somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোটা পদ্ধতি নয়, জোনাল স্কুল সিস্‌টেম চাই

২৫ শে অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ১১:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ড. মঞ্জুরে খোদা

আমাদের অনেক সমস্যাই আর্থিক নয় দৃষ্টিভঙ্গির
পত্রিকায় পড়লাম প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায়, আগামী শিক্ষাবর্ষ ২০১৬’র জানুয়ারী থেকে সরকার মহানগরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে যে এলাকায় বিদ্যালয় অবস্থিত সেই এলাকার শিশুদের ভর্তি নিশ্চিত করতে “৪০ শতাংশ কোটা পদ্ধতি” চালু করার সিন্ধান্ত নিয়েছে। শুনে অবাক হলাম, নীতি নির্ধারকরা কেন এমন একটি খন্ডিত সিন্ধান্ত নিলেন। ধরে নিলাম শিক্ষার মান উন্নয়ন, দূর্ণীতি-অনিয়ম-অস্থিরতা-বৈষম্য ও শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের ভোগান্তি কমাতে এই পদ্ধতির সিন্ধান্ত নেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে নগর ও নাগরিক সুবিধায় এই আকাঙ্খা কতটুকু অর্জন করা সম্ভব হবে?

ছাত্রজীবনের একটি বড় অংশ ছাত্র সমস্যাভিত্তিক ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলাম এখনও এই বিষয়ক লেখাপড়া ও গবেষণা নিয়েই আছি। সবসময় কেবল মনে হয় আমাদের দেশে শিক্ষাখেত্রে কেন এত নৈরাজ্য ও অস্থিরতা? এর জন্য প্রধানত দায়ী কি আমাদের দারিদ্রতা না দৃষ্টিভঙ্গি? আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যা আছে কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রেও কি আমরা দরিদ্র ও চিন্তা করতে অক্ষম? এই বিষয়ে কাজ করতে যেয়ে দেখেছি কেবল অর্থ নয়, দেশের অনেক সমস্যাই দীর্ঘায়িত হচ্ছে প্রকৃত নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে। আজ পর্যন্ত শিশু শিক্ষার্থীদের ভর্তির একটি জাতীয় নীতি/মান ঠিক করা যায় নি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি যেমন কখনো মেধা, কখনো মার্কস, ডোনেশন, আঞ্চলিকতা, লটারী ইত্যাদি প্রয়োগ করা হয়েছে। এই ধরণের বিভিন্নতা শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তোলায় ও বিকাশে কোনভাবে সহায়ক হয় না তার প্রমান আজকের এই অস্থিরতা।

কোটা পদ্ধতি নয় ভর্তির সুনিদ্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন
প্রথমে আপত্তি করছি এই ‘কোটা পদ্ধতি’ শব্দ নিয়ে! এই শব্দের মানে কোন বিশেষ কারনে সমাজ ও রাষ্ট্রের একটি অংশকে কোন সুযোগের অগ্রাধিকার দেয়া, যা শিশু ও নাগরিকদের সার্বজনীন সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার যে নীতি তার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। সেই কারনে এই শব্দ পরিহার করা সমীচীন মনে করি। দ্বিতীয়ত, ‘কোটাপদ্ধতি’র খন্ডিত ব্যবস্থায় না যেয়ে বরং একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে এই সমস্যা সমাধানে স্থায়ী পরিকল্পনায় নিয়ে অগ্রসর হতে হবে।
সরকার যদি এই পদ্ধতিকে সঠিক মনে করে তাহলে ৪০ শতাংশ কেন? ১০০ ভাগ করতে অসুবিধা কোথায়? সেক্ষেত্রে ৪০ শতাংশের এই নীতি বাস্তবায়ন শিক্ষা উন্নয়নের আকাঙ্খা কতটুকু অগ্রসর হবে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। সরকার যদি চায় দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান উন্নত হোক সেক্ষেত্রে শিক্ষার সকল পর্যায়ে একটি সার্বজনীন নীতি গ্রহন করা উচিত। ভর্তি পদ্ধতির মত শিক্ষার মৌলিক একটি বিষয়ে অহেতুক পরীক্ষানীরিক্ষা না করে একটি স্বীকৃত ও স্থায়ী নীতিমালা তৈরী করা অনিবার্য।


৪০ শতাংশের এই নীতি ভর্তি সমস্যায় জটিলতা বাড়াবে
১. এই নীতি কার্যকর করতে গেলে এখন থেকেই ভর্তিচ্ছু শিশুদের অভিভাবকরা নগরের নামিদামি স্কুলের কাছে বাসা নিতে চাইবে যাতে তার সন্তানের ভর্তির বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত করা যায়। অথবা এই উদ্দেশ্যে সেখানে তাদের বাসা-বাড়ী না থাকলেও কোন ঠিকানা (আত্মীয়-অনাত্মীয়) ব্যবহার করবে ২. ঐ এলাকার বাড়ীর মালিকেরা বাসাভাড়া বাড়িয়ে দেবে যা বর্তমান বাসিন্দাদের জন্য একটি আর্থিক চাপের কারন হবে ৩. দূর্ণীতি, স্বজনপ্রীতি ও আঞ্চলিকতা বৃদ্ধি পাবে ৪. কোটা নির্ধারনের পদ্ধতি কি হবে কারা প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকবে তা একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয় ৫. সরকার নির্ধারিত ৪০ শতাংশ আঞ্চলিক কোটার সাথে মন্ত্রী-এমপি-আমলা-মেয়র-কমিশনার-মুক্তিযোদ্ধা-স্কুল কমিটি-স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যাক্তি-শিক্ষকদের শিক্ষক-কর্মচারীদের পোষ্য-আত্মীয়দের কোটা যুক্ত করলে মেধার ভিত্তিতে আসলে কত শতাংশ ছেলেমেয়ে ভর্তি হবার সুযোগ পাবে সেটি প্রশ্নবোধক ৬. ভৌগলিক সীমারেখা যেমন ওয়ার্ড-থানা কত কিলোমিটারের মধ্যে এই ব্যবস্থা কার্যকর হবে তা নির্ধারনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ন ৭. স্থানীয় ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালীদের দাপট বৃদ্ধি পাবে ও ভর্তি বাণিজ্য সম্প্রসারিত হবে।

কেন ১০০ ভাগ আঞ্চলিক পদ্ধতি ভর্তি দরকার
যে যে এলাকার বাসিন্দা তাকে সেই এলাকার স্কুলেই যাবার এই পদ্ধতিকে ‘জোনাল স্কুল সিস্‌টেম’ বলে। এই পদ্ধতি অনুসরন করার কথা দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা হলেও তা কখনো নীতির পর্যায়ে আসে নি। সরকারের বর্তমান সিন্ধান্ত এই অনিবার্যতার খন্ডিত ও অপরিকল্পিত প্রকাশ। তাঁরা যদি ‘আঞ্চলিক কোটা পদ্ধতিতে’ না যেয়ে ‘আঞ্চলিক ভর্তি পদ্ধতিতে’ যায় তাহলে এই সমস্যা সমাধানের একটি একমূখী সূদুরপ্রসারী অগ্রগতি হবে।

এই পদ্ধতি কার্যকর করতেও একটি বিস্তৃত নীতিমালা প্রনয়নের প্রয়োজন হবে। ১. এটি কার্যকর ও স্বচ্ছ করতে নির্ধারিত এলাকার প্রকৃত অধিবাসীদের সন্তানেরাই যাতে সেই স্কুলগুলোতে পড়তে পারে তার একটি নীতিমালা তৈরী করা। তা না করা গেলে এই সিন্ধান্তও কোন ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে না ২. দেশের সমস্ত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে আঞ্চলিক ভর্তি পদ্ধতি চালু করতে হবে। এক্ষেত্রে ওয়ার্ড-থানার ভর্তির স্তর-পরিধি ঠিক করা ৩. একটি এলাকার আর্থিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক, মেধা ও সুযোগের দিক থেকে অগ্রসর-অনগ্রসর সকল শিক্ষার্থী একই প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার অধিকার পেলে সেই অঞ্চলের ভারসাম্যপূর্ণ বিকাশ ও সুযোগের সমতা ঘটবে ৪. শিক্ষার্থী-অভিভাবক-প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোন নৈতিক-অনৈতিক প্রতিযোগিতার সুযোগ থাকবে না। কার সন্তান কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে এটা নিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে দম্ভ ও অহঙ্কার গড়ে ওঠে সেই চর্চা বন্ধ হবে। ভর্তি নিয়ে শিক্ষা খেত্রে যে দূর্ণীতি আছে তা অনেকাংশে বন্ধ হবে। ৫. একটি নির্ধারিত এলাকার ভাল-মন্দ সব ছাত্রছাত্রী নিজ্‌ এলাকায় প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার কারনে ফলাফলের ক্ষেত্রে ভারসাম্য আসবে ৬. শিক্ষার্থীদের দুরের কোন স্কুলে যেতে না হলে অর্থ-সময় বাঁচবে ও ঝামেলাও কমবে ৭. দূর-দূরান্তের স্কুলে যাতাযাতের কারনে যানবাহন-রাস্তাঘাটের উপর যে চাপ পড়ে তা কমবে। ৮. কেবল নানা প্রক্রিয়ায় ভাল ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে গড়ে ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোই কেবল ভাল ফলাফল করবে এক্ষেত্রে সেই গতানুগতিকার বৃত্ত ভেঙ্গে নতুন ধারা গড়ে উঠবে এবং আঞ্চলিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটা ইতিবাচক প্রতিযোগিতা শুরু হবে।

জোনাল স্কুল সিস্‌টেম, শিক্ষার মান উন্নয়নে আরেক ধাপ অগ্রগতি
পৃথিবীর প্রায় সব সভ্য ও উন্নত দেশেই প্রাথমিক-মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের তাদের নিজেদের এলাকার স্কুলগুলোতে যেতে হয়, এটাই সেই সব দেশের নিয়ম ও ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা কার্যকর হলে শিশুরা নিজেরা দল বেঁধে কাছের সেই স্কুল পায়ে হেঁটে যেতে পারবে, তা স্বাস্থ্যকর হবে ও পরিবেশ জ্ঞানও বাড়বে। এতে শিশুদের নিজের এলাকা সম্পর্কে একটা ধারনা গড়ে উঠবে। স্কুলগুলোর মধ্যে মান ও বৈষম্য ধীরেধীরে কমে আসবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে হীনমন্যতা ও আত্মবিশ্বাসের অভাব তৈরী হয় তা দূর হবে।

আমাদের দেশের শিক্ষার অনেক সমস্যা আছে, কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতার মাঝে অর্জনও কম নয়। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বছরের শুরুতে বই তুলে দিতে পারলে জোনাল স্কুল সিস্‌টেম’র পদ্ধতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করাও খুব কঠিন কাজ হবে না। কেবল প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা। স্কুলগামী শিশুদের নিজ্‌ এলাকার স্কুলে ভর্তি বাধ্যতামুলক হলে কোন প্রতিষ্ঠানে যদি ধারনের অধিক শিক্ষার্থী হয়- সেক্ষেত্রে লটারির মাধ্যমে তাঁদের ভর্তি করা হোক। পরিকল্পিত স্কুল ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজটি দেরিতে হলেও এখনই শুরু করতে হবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই এই প্রক্রিয়া একটি স্থায়ী ধারাবাহিকতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

ড. মঞ্জুরে খোদা টরিক, প্রাবন্ধিক ও গবেষক।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ৯:০৪
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×