somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রসঙ্গ: শত্রুর সঙ্গে বসবাস

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হালকা হালকা শীত জেঁকে বসছে।

লাইটের আলো কমছে।

রাত বাড়ছে।

আমিও লিখে রাখি।

কে এই বিদিশা?

এরশাদের চরিত্র কতটা সুন্দর?

বিদিশা কি নিষ্কলঙ্ক?

অনেকে নামটা হয়তো ভুলে গেছে। অনেকে চেনেও না। আবার অনেকে চেনে। বাংলাদেশের রাজনীতি অঙ্গনে, নারী অধিকারের জায়গাটুকুতে একটা নাম জ্বলজ্বল করে উঠেছিলো ক্ষণিকের জন্যেই। আবার মিইয়ে যেতেও সময় লাগেনি। শোভরাজকে আমরা যেরকম ভুলে গেছি, নিউইয়র্ক ম্যাড বোম্বারকে যেভাবে ভুলে গেছি তেমনি এঁকেও। এনার নাম বিদিশা। জীবনানন্দের বিদিশা নন, পরিচয়- বিশ্ববেহায়া এরশাদের সাবেক দ্বিতীয় স্ত্রী। চল্লিশ বছরের মধ্যবয়স্কা নারী তার জীবনের ঘটনাবলী নিয়ে একটা আত্মজৈবনিকমূলক বই লিখেছেন এই পাঁচ-ছয় বছর আগে (বইটার নাম ধাম শেষে দেওয়া হলো)। আমিও চিনতাম না। চিনতে হলো, সময়ের প্রয়োজনে। বইটা পড়ে কিছু চিন্তাও এসেছে মাথায়। বেশীরভাগই তাঁর জীবন বিশ্লেষণের ওপর।

প্রথমেই আত্মজীবনীগ্রন্থ সম্পর্কে কয়েকটা কথা বলা দরকার। এগুলো সাইকোলজিস্টদের মতামত, না জানলে ক্ষতি নেই তবে আত্মজীবনীর নির্ভুলতা সম্পর্কে অনেককিছু অজ্ঞাত থেকে যায় (আসলে এই মতামতগুলোর প্রতি আমার নিজের সমর্থন আছে)। স্মৃতি আমাদের প্রতারণা করে। বাস্তবে অতীতে যা ঘটেছিলো তা থেকে এই স্মৃতি আমাদের বহুদূরে সরিয়ে দেয়। প্রশ্নটা হচ্ছে কিভাবে? উত্তরটা হচ্ছে অনেকভাবে। ফ্রুটিকার বিজ্ঞাপনটা মনে আছে? বাবা ছেলের ফেল নাম্বার পাওয়া খাতা দেখে বলতে লাগলো, "তুই আমার ছেলে হয়ে অংকে বিশ? জানিস! আমি অংকে কত পেয়েছিলাম?...(তারপর ফ্রুটিকা গেলানো হলো) তেত্রিশ!... এর পরে আর কোনটিতেই ত্রিশের বেশি নাম্বার পাই নি।" ফ্রুটিকা খাওয়ার আগে তার হাবভাব কিরকম লাগছিলো? তিনি নিশ্চয়ই ছাত্রজীবনে অংকের খাতা উড়িয়ে উড়িয়ে বড় 'অংক' এর নাম্বার পেয়েছেন। এ জায়গাতেই ছলনা। আসলে উনি অংকে কত পেয়েছিলেন ছাত্রজীবনে- এটাই স্মৃতি বিকৃত করে, ভুলভাবে মস্তিষ্কে রক্ষিত করে রেখেছে। যখন মস্তিষ্ক ভুলভাবে অতীতকে স্মৃতি হিসেবে ধরে রেখেছে তখন এই স্মৃতি তার বর্তমান আচার আচরণ, এ্যাটিট্যুডকে প্রভাবিত করেছে। এটাকে বলে Consistency Bias. বাংলায় কী বলা যায়? স্থায়িত্ব ত্রুটি? কাগুজে নাম। যা হোক! অর্থাৎ যখন বর্তমান আচার আচরণ পূর্বের বিকৃত স্মৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয় তখন তাকে বলে স্মৃতির স্থায়িত্ব ত্রুটি।

জড়তাবশত কল্পনার বিহারে ছুটে বেড়াতে বেড়াতে নিজের আত্মজীবনীতে এমন অনেক কিছুই আসতে পারে যার পুরোটাই কল্পনা। যেটা বাস্তবে কখনো ঘটেই নাই। সাধারণত এটাকে False Memory বা অসত্য স্মৃতি বলা হয়। আবার যখন কেউ মনে করে তার অতীতে তাকে নিয়ে কোন ঘটনা ঘটেছিলো যখন তাকে নিয়ে আদতে কোন ঘটনাই ঘটে নাই তখন এই স্মৃতিবিভ্রাটকে বলে Cryptomensia. ধরো, আমি হঠাৎ করে বলতে লাগলাম অথবা আমার মনে হতে লাগলো অমুক মেয়ের সাথে আমার প্রেম ছিলো, এমনকি মেয়েটার সাথে কোথায় কোথায় ঘুরেছিলাম এগুলোও হড়বড় করে বলে যাচ্ছি... যখন মেয়েটার সাথে আমার কোন পরিচয়ই নাই। এটাই সেটা। মানে Cryptomensia. এটা যখন কারো মধ্যে খুব বেশী পরিমাণে দেখা দেয় তখন এটাকে রোগ বলা যায়। এমনিতে সব আত্মজীবনীতেই টুকটাক এই কল্পনাজনিত ত্রুটি দেখা যায়। এটা হয় কারণ, সময়ের সাথে সাথে মস্তিষ্কের নিউরনের বিভিন্ন প্যাটার্নে রাখা স্মৃতিগুলোর Decay হতে শুরু করে। এই Decay-র ফলে স্মৃতিতে অনেক গ্যাপ সৃষ্টি করে। আমরা মানুষরা অদ্ভুত প্রাণী। এই গ্যাপগুলো আমরা বর্তমান পরিস্থিতি, ইচ্ছা, কল্পনা ইত্যাদি দিয়ে মনের মাধুরী স্বরুপ এক একটা স্মৃতির সৃজনশীল ভাস্কর্য গড়ে তুলি যা প্রকৃত স্মৃতি থেকে পুরোই আলাদা। অর্থাৎ, আমরা যখন মগজে কোন কিছু ঢুকাই তখনও আমরা প্রতারিত যেমন হতে পারি তেমনিভাবে যখন মগজ থেকে যখন কিছু বের করি তখনও নানাভাবে প্রতারিত হতে পারি (শেষের অংশটাই আলোচনা করা হলো)।

আরেকটা কথার কথা না বললেই নয় সেটা একটু বেশীই প্যারাডক্সিকাল মজার। আমরা এখন যেভাবে নিজেদের, অন্যদের দেখি সেই দেখার সাথে কোন ঘটনা যদি তীব্রভাবে নেগেটিভ হয় আমরা না চাইলেও সেটা মনে রাখি। যেমন, আমার বেস্টফ্রেন্ড খুবই বিশ্বস্ত। সে আমাকে না বলে কয়ে আমার কোন জিনিস ব্যবহার করে না। সেই বন্ধুটিই যদি কোন ক্ষেত্রে আমার স্মার্টফোনটা চুরি করে কিংবা গল্পের বইটা নিয়ে পগার পার হয় তখন এই ঘটনাটা আমি মনে রাখতে বাধ্য হব যদিও ঘটনাটা আমার দিক থেকে অতিমাত্রায় নেগেটিভ (যেহেতু তার এই ব্যবহার যদি বাস্তবে ঘটতো আমি খুবই শকড হতাম!)। সবশেষে যে স্মৃতি যতবেশী আনন্দদায়ক, সেই স্মৃতি আমরা আরো বেশী ভালোভাবে মনে রাখি। একটা স্টাডিতে দেখা গিয়েছিলো যে আমেরিকার মিডল এজ মানুষরা তাদের স্কুল লাইফের ভালো নাম্বারটাই বেশী ভালোভাবে মনে রেখেছেন খারাপ রেজাল্টগুলোর তুলনায়। তেমনি আমরা যেরকম ফেল করার কাহিনী ভালো করে মনে রাখি আবার অন্য সবাইকে পেরিয়ে সর্বোচ্চ র‍্যাঙ্কিং এ যাওয়ার ঘটনাগুলো আরো ভালোভাবে মনে রাখি।

এত কচকচানির কী দরকার ছিলো? এটাই বলতে চাচ্ছি, আত্মজীবনী সবসময় আত্মজীবনী না। আমরা আসলে কেউই আত্মজীবনী লিখতে পারি না। যা সাদা কাগজে লিখি তা হলো নিজের জীবন দর্শন। আত্মজীবনী হলে তাতে কোনরকম বায়াসড কোন কিছু থাকতে পারবে না। আর আমরা যে স্মৃতি দ্বারা কতভাবে বায়াসড হতে পারি, প্রতারিত হতে পারি তাতো বললামই। তাই নিরপেক্ষভাবে জীবন বিশ্লেষণ সত্যিই খুব কঠিন। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এই আত্মজীবনীগুলো Ego-centric হয়। অর্থাৎ নিজের সাপেক্ষে পর্যালোচনা।

বিদিশা কে?

বাংলাদেশের ষাট সত্তরের দশকের একজন কবি আবু বকর সিদ্দিকের বড় মেয়ে। প্রথমে নাম ছিলো দীনা। পরে চেঞ্জ হয়ে হয়েছে বিদিশা। নিচে আরো দুই বোন ছিলো। মনিষা আর তৃষা। আরো দুই বোন ছিলো। বিপাশা, পিয়াসা। বাবা বড় মেয়েকে বড় প্রশ্রয় দিতেন। সেই প্রশ্রয়ের স্বরুপ- একটা ইলিশ মাছ আনা হলো। বিদিশা তারিয়ে তারিয়ে পুরো মাছ খাচ্ছে। বাবা দেখে বড়ই আনন্দিত। মা, আর বাকি বোনগুলো ক্ষোভে কাতর। তবে বাইরে প্রকাশ হচ্ছে না। বাবার বিদিশার প্রতি বেশী টান ছিলো। প্রায়ই তিনি ঢাকা, রাজশাহী নানা সাহিত্য সম্মেলনে যেতেন। সঙ্গে থাকতো বিদিশা। দুই মাস, তিনমাস হয়ে যেত অনেকসময়। বিদিশার স্কুল কামাই হচ্ছে। পরিবার চলছে না। এই দুই মাস, তিনমাস কিভাবে চলবে তার কোন চিন্তাই কবির ছিলো না। কবি তো কবিই! জীবনের জটিলতা কবিদের স্পর্শ করে না।

মা কি চুপ করে বসে থাকতো?

মোটেই নাই। মার! মার! চুল ধরে টেনে নিয়ে বিদিশার উপর রীতিমতো পৈশাচিক টর্চার করতেন। নতুন এক ধরণের কৌশলও তিনি বের করেছিলেন। গাল দুটো একেবারে ভিতরের দিকে ঢুকিয়ে মাড়ির সাথে ততক্ষণ পর্যন্ত চেপে ধরতেন যতক্ষণ না রক্ত বের হতো। এই নির্যাতনের এক পর্যায়ে মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে যেতো। চুলের গোছা মুঠি করে একেবারে পিঠের ওপর দমাদম বসতো কিলের পাথর। মায়ের কাছ থেকে এরকম নির্মম শাসন পেয়েছে যেমন, তেমনি বাবার কাছ থেকে পেয়েছে অতিরিক্ত প্রশ্রয়।

বিদিশা ছিলো দুরন্ত। তাকে বেশীরভাগ সময় ছেলেদের পোশাক আশাক পরানো হতো। এ গাছ, ও গাছ করে তার সারাদিন কাটতো।

শৈশবের চৌদ্দ বছর বয়সে কবি তার মেয়েকে নিয়ে যান ঢাকার সাহিত্যের কোন একক কাজে। সেখানেই পিটার উইসন নামে বাবার এক বন্ধুর সাথে তার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। পিটার উইসন লন্ডনে থাকে। বিয়ের 'ব' না বোঝা মেয়েটা তখন উড়ে চলে যায় পিটারের সাথে। এর আগেও পিটারের সাথে কবি পরিবারের যোগাযোগ ছিলো। ভালো সম্পর্ক ছিলো। বিদিশা পিটারকে আঙ্কেল আঙ্কেল বলে ডাকতো। বয়সের ব্যবধান? পিটার ছাব্বিশ, বিদিশা চৌদ্দ।

এই পিটার উইসনের যা সমস্যা তা হচ্ছে এর আবেগের পরিমাণ তলানির মতো। বড় বেশী প্র্যাক্টিকাল। লজিকের আন্ডারে সব বিবেচনা করে। পিটার বিদিশাকে বিয়ে করেছে ঠিকই কিন্তু বিয়ের ভিত্তিটা যেন প্রেম না। ভিত্তিটা হয়ে গিয়েছে শিক্ষক-ছাত্রী সম্পর্ক। এটা তাদের রাজশাহীতে প্রথম পরিচয়ের দিক আর মাত্রাগুলো থেকেই আভাস দেয়। পিটার বিদিশাকে পড়ালেখার মাধ্যমে নিজের পায়ে গড়ে তোলার এক প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিলো। পনের বছরের বিদিশাকে লেখা তার '৮৬ সালের এক চিঠির অংশ থেকেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে।

"...তোমার নতুন স্কুল সম্বন্ধে কিছু ইনফরমেশন পাঠাচ্ছি। তোমার টার্ম সেপ্টেম্বর মাসে শুরু হয়। স্কুলের ফিজ খুব বেশী (সপ্তাহে প্রায়ই ৩৫০০ টাকা হবে।) কিন্তু স্কুলটাকে যদি তোমার ভালো লাগে তবে ওখানে তুমি অন্তত: এক বছর থাকতে পারবে। অন্য সম্বন্ধে আমি হয়তো কৃপন স্বভাব, কিন্তু তোমার শেখার জন্যে আমি দরকার হলে দেউলিয়া হয়ে যাব..."

প্র্যাক্টিকাল পিটার সফল হয়েছিলো অবশ্য। ফ্যাশন ডিজাইনিং এর ওপর লা সালে-তে পড়াশোনা আর অর্থ বিভবের ওপর কর্তৃত্ব বিদিশা পেয়েছিলো ফ্যাশন ডিজাইনিং কে কেন্দ্র করেই।

ইউরোপিয়ান কালচারের মধ্যে বিদিশার কৈশোর অতিক্রান্ত হয়। স্বভাবতই, তার ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান ছিলো নগন্য। সেখানের সংস্কৃতি তাকে প্রভাবিত করেছে অনেকদিক দিয়ে। উনিশ বছরের বিদিশা এক পর্যায়ে দুই সন্তানের মা হয়।

ঢাকায় এসে বিদিশা কাজ করা শুরু করে। এখানেই পরিচয় হয় স্বৈরাচার এরশাদের সাথে। তখন আটানব্বইয়ের কাছাকাছি একটা সময়। বড়লোকের ঘরে কৈশোর অতিক্রম করা বিদিশা তখন পুরোদস্তুর আধুনিক এবং বিদেশি। হার্ডড্রিংক পান করা তার কাছে পানি পানের মতো স্বাভাবিক, প্রিম্যারিট্যাল সেক্স কোন ফ্যাক্টর না তার কাছে। কেননা এটা ইউরোপিয়ান সভ্যতা। সে ইউরোপিয়ান নাগরিকও!

এরশাদ বিদিশাকে পটানোর যে যে কর্মকান্ড অবলম্বন করে তা হচ্ছে একদিকে যেমন কৌতূহলোদ্দীপক তেমনি হাস্যকর ধূর্ততার বহি:প্রকাশ। স্বামী থাকে পৃথিবীর এক প্রান্তে আর স্ত্রী থাকে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে তার ব্যবসার স্বপ্ন নিয়ে। স্বভাবতই একজন বাঙ্গালি রক্তে সৃষ্ট নারী হওয়ায় তার ভেতরেও যে আবেগের তীব্র অপূর্ণ চাহিদা যে মেটানোর মুখ দেখতে পারে নি তার মূল কারণ, বিদেশী স্বামী। এরশাদ এই দূর্বলতাটা খুব ভালোভাবেই ধরে ফেলেছিলো। সে ক্রমান্বয়ে যে বিস্ময়করভাবে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রেখে বিদিশার ওপর নির্ভরশীলতা তৈরী করে আবেগপ্রধান সম্পর্কে যে যুবতীটিকে জড়িয়ে ফেলেছে তার বর্ণনা কিন্তু মুগ্ধকর। নির্ভরশীলতা যে প্রেমের সৃষ্টি করে তা আরেকবার সত্যের মুখ দেখলো। পরকিয়ায় লিপ্ত বিদিশার সাথে এরশাদ যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে। যখন বিদিশা মনে করেছিলো এরশাদ তার জন্য প্রেমে পাগল তখনই এই বিশ্ববেহায়া বিদিশার মতো আরো কয়েকটি মেয়ের সাথে অবাধে সম্পর্ক রেখে যাচ্ছিলো রওশান এরশাদের বর্তমানেই!

শেষদিকে এরশাদের লাম্পট্যের বর্ণনায় মুখ্যতা লাভ করে। এরশাদের নিজেকে বুড়ো না করার একটা স্বভাব আছে। ভায়াগ্রা খেয়ে খেয়ে তাই নিজেকে অন্যের সামনে জৈবিক স্বাবলম্বী যুবক হিসেবে প্রমাণের এক হাস্যকর চেষ্টায় লিপ্ত হওয়ার মজ্জাগত রোগও আছে তার। বিয়ের পর এরশাদের বাথরুমে চলে গিয়ে, 'মল্লিকা, মল্লিকা, দাদু দাদু করা' আবার এই দাদুর বয়সেই মেয়ে, নাতির সঙ্গে অবাধে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার ক্ষেত্রে তার নির্দ্বিধা এই বিষয়টিই আমাকে মনে করিয়ে দেয়, এটি আসলে মানসিক রোগেরই বহি:প্রকাশ।

এরশাদের প্রলোভনে একপর্যায়ে পিটারকে ছেড়ে দেয় বিদিশা। বিদিশা বিদিশা তখন এরশাদের প্রেমে পাগল। বিয়ের দুই এক বছর পরেই এরশাদের বেলাল্লাপনার চিহ্ন ধীরে ধীরে এরশাদের কাছে প্রকায় হতে থাকে। অফিস থেকে বালিশ, চাদর আবিষ্কৃত হতে থাকে যেমন তেমনি এরশাদের নানা মন ভোলানো কথায় বিদিশার মনে দুই ধরণের অস্বস্তি তৈরী হয়। ঘটনাক্রমে বিদিশা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। এরশাদের নানা নারীঘটিত কর্মে বিদিশা যেমন বাধা দিতে থাকে তেমনি ধীরে ধীরে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় বিন্দুতে পরিণত হয় বিদিশা।

শেষে একটা ষড়যন্ত্র ঘটে যায়। সেটার পিছনে এরশাদের হাত যে ছিলো সেটারও বলার অপেক্ষা থাকে না এর পিছনের কারণগুলো জানার পর। মোবাইল চুরি, গয়না চুরি, র এর গুপ্তচর হয়ে রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগ এনে বেশ কয়েকটা মামলা আনা হয় সরকার পক্ষ হতে এবং স্বয়ং জামাই এরশাদ থেকে।

বইয়ের শেষ কয়েকটা অধ্যায়ে হাজতে থাকার সময় এবং রিমান্ডে থাকাকালীন শোচনীয় নির্যাতনের কাহিনীই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পাঠকাকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে।

বিদিশা আগে একশ টাকা দিয়ে হোটেল থেকে মিনারেল ওয়াটার মাম কিনে খেত।

হাজতে তাকে ট্যাপের পানি খেতে হয়েছে।

বিদিশা আগে নরম বিছানা ছাড়া ঘুমাতে আরাম পেত না।

হাজতে তাকে ময়লার ভেতর গুটি পেকে শুতে হয়েছে।

নারী অধিকার? না সাম্রাজ্যবহুল অভিজাত জীবনের পতন?

আমার কথা সেটা না।

বিদিশার নিজের কাছে এই প্রশ্নটা এসেছে; কেন তার জীবনে এরকম ঘটলো? প্রতারিত হওয়ার এত নাটক তাকে সইতে হলো কেন

পিটারের সঙ্গে ডিভোর্স নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল এক বিকেলে। পিটার আবেগহীন হওয়া সত্ত্বেও কিছু তো দু:খ পেয়েছিল অবশ্যই। সেদিন সে অনেক কথাই বলেছিলো।

"...বিদ, তোমাকে আমি স্বাধীনভাবে বড় হতে দিয়েছি। আমার কাছে আসার পর, তোমাকে কাছে দেখার পর, মনে হয়েছে তোমার সঙ্গে আসলে অন্যায় হয়েছে। এ অন্যায় তোমার বাবা মা করেছেন, তোমার আত্মীয়স্বজন করেছেন এবং আমিও করেছি। বিয়ের মানেই যখন তুমি ভালোভাবে বোঝো না, তখনই তোমাকে আমার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের দু'জনের বয়সেও ছিল অনেক পার্থক্য। এ অন্যায়, এ অপরাধবোধ থেকেই আমি সিদ্ধান্ত নেই যে, তোমাকে তোমার মতো করে বড় হতে দেব। তোমার ইচ্ছেমতো বেড়ে উঠতে সাহায্য করবো। বড় হয়ে তুমি সিদ্ধান্ত নিবে, কোথায় তুমি থাকবে, কীভাবে থাকবে। কেবল কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য কোথাও থাকার দরকার নেই। এখন তুমি বড় হয়েছো। প্রতিষ্ঠিত হয়েছো। তুমি এখন ফ্রি, মুক্ত। তোমার যা ইচ্ছা, যা ভালো লাগে তাই করতে পারো।..."

আমার ধারণা, ইচ্ছেমতো সুযোগ দেওয়াটাই মহা ভুল ছিলো।

আমিও আমার মতো করে উত্তরটা খোঁজার চেষ্টা করেছি।

সবসময় রুটে ফিরে যেতে হয়। তাঁর বাবা থেকেই শুরু করি।

দায়িত্বহীনতার চরম নিদর্শন আমরা কবি সাহেবের কাছে পেতে পারি। পরিবারকে অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে কিভাবে তিনি জায়গায় জায়গায় বেড়াতে পারেন? বড় মেয়েকে প্রাধান্য দিয়ে অন্য দুই মেয়ের প্রতি বৈষম্য আর যাই হোক কবিদের স্বভাব না।
বিদেশির সাথে বিয়ে দেওয়ার পর পুরো পরিবার হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলো। নিজের মেয়ে পরবর্তীতে কিভাবে নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারবে, তার আবেগজনিত প্রয়োজনীয়তা কি ভালোভাবে পূর্ণ হবে কিনা তার অদূরদর্শী চেতনা কিংবা সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়টা পড়ে শুধু বাবার না পুরো পরিবারের ওপর।

দায়িত্বহীনতা শুধু কবিসাহেবের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয় নি। তা দেখা যায়, পিটারের মধ্যেও। এটা অবশ্য তাদের সংস্কৃতিরই দোষ। তাদের সংস্কৃতিই তাদের এরকম জড়বস্তুতে পরিণত করেছে। বিয়ে করার পর স্বামী স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির ফলে স্ত্রীর অন্যদের সাথে অবাধ যৌনসম্পর্ক তাদের লন্ডনি মনোভাব হতে পারে কিন্তু আমাদের রক্ষণশীল সমাজে ব্যভিচার বলেই পরিচিত। অবশ্য বিদিশা এটাও স্বীকার করেছেন, তাঁর ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান ছিলো নগন্য। দায়টা যায় পরিবারের ওপরও।

এরশাদ।

মানসিক বিকারগ্রস্ত সেক্স ম্যানিয়াক। তার নারী আকর্ষণই তাকে এরকম করে তুলেছে। বিকৃত যৌন আচরণ, স্বার্থান্ধ আর ক্ষমতার প্রতি অগাধ বিশ্বাস, লোভ একই সাথে তিন চার মেয়ের বয়সী, নাতির বয়সী স্ত্রী লোকদের সাথে নির্দ্বিধায় সম্পর্ক স্থাপন করতে প্রণোদিত করেছে।

এক হাতে কখনো তালি বাজে না। বিদিশা নিজেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে দোষী। তার নিজের বিবেকবোধ কি জাগ্রত হয় নি বৃদ্ধবয়সী লোকের সাথে মেলামেশার সময়? সংস্কৃতির সাথে আচরন পরিবর্তিত হলেও নিশ্চয়ই বিবেকবোধ পরিবর্তিত হয়ে যায় নাই?

অনেকে বলবেন আমি শেষের ঘটনাগুলো বাদ দিয়ে শুধু কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোকে পোলারাইজড করে ফেলেছি। দোষ তো বর্তায় তাদের ওপরও যারা হুকুমের চাকররূপে নারীদের প্রতি নির্যাতন করতে দ্বিধাবোধ করেন না। সেনাবাহিনী, সরকারের চাকরদের ওপরও। হাজী বকর, জসীম ইত্যাদি মনুষ্যত্বের আড়ালে বসবাস করা দুর্বল লোকদের ওপরেও?

জানি। এদের সম্বন্ধে কথা বলা বৃথা। রুটটাই আসল

বইয়ের নাম: শত্রুর সঙ্গে বসবাস (২০০৮)
লেখক: বিদিশা, সহলেখক: মাসুদ কামাল
প্রকাশনী: ইজাবেল
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:২৪
৫টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পোষ্টে যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ২/১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, বুঝবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



আপনার পোষ্ট যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, তখন খোঁজ নিলে দেখবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

কোন বিষয়ের উপর অনেক মানসম্পন্ন পোষ্ট লিখলেও সামুতে আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×