somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এই মাটি নীতিকথা শুনবে? দুর্নীতি কি দেশ ছাড়বে?

১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আচ্ছা ধরো, একটা মানুষ খারাপ কাজ করতে করতে নিজের মুখটাই তিক্ত, কালো করে তুলেছে। সে চুরি করে, ব্যাংক রবারি করে, টেন্ডারবাজি করে, ঘুষ করে ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন তুমি কি বলতে পারবে যে সে আর দুই তিন বছর পর এরকম থাকবে? তার মধ্যে যে চেঞ্জ হবে এটার নিশ্চয়তা কি? আবার চেঞ্জ যে আসবে না এটারও বা নিশ্চয়তা কি? বলা বাহুল্য সে ভবিষ্যতে কি হবে, কোন ভাতটা খাবে, কোন মানুষটার সান্নিধ্যে থাকবে এসব কিছু বলা যায় না তবে একটা জিনিস কিন্তু দেখা যায়, সে কোন কাজটা বর্তমানে করছে, তার মধ্যে ভালো হবার ইচ্ছেটুকুও আছে কিনা। আবার এটাও দেখা যায়- (যেহেতু আমরা মানুষ আমাদের মধ্যে তুলনা করার একটা প্রবণতা কাজ করে। সাইকোলজির ভাষায় যেটাকে বলা হয়, Contrast Effect!) ধরো মানুষটার বড় ভাই খুব খুন টুন করে কুখ্যাত ডাকাত হিসেবে একসময় নাম কুড়িয়েছিলো। ঘটনাচক্রে সে আজমির শরীফে গিয়ে কিংবা তীর্থে গিয়ে অথবা কোন পরিবারবিমুখ সন্ন্যাসীর সান্নিধ্যে গিয়ে খুব সাধু বেশে তার ভাইটার কাছে ফিরে আসলো। এখন মানুষটার মধ্যে একটা তুলনা করার প্রবণতা কাজ করবে। 'আমার ভাইটা এরকম কেন হলো? আমি কি ঠিক কাজ করছি কিনা?' শেষমেষ আত্মতুলনা থেকে শুরু হয় অনুকরণ। মানুষটাও তার ভাইয়ের সান্নিধ্যে থেকে থেকে ভালো হওয়ার দিকে একটু একটু করে পা বাড়াতেই পারে! আশ্চর্যের কিছু না। কথাটা হচ্ছে, ভবিষ্যৎ কি হবে সেটা আমরা না জানলেও তার বর্তমান অবস্থা থেকে আমরা সেটা ধারণা করতে পারি।

দুর্নীতি নিয়ে দুই একটা কথা বলি। প্রাথমিক সময়ে দুর্নীতিটা ছিলো প্রশাসনিক। তখন আমলাতান্ত্রিক পর্যায়ের প্রশাসনিক কাঠামোতে দুর্নীতি হতো। শেষমেষ রাজনীতিতে দুর্নীতি একটা বড় জায়গা দখল করে। কিভাবে? লর্ড এ্যাক্টনের একটা কথাই সেটা বোঝার জন্যে যথেষ্ট- "Every power tends to corrupt, absolute power tends to absolute." রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ক্ষমতা বন্টণের তাত্ত্বিক আলোচনার এই অংশটি এটাই ব্যাখা করে যে প্রতিটা ক্ষমতাই দুর্নীতির জন্ম দেয় আর যদি কেউ পূর্ণ ক্ষমতা পায় তাহলে তো দুর্নীতি তো মাথায় চেপে বসে। অর্থাৎ ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ রাজনীতির জায়গাটায় দুর্নীতির উদ্ভব ঘটায়। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এই প্রবণতা বেশী। যার ব্যতিক্রম নয় বাংলাদেশও!


বাংলাদেশে ইটের ফাঁকে ফাঁকে দুর্নীতি। আজ মাছ কিনতে গেলেও সেখানে বড়টা পাবার জন্যে দুর্নীতি করতে হয়, অফিস থেকে ছুটি নেবার জন্যে বসের সামনে দাঁড়ালেও সেখানেও নীতিকে আগে ছুটি দিতে হয়, শান্তিমতো একটা পরীক্ষা দিতে যাও, পরীক্ষার প্রশ্নপত্রই যে দুর্নীতির একটা পণ্য হয়ে তোমার খাতার পাশে লেপ্টে আছে! অর্থমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন, দুর্নীতিতে ক্ষতি হয়েছে ৫.৬৯ বিলিয়ন ডলার (১০ জুন, ২০১৫; বেনারনিউজ.অর্গ)! এছাড়া আরো তো দৃশ্যমান কিছু দুর্নীতি প্রতিনিয়ত কাগজে ভাসে।

বাংলাদেশে দুর্নীতি একটা সময় বিশেষ করে স্বৈরাচার সরকার ব্যবস্থার মূলোৎপাটন হওয়ার পরই এটি জেঁকে বসে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতির সূচকে যেমন বাংলাদেশকে একটা মান দ্বারা বিচার করেছে। ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রথম, ২০০৬ সালে তৃতীয়, ২০০৭ সালে সপ্তম, ২০০৮ সালে দশম, ২০০৯ সালে ত্রয়োদশ, ২০১০ সালে দ্বাদশ, ২০১৩ সালে ষোড়শ এবং ২০১৪ সালে চতুর্দশ স্থান অর্জন করার এই ক্ষেত্রটা থেকে কী দেখা যায়? সংস্থাটির এই দুর্নীতির আঙ্গুলটা যায় সরকার, সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং কিছু নিয়ম ভঙ্গকারী নাগরিকের দিকে। ভালো, বেশ ভালো। তো কথা হচ্ছে রাষ্ট্র তো নূন্যতম পর্যায়েও তো কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করছে এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে। সে দিক থেকে কিছু আশার কথা শোনানো যায়। যদি বর্তমান সরকার বাংলাদেশ ডিজিটালাইজেশনের আদর্শে প্রকৃতই অটুট থাকে তবে এই ডিজিটালাইজেশন দুর্নীতি অনেক জায়গা থেকে কমিয়ে আনতে পারে বইকি! সেক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য উন্নতি হচ্ছে 'জিরো প্রসেস সিস্টেম'। অর্থাৎ তোমার ফাইল এপ্রুভ করার জন্যে এক ডেস্ক থেকে আরেক ডেস্কে দৌড়ে বেড়াতে হবে না। এক ক্লিকেই নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট কাজ! এরকম একটা সিস্টেম কিন্তু অলরেডি চালু হয়ে গেছে। কলেজ এপ্লিকেশন হচ্ছে এরকমই একটা উদাহরণ। যেভাবে অনলাইনে পছন্দানুযায়ী নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়েছে, কিছু সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, অভাব অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রথম প্রয়োগে ভালোয় ভালোয় উতরে গেছে। ডিজিটালাইজেশনের আরো একটা ভালো উদাহরণ হচ্ছে স্মার্টকার্ড। নি:সন্দেহে প্রকল্পটা ভালো। অনেক কাগজপাতির বিদঘুটে জট থেকে, বিশেষ করে দুর্নীতির খোলা একটা জানালা বন্ধ করে দেওয়ার মাধ্যমে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

(আমি কি এতক্ষণ সরকারের বন্দনা করলাম? না। আসলে তারা কোনদিকটা থেকে দুর্নীতিটা কমিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সেটার একটা ধারণা নিজে পাওয়ার চেষ্টা করলাম।)

উপদেষ্টা সরকারের সময়ই সম্ভবত প্রথম দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে লেগে যাওয়া হয়েছিলো। তৎকালীন সময়ে প্রতিষ্ঠিত দুদক আজ নখদন্তহীন বাঘে যে পরিণত হয়েছে তার কারণ হচ্ছে ওই ক্ষমতার এককেন্দ্রিকরণ।
সমাজের তৃণমূল থেকেই দুর্নীতি সংঘটিত হয়। একজন ভিখিরি থেকে তা সরকারস্থানীয় ক্ষেত্রগুলোতে স্বাভাবিক ভাবেই ছড়িয়ে যায়। ভিখিরি যখন কোন জায়গায় গিয়ে ভিক্ষা পায় না ভিক্ষুক দখলবাজির জন্য তখন তাকে সিন্ডিকেট করে ভিক্ষা শুরু করতে হয় যার আউটপুট হচ্ছে দুর্নীতি।

এর কারণ হচ্ছে শ্রেনী সংগ্রাম বা ক্লাস স্ট্রাগল। যদি মার্ক্সবাদের তত্ত্ব দিয়ে দেখা যায় তবে এটা বোঝা যায়, এই দুর্নীতির প্রাচুর্য্যই দুর্নীতির লোপ ঘটাবে বিদ্রোহ সৃষ্টির মাধ্যমে। (যদিও আমি অনিশ্চিত এটার ভিজিবিলিটি সম্পর্কে!)

কয়েকটা কথা বলে শেষ করে দিই।

১৯৬৫ সালে সিঙ্গাপুর আমাদের এই লাল সবুজ দেশটার থেকেও ভয়াবহ ভাবে দুর্নীতিতে আক্রান্ত ছিলো। কিন্তু তবুও এখন বিশ্বে টপ ফাইভ দুর্নীতিমুক্ত দেশের তালিকায় আমাদের এশিয়ার এই দেশটার নাম ঢুকে পড়েছে। কিভাবে সম্ভব? তিন চারটা কারণ দেখালেই যথেষ্ট।

প্রথমত, তাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোন কমতি ছিলো না। এই সদিচ্ছার ওপর ভিত্তি করে একের পর এক অন্যান্য দুর্নীতিবিরোধী অবকাঠামো গড়ে তুলেছিলো। তারা কথা আর কাজের মিল রেখে নাগরিকদের মধ্যে একটা আদর্শগত ঐক্য তুলে এনেছিলো। আদর্শগত ঐক্য! এটাই অন্যান্য সব গঠণের ইম্পর্ট্যান্ট ব্লক।

দ্বিতীয়ত, একটা সুনির্দিষ্ট ফ্রেমওয়ার্ক তারা গঠন করেছিলো প্রথমটির ওপর ভিত্তি করে। এর মধ্যে আছে কতগুলো দুর্নীতি নিরসন আইন, আইন প্রয়োগকারী কতগুলো নিরপেক্ষ সংস্থা- এর মধ্যে আছে সবচেয়ে বলপ্রয়োগ সম্পন্ন CPIB (Corrupt Practices Investigation Bureau) আর আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তি। CPIB এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুবিধা হচ্ছে সিঙ্গাপুর সরকার একে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছে। ফলে সে হস্তক্ষেপহীনভাবে আইনি কার্যকলাপগুলো চালাতে পারে। আর আইন না মানলে শাস্তিটা কিরকম? সাধারণত ঘুষ গ্রহণের জন্যে পাঁচ বছর জেল। আর যদি ঘুষ গ্রহণের দায়ে কোন ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হয় তবে তাকে ঘুষের সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা করা হবে যদি না যার কাছ থেকে ঘুষগ্রহণ করা হয়েছে সে যদি কিছু দাবি না করে।

তৃতীয়ত, শক্ত এবং কার্যকর প্রশাসনিক ব্যবস্থা। এ নীতির মধ্যে তারা রেখেছিলো সহজভাবে নাগরিক সেবা প্রদান, জিরো স্টেপ প্রসেস, অভিযোগ সেবা, OBLS (Online Business Licensing Service) যেটা লাইসেন্স সিস্টেমকে ডিজিটালাইজড করে দিয়েছিলো।

এগুলো কাগুজে কথা। আসল কথা হচ্ছে নীতিগত ঐক্য যেটার কারণেই সিঙ্গাপুরের এই কালোত্তীর্ণ দশা। তবে আমি বলব আশা আছে। একেবারে শূণ্যের কোঠায় না গেলেও তলানির জায়গাটায় দুর্নীতিকে দেখার আশা আছে। কেননা মানুষগুলোর ঘুম ভাঙ্গতে শুরু করেছে। মানুষ বিতর্ক করে, টকশো করে, লেখালেখি করে এই দুর্নীতি নিয়ে। কেননা সে দুর্নীতি নিয়ে একটু হলেও ভাবতে শিখেছে। আর যে একটু হলেও ভাবতে শিখে তার কাজে সেই একটুটাও ছাপ ফেলতে দ্বিধাবোধ করে না। হয়তো সেটা একশ বছর পর কিংবা তারও বেশী!
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:০৭
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×