মৃত্যু আজ মৃতদেহরূপে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মৃতদেহটা দেখে বিস্মিত হতে হয়। যেন একটা মাটির পুতুলের ঠোঁটদুটো অসমান্তরালভাবে ফাঁক হয়ে আছে। সেই পুতুলটার কোন মূল্যই নেই। কে বলবে এই পুতুলটা গতকালই তার ছোট্ট মেয়েটার সাথে হাসি ঠাট্টায় জম্পেশ করে তুলেছিলো না ভোলার মতো শেষ সময়গুলো? কে বলবে? কে জানতো?
মাটির পুতুলটা আমার খুব পরিচিত। আজ যখন সবাই এই রাতে কবরটার আশপাশে ভিড় জমিয়েছিলো তখন একের পর এক স্মৃতিগুলো চোখের পটে ভেসে আসছিলো।
এলাকাতে আসার পর একটা ঘটনা মনে আছে। সেটা বোধ করি দুই বছর আগের ঘটনা। সদ্যই আমরা নতুন বাড়িতে উঠবো। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত এই আমি তখন শীত দুপুরে বাড়িটার নিচে বসে অন্যমনস্ক চোখে যন্ত্রটার ওপর আঙ্গুল বোলাচ্ছিলাম। ভদ্রলোক তখন দুপুরের খাবারটা খেতে আসছেন। আমাকে দেখে বলে উঠলেন,
"আপনারা নতুন?"
"জি।"
"আমি আপনাদের বাসার পাশেই থাকি। তার মানে..."
"নেইবার, প্রতিবেশী। "
হেসে উত্তর দিলাম।
উনিও হাসতে লাগলেন।
"আগে আমি দুবাইতে থাকতাম। এখানে কয়দিনের জন্যে টেম্পোরারি আরকি!"
"ও আচ্ছা।"
"ঠিক আছে। পরে কথা হবে। এখন চলি?"
এ স্মৃতি মনে থাকার কথা না। থাকলো কেন? আমার ধারণা...
এ ভদ্রলোক 'আপনি' বলার মাধ্যমে আমাকে একটা বিষয় উপলদ্ধি করে দিয়েছিলেন। আমি এখন ছোট্টটি নই। বড় হয়ে গেছি। অন্যদের কাছে। নিজেরও কাছে।
সেই ভোরের সময় রাস্তাটাতে ভদ্রলোককে মনে পড়বে। রোজ সকালে নিত্য রুটিনে রোদের মধ্যে হেঁটে যাওয়ার সময় দেখতাম অসুস্থ, ধী, ক্লান্ত শরীরে এই মানুষটি কারো সাহায্যের প্রত্যাশা না করেই ছুটে যাচ্ছে। তখন আমি তাঁকে আগে আগে যেতে দিতাম। যদি অসম্মান দেখানো হয়!
ছোট্ট মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করা হলো, তোমার আব্বু কোথায়?
সে কাঁপা কাঁপা আদুরে গলায় উত্তর দিলো, আমার আব্বু মাজারের পাশে কবরের ভেতর শুয়ে আছে। আমি আর ভাইয়া দেখতে যাব!
কি আর বুঝবে সে!
মেহমানে আনাগোনা বেড়ে গেছে ঘরটিতে। দুইদিন আগেও এদের কোন খবর ছিলো না। শোকে মূহ্যমান ঘরের মানুষগুলো যেখানে একটু ধাতস্থ হতে চায় সেখানে তাদের রান্নাঘরে ছুটতে হচ্ছে। কিচেনের টুংটাং শব্দ আর চায়ের গন্ধে আশপাশ নেশাতুর হয়ে যাচ্ছে। পায়ের ওপর পা তুলে মুরব্বিরা চা গলায় ঢালছে আর গল্প শুরু করছে এর ওর মৃত্যুর খবর।
"আরে এই হার্টের সমস্যা ঘরে ঘরে। আপনার শিমুলের কথাই ধরেন না। কে জানতো অর ভাইজির এরকম হবে!"
"আমার পাশের বাসার ভাবির মামারও একইরূপ অবস্থা। বয়স তো ছিল... "
"শোন মা, চিন্তা করবা না। চল্লিশ দিন কোন পরপুরুষ দেখবা না। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও। বেশী করে কোরআন শরীফ পড়বা।"
"এবার উঠি তাহলে..."
মৃত্যু মানে শোক নয়।
মৃত্যু মানে স্বার্থ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা।
মৃত্যু মানে গাল বেয়ে পড়া লবণাক্ত পানিবিন্দু নয়।
মৃত্যু মানে জিহ্বায় চায়ের স্পর্শ ঠেকানো।
আঙ্কেল এপারে তো হলো না, ওপারে ভালো থাকবেন।