somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কেন আমি ভালবাসা দিবস বিরোধী?

১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.

" Common Sense ain't Common. "
অর্থাৎ, কমনসেন্স কমন নয়।

এ কথাটা প্রথম বলেছিলেন মার্কিন কমেডিয়ান উইল রজার্স। এই কথাটা বলার পর একটা ব্যাপার ঘটলো। সেটা হলো, সবাই এই কমনসেন্স আইডিয়াটাকে লুফে নিলো। চার নভেম্বর উইল রজার্সের জন্মদিন। মানুষজন আর কিছু পেয়ে বা না পেয়ে ওইদিনটাকে একটা দিবস বানায় ফেললো। দিবসটার নাম হচ্ছে, 'কমনসেন্স ব্যবহার কর দিবস'। এই দিবস পালনের উদ্দেশ্য কী? এক. আমরা আর অন্যদিন কমনসেন্স ব্যবহার করি বা না করি এইদিন আমাদের কমনসেন্স ব্যবহার করতেই হবে নোট করার মতো! দুই. আসলে সেন্স টেন্স কিছু না। রজার্স আঙ্কেল যে কথাটা বলেছিলেন সেইটাকে স্মরণীয় রাখতে এই ব্যবস্থা।

আমি বা তুমি সেই দিবসটা পালন করব (হোক আনপপুলার ডে)? কমনসেন্স খাটাও!

কথা কিন্তু কমনসেন্স নিয়ে হচ্ছে না। কথা হচ্ছে দিবস নিয়ে। কোন দিবস আমরা কেন পালন করি? সেটার হিস্টোরিকাল ভ্যালুর জন্যে নিশ্চয়ই? একুশে ফেব্রুয়ারি যেমন, ভাষা আন্দোলন ঘটেছিলো। ষোল ডিসেম্বর যেমন, সেই দিনটাতেই পূর্ব পাকিস্তান প্রকৃতই বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিলো। ঈদ ই মিলাদুন্নাবী যেমন, রাসূল (সা) জন্মগ্রহণের দিন বলে। পাই দিবস পালন করি, প্লুটো আবিষ্কারের দিবস, আমেরিকা ডে ইত্যাদি ইত্যাদি... বলে শেষ করার নয়। আবার নিজেদের জন্মদিন, বিয়ের এ্যানিভার্সারি গুলোও আমরা পালন করি। ছোট্ট একটা আংটি দিয়ে, ক্যান্ডল লাইট ডিনারে প্রিয়তমাকে বলে উঠি, "হ্যাপি এ্যানিভার্সারি ডে!" নিজেদের এই দিবসগুলো পৃথিবীবাসী ঠিক করে দেয় নাই। কেউ বলে নাই যে, তোমাকে বিয়ে করে এরপরের বছর এ্যানিভার্সারি ডে পালন করতে হবে, তোমার জন্ম যে দিন হয়েছে সেদিন তোমাকে কেক কাটতে হবে। এগুলো আমরা নিজেরাই মনের আনন্দে করি। তবে একটা জিনিস থাকার জন্যে। সেটা হচ্ছে হিস্টোরিকাল ভ্যালু।

কমনসেন্স ডে'র কথাই ধরা যাক। আমার এটার ইতিহাস এতটাই অপ্রাসঙ্গিক আর খাপছাড়া লাগলো স্বভাবতই আমি এটাকে রসিকতা ছাড়া আর কিছুভাবে গ্রহণ করব না। তার উপর প্রথম ও শেষ কথা আমার কমনসেন্সকে সারা বছরেই থাকতে হবে। বিশেষ কোন দিনের জন্যে নয়।

২.

যাজক ভ্যালেন্টাইন দু:সাহসিক একটা কাজ করেছিলেন। রোমান রাজা দ্বিতীয় ক্লদিয়াস তাঁর সমস্ত সামরিক সৈন্যের জন্যে বিয়ে করা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। ভ্যালেন্টাইন চুপিসারে তবুও বেশ কিছু সৈন্যের বিয়ের ব্যবস্থা করতেন। ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ার পর রোমান রাজা ভ্যালেন্টাইনকে কারাবন্দী করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন।

এটা একটা লিজেন্ড। কিন্তু আরো অনেক লিজেন্ড আছে। একটা হলো, ভ্যালেন্টাইন নামে একজন ক্রিশ্চিয়ান কারাবন্দীদের নিষ্ঠুর নির্মম রোমান কারারক্ষীদের হাত থেকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছিলো। সেজন্যে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের শাস্তি মকবুল করা হয়েছিলো। আবার আরেকটা লিজেন্ড বলে, ভ্যালেন্টাইন নামে এক কারাবন্দী কারাগারে বসে তার প্রিয়তমাকে আবেগপূর্ণ এক নিংড়ানো ভালোবাসায় সিক্ত প্রেমপত্র পাঠিয়েছিলো যার শেষে লেখা ছিলো, From your valentine. এখান থেকে আজকে এক পাখি আরেক পাখিকে From your valentine লিখে সম্বোধন করে।

লিজেন্ডগুলো সত্য বা মিথ্যা কিনা তা বোঝার উপায় নাই কিন্তু। তবে এটা নিশ্চিত যে রোমান সাম্রাজ্যে ভ্যালেন্টাইন নামে সত্যি একজন অথবা তিনজন ছিলো। এবং তাঁকে কারাগারে আটক করে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিলো।

এটা গেলো এক অংশ। খুবই ধোঁয়াশাপূর্ণ, সত্য মিথ্যার দোলাচলে দোদুল্যমান।

ধারণা করা হয়ে থাকে খ্রিষ্টপূর্ব ২৭০ সালের কাছাকাছি সময়ে ভ্যালেন্টাইন মারা গিয়েছিলেন। এই মৃত্যুদিবসটাকে আরো সংক্ষিপ্ত করে ফেব্রুয়ারিতে নিয়ে আসা হয়। তবে ফেব্রুয়ারিই হওয়ার পেছনে আরো একটা কারণ বিদ্যমান।

সেটা হচ্ছে লুপারক্যালিয়া নামে একটা ফার্টিলিটি (উর্বরতা, যৌন মিলন ক্ষমতা বা যেটাই বলো) উৎসবকে ক্রিশ্চিয়ানাইজ করার একটা ধর্মীয় রাজনীতি। এই লুপারক্যালিয়া উৎসবটা করা হোক রোমানদের কৃষিকাজের দেবতা ফাওনুসকে এবং রোম সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা রোমুলাস, রেমাসকে উৎসর্গ করে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে পালন করা উৎসবে লুপারকি অর্ডারের যাজকরা একটা গুহায় মিলিত হতো যে গুহাটাতে রোমুলাস ও রেমাস শিশুকালে শি-ওলফ লুপা দ্বারা লালিতপালিত হতো (তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী)। ছাগল (উর্বরতার জন্যে) আর কুকুর (বিশুদ্ধতার জন্যে) জবাই করে সেই জবাইকৃত পশুর রক্ত তারা রাস্তায় নিয়ে আসতো। রোমান মহিলারা সেই স্যাক্রিফাইসড রক্ত দিয়ে নিজেদের যেমন সিক্ত করতো তেমনি ক্ষেতের শস্যগুলোকেও। এর মাধ্যমে ধারণা করা হতো এই রক্ত তাদেরকে আরো সক্ষম করে তুলবে পরের বছরগুলোতে। উৎসবের পরের দিন তারা নগরের সকল যুবতীদের নাম লটারি করে কুমারদের সাথে জোড়া বানাতো। সেই কুমার তখন তার পাওয়া যুবতীর সাথে সেই বছরে সম্পর্কে ধাবিত হতো। যৌনাচারের মাধ্যমে শেষ হতো আনুষ্ঠানিকতা। পরবর্তিতে জোড়াদের বিয়ে হতো আবার নাও হতো।

কিন্তু এই লুপারক্যালিয়া দিবসটা অক্রিশ্চিয়ান হওয়ার কারণে নিষিদ্ধ করে দেয় ক্যাথলিক চার্চ। আবার পঞ্চম শতাব্দীতেই পোপ গেলাসিয়াস ১৪ ফেব্রুয়ারিকে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে অভিষিক্ত করেন। খুব দ্রুতই এই দিনের সাথে ভালবাসাকে সংযুক্ত করে ফেলা হয়।

মিডল এজে এটা আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
সেসময় ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সে একটা কথা প্রচলিত ছিলো- ১৪ ফেব্রুয়ারি পাখিরা পরস্পরের সাথে মিলিত হয়। তখন এই দিনটার সাথে রোমান্সের সম্পর্কটা আরো পাকাপোক্ত হয়। বাকিটা ইতিহাস। সেটা গড়ে দিয়েছেন সাহিত্যিকরাই। তাদের কল্পনা আর আবেগ দ্বারা। এই থেকে ভালোবাসা দিবসের জন্ম। বাংলাদেশে এটা প্রচলিত করেছিলেন লাল গোলাপ নামের এক অনুষ্ঠানের সঞ্চালক, বিখ্যাত ব্যক্তি শফিক রেহমান।

৩.

ভালবাসার মাপকাঠি কি ইতিহাস? কোন দিবস কি একে পূর্ণতা দিতে পারে? ভালবাসা দিবসের জের ধরেই একদিকে হয়তোবা ক্ষণস্থায়ী সম্পর্কের মাহাত্ম্যকথা আরেকবার প্রেয়সীর কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। কিন্তু এর সাথে সাথেই গড়ে উঠতে থাকে নানা সমস্যা।

ছেলে ১৪ তারিখ বাইরে গেলেই মায়ের চোখে সন্দেহ! কেউ নেই তো আবার! মেয়ের ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দেখে জেরা শুরু। হচ্ছেটা কোথায় যাওয়া? এই দ্বন্দের মধ্যে কপোত কপোতীরা ভালবাসা চালায়।

কিন্তু আমি এই দিবস বিশ্বাস করি না।

রক্তমাখা ছাগলের খুলি দিয়ে সিক্ত করার মাধ্যমে যে ভালোবাসার পূর্ণতা প্রাপ্তি এ কথাটাতেও আমি বিশ্বাস করি না।

গোলাপ ফুল দিয়ে রোমান্সের সূচনা; এ কথাটাতেও আমার চরম ঘৃণা। কত গোলাপ ফুল পা দিয়ে মাড়িয়ে দিচ্ছে কত সম্পর্ক।

পাশাপাশি বসে স্বপ্ন দেখার জন্যে কোন বিশেষ দিন লাগে না। ভালোবাসলেই হয়। আনুষ্ঠানিকতার জন্যে অযৌক্তিক ট্রেডিশনকে লালন করার কোন মানে হয় না। ভালোবাসাকেও প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রাখতে হবে। বিশেষ দিনে ভালোবাসা কলসি বেয়ে উছলে উছলে পড়বে এ কথা কবে কে বলেছে?

তাই, আমি ভালোবাসা দিবস বিরোধী, একজন নন-কনফর্মিটিস্ট!
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:৩৭
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×