় অংশই দেশের বাইরে চলে যায়। এবং এই ছেলে-মেয়েদের একটি অংশ ক্রেডিট ট্রান্সফার করে বাইরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয় সেই ক্ষেত্রে দেশের অর্থের একটি অংশ চলে যায়। সেখানে সরকারের দূর্বলতার দিক হচ্ছে দেশে তাদের শিক্ষার উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব হয় নি। তারা বাধ্য হয়ে বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছে, যেমনটি যে ছেলেমেয়ে প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে পড়ছে।
শিক্ষার বিনিয়োগই সূদুপ্রসারী ও বহুমাত্রিক
শিক্ষার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে বিতর্ক থাকলেও শিক্ষার সাথে ব্যক্তির উন্নয়নের সম্পর্ক ও সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে বোধকরি কেউ বিতর্ক করবে না। একই সাথে নির্দিষ্ট স্তর অবধি শিক্ষার আর্থিক দায় রাষ্ট্র ও সরকারের তাও বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এমন কি পুঁজিবাদী সমাজও এই বাস্তবতা গ্রহন করছে এবং শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করছে। সীমিত সম্পদের জনসংখ্যাভিত্তিক দেশ বাংলাদেশের জন্য এই সত্যের উপলব্ধি অতি জরুরী। শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে উন্নয়নের গতি অনেক গুন বাড়ানোর প্রধান উপায়। কিন্তু আমাদের দেশ যেন সেই বিষয়টিকে অবজ্ঞা করছে। যার প্রমান দেখছি শিক্ষায় সরকারের বিনিয়োগের প্রবণতায়। বর্তমান সরকারের ৭ বছরে শিক্ষায় বিনিয়োগ কমেছে ৪.১ শতাংশ। বিনিয়োগ টাকার অংকে বাড়লেও শতাংশের হারে নিম্নমূখী। কিন্তু ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি, বেতন-ভাতা অন্যান্য বাড়তি খরচ, টাকার অবমূল্যায়ন ইত্যাদি বিষয় যোগ করলে যে বাড়তি অংকের কথা বলা হচ্ছে তা আসলে ফাঁকি।
সীমিত সম্পদ ও সামর্থের কারণে শিক্ষা বিস্তার-প্রসারে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী সংস্থা ও ব্যক্তি-গোষ্ঠীর নানা উদ্যোগকেও পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়। যার কারণে দেশে শিক্ষার বিকাশ ও প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হচ্ছে। পর্যাপ্ত সরকারী বিনিয়োগ ও প্রতিষ্ঠানের ঘটতির জায়গাটি পুরণ করছে এই প্রতিষ্ঠান গুলি। সেখানে সবাই উঁচু নৈতিকতা ও মান বজায় রাখতে পারছ এমনটা নয়। কিন্তু এর দায় নিশ্চয় শিক্ষার্থীদের নয়, সেখানে কোন দূর্বলতা থাকলে তা তদারকির দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের। উচ্চশিক্ষার গুন-মান নিয়ে আলোচনা নতুন নয়, অনেক দিনের এবং তা ধারাবাহিক। ইউজিসিসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে এই ধারার অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আছে। যে কারণে শিক্ষার্থীরা নানা ভাবে ক্ষতির স্বীকার ও ভূক্তভোগী। সেগুলোর সমাধান না করে তাদের উপর আবার চাপানো হলো করের বোঝা!
রুখে দাড়ান উচ্চশিক্ষা সংকচনের ষড়যন্ত্র
কতটাকা আয় হবে এখান থেকে? একজন ছাত্রের যদি পড়তে ৪ লক্ষ টাকা খরচ হয় তাহলে তাঁকে এর সাথে সারে ৭% ভ্যাট হিসেবে বাড়তি ৩০ হাজার টাকা দিতে হবে। কেবল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ লক্ষ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে এই পরিমান ভ্যাট নেয়া হলে দাড়ায় প্রায় ১ হাজার ২শ কোটি টাকা! খুব কৌতুহল হয় জানতে, কোথায় খরচ হবে এই টাকা? সামরিক বাহিনীর অস্ত্র কিনতে? রাশিয়ার সাথে যে ৭ হাজার কোটি টাকার অস্ত্র কেনার চুক্তি হয়েছে সেখানে? আমলাদের বর্ধিত বেতন-ভাতার বাড়তি খরচ মেটাতে? না’কি অনেক দূর্ণীতি-অপচয়-লুটপাটের গচ্চার ভূর্তকি হবে এই টাকা? আমাদের নীতি নির্ধারকদের কি এতটুকু বিবেক নেই যে, এই কমল ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে ভ্যাট নিয়ে তা দিয়ে উন্নয়নের আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে হবে।
প্রথমে ছিল ইংলিশ মিডিয়ামে ভ্যাট বসিয়েছে, তখন আমরা চুপ ছিলাম। কারণ আমি সেখানে পড়ি না। এবার বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল-ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ যারা পড়ে তাদের উপর ভ্যাট বসিয়েছে। সেখানে আপনি পড়েন না, তাই বলে কি চুপ থাকবেন? কিন্তু এভাবে প্রতিবাদহীন থাকলে তা ক্রমশ বিস্তৃত হবে সর্বত্র এবং আক্রান্ত হবে সবাই।
ড. মঞ্জুরে খোদা (টরিক), প্রাবন্ধিক, গবেষক ও সাবেক ছাত্রনেতা।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:১৩