"একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া ছিল আমার জীবনের এক স্বপ্ন। সম্ভবত এই স্বপ্নই আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা থেকে আমলাতন্ত্রের পথে নিয়ে এসেছিল। ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন একটি ফিয়াট ৬০০ গাড়ী কিনেছিলাম। বেশ কিছুকাল ওটা চালিয়েছি এবং কোন দুর্ঘটনা ব্যতিরেকেই। তবু অনেক সাধ্যসাধনা করে তখন একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স যোগাড় করতে পারিনি। চট্টগ্রাম কোর্ট হাউসে গিয়ে কয়েকবার ধরনা দেয়ার পরেও কোন লাভ হয়নি। শেষবার যখন গেলাম, ট্রাফিকের ডিএসপি সাহেব বললেন,পরীক্ষায় পাস করতে না পারলে আমি কি করব? আমাকে বসতে বলার সৌজন্যটুকু পর্যন্ত তিনি প্রকাশ করেননি। আমি যখন তাঁর অফিসে কথা বলছিলাম, তখন একজন কম বয়সী তরুণ এলেন। ডিএসপি সাহেব তাঁকে দেখে শশব্যস্ত হয়ে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বললেন, আপনি এখানে কেন স্যার?
আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স দরকার।
আমাকে স্যার আপনি ডেকে পাঠালেই পারতেন। ঠিক আছে, আমি আজই আপনাকে লাইসেন্স পৌঁছে দিয়ে আসব।
শুনে ভদ্রলোক খুশি হয়ে চলে গেলেন। উনি চলে যাওয়ার পর আমি ডিএসপি অফিসার কে বললাম, উনাকে পরীক্ষা দিতে হবে না?
আরে সাহেব! প্রায় ধমকে উঠলেন ডিএসপি, উনি হলেন অ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার। উনার আবার পরীক্ষা কি?
সেদিন মনে হয়েছিল, এদেশে আসলে মানুষের দুটো জাত। একটি সরকারি মানুষ, অন্যটি বেসরকারি মানুষ। ঐ সহকারী কমিশনার হয়ত আমার ছাত্রও হতে পারতেন। কিন্তু তিনি তিনিই, এবং আমি আমিই। সেদিনই মনে হয়েছিল, যদি কোনদিন সরকারী চাকরিতে ঢোকার সুযোগ পাই,তাহলে একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স বানিয়ে ফেলব। তা না হলে লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ী চালাব। কপালে যা ঘটে ঘটুক।
বঙ্গভবনে এসে প্রথমেই ঠিক করলাম, একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স করা প্রয়োজন। গ্যারেজ সুপারভাইজার খুরশীদুল ইসলামকে জানাতেই তিনি বললেন, স্যার! বঙ্গভবনে এতজন ড্রাইভার থাকতে আপনার ড্রাইভিং লাইসেন্সের প্রয়োজন কি? ড্রাইভাররা কাজ না পেলে বরং ছাঁটাই হয়ে যেতে পারে।
বললাম, আমার ড্রাইভিং লাইসেন্সের সঙ্গে বঙ্গভবনের ড্রাইভারদের কোন সম্পর্ক নেই। চিরকাল এখানে থাকব না, সুতরাং ওটা করে নেয়াই ভাল।
খুরশীদ আর দ্বিরুক্তি করেন নি। আমার পাসপোর্ট সাইজের ছবি নিয়ে চলে গিয়েছিলেন।
দিন কয়েক পরে ট্রাফিকের ডিএসপি এলেন অফিসে। ড্রাইভিং লাইসেন্স তুলে দিলেন আমার হাতে। বললেন, যে কোন প্রয়োজনে আমাকে বলবেন স্যার। আপনাদের খেদমত করার জন্য আছি।
তাঁকে বসিয়ে আপ্যায়ন করলাম। লাইসেন্সখানা পেয়ে মনে মনে আবেগে আপ্লুত হলাম। এটা পাওয়ার জন্য আমি কম চেষ্টা করিনি। আজ কত সহজে এটা হাতে এসে গেল! কোন পরীক্ষা দিতে হল না, টাকা পয়সাও না। তাঁক বিদায় দিয়ে আমার ব্যক্তিগত সহকারি আবদুল গণি হাওলাদারকে ডাকলাম। বললাম, একজন মানুষের কি কি লাইসেন্স সার্টিফিকেটের দরকার হয়?
গণি কথাটা প্রথমে বুঝতে পারেননি। পরে বললাম, পাসপোর্ট, বন্দুক-রিভলবারের লাইসেন্স, বার্থ সাটিফিকেট, ডেথ সার্টিফিকেট...
ডেথ সার্টিফিকেট স্যার? গণি প্রশ্ন করলেন।... আমি বললাম, যদিও ওটা জোগাড় করে রাখতে পারলেই ভাল হত।"- মাহবুব তালুকদার, 'বঙ্গভবনে পাঁচ বছর' নামক আত্মজৈবনিক গ্রন্থটিতে এমন অসংখ্য স্মৃতি অবলীলাক্রমে বর্ণনা করেছেন। পেশার পাশাপাশি লেখালেখিতে অবদান রেখে গিয়েছেন। আজীবন আপোষহীনভাবে আমলাতন্ত্রের সহিত সম্পৃক্ত ছিলেন। ২০১৭-২০২১ হুদা মার্কাদের বিপরীতে একমাত্র আপনিই জনগণের সেবক ছিলেন। বড় কঠিন সময়ে চলে গেলেন।
সৎ সাহস, সততা ও দেশপ্রেমের মাঝে আপনি ভালোবাসায় থাকবেন স্যার।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০২২ সকাল ১০:৫৭