somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শিক্ষকের মৃত্যু, আমাদের কাঁধে শিক্ষকের লাশ

১৭ ই মে, ২০১২ সকাল ৮:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এ লেখাটি লেখার সময় আমি ছোট হয়ে যাচ্ছি, স্কুলপড়ুয়া বালক হয়ে যাচ্ছি। বুকে বই চেপে স্কুলে যাচ্ছি। ওই তো, দূর থেকে স্কুলের টিনের চাল দেখা যায়। সাইকেলে চেপে আমাদের পাশ দিয়েই, ওই তো চলে গেলেন প্রধান শিক্ষক। আমার প্রথম হিরো আমাদের সেই মিশন স্কুলের বড় দিদিমণি। দাদাবাড়িতে গ্রামের স্কুলে ক্লাস করেছিলাম ছয় কি সাত মাস। আমার এক চাচাতো ভাই পরে সেই স্কুলের মাস্টার হয়েছিল। আমি আজ সেই স্কুলের বুকে-বই ছাত্র হয়ে গেছি। সেই বালক দেখছে, ঢাকার রাজপথে লাঠিপেটা করা হচ্ছে শিক্ষকদের, কিশোরবেলার নায়কদের। জলকামানের গরম পানি দিয়ে ঝলসে দেওয়া হচ্ছে তাঁদের শরীর। সমাবেশে অংশগ্রহণকারী একজন শিক্ষক বাড়ি ফিরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। শিক্ষকেরা পিতৃতুল্য, আজ আমাদের একজন পিতা মারা গেছেন।
আমার প্রথম শিক্ষক অবসরে গরু চরাতেন। আরেক শিক্ষক প্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি ধরেছেন, চাষবাসও করেন শুনেছি। সাহস হয় না তাঁদের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। সাহস হয় না জানতে, যে শিক্ষক মারা গেলেন তিনি কে? তিনি কি আমার স্কুলগামী বয়সের হিরো? তিনিই কি আমাকে পড়িয়েছেন ছোটবেলায়? কেমন তার মুখ? সেই শিক্ষক, সেই সাহেবের কুকুরের এক ঠ্যাংয়ের সমান মূল্যের মানুষটি আমার কে? আমাদের কে? দেশের কে?
সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পণ্ডিতমশাই’ গল্পটি আমরা অনেকেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকতে পড়েছিলাম। যিনি পড়াতেন, তিনিও গল্পের পণ্ডিতমশাইয়ের মতোই দরিদ্র একজন শিক্ষক। পড়াতে পড়াতে তাঁর মুখে যে ভাঁজ পড়ত, চোখের তারায় যে ঝিলিক আসত, তা কি বেদনার না ক্রোধের, তা বোঝার বয়স তখন ছিল না। সেই গল্পের এক জায়গায় লেখক বলেন, ‘স্কুল ইন্সপেক্টরের তিন ঠেঙে কুকুরের পেছনে ব্যয় মাসে ৭৫ টাকা। আর বিদ্যালয়ের পণ্ডিতমশাইয়ের মাসিক বেতন ৭৫ টাকা। তাহলে পণ্ডিতমশাইয়ের বেতন ইন্সপেক্টরের কুকুরের কয় ঠ্যাংয়ের সমান?’ ব্রিটিশ আমলের সাহেব স্কুল ইন্সপেক্টরের তিন ঠেঙে কুকুরও এসেছিল সেই পরিদর্শনে। পণ্ডিত মশাই তাঁর ছাত্রদের ঐকিক নিয়মে অঙ্ক কষে শিক্ষকের মর্যাদার আর্থিক চেহারাটি বের করতে বলেছিলেন। ছাত্ররা কী বুঝেছিল?
‘মূর্খের মতো একবার পণ্ডিতমশাইয়ের মুখের দিকে মিটমিটিয়ে তাকিয়েছিলুম। দেখি, সে মুখ লজ্জা, তিক্ততা, ঘৃণায় বিকৃত হয়ে গিয়েছে। ক্লাসের সব ছেলে বুঝতে পেরেছে, কেউ বাদ যায়নি, পণ্ডিতমশাই আত্ম-অবমাননার কী নির্মম পরিহাস সর্বাঙ্গে মাখছেন, আমাদের সাক্ষী রেখে।’
আমাদের সবাইকে সাক্ষী রেখে এ শহরে শিক্ষকেরা পুলিশের নির্মম লাঠিপেটার শিকার হলেন, জলকামান দিয়ে তাঁদের তাড়িয়ে ছত্রভঙ্গ করা হলো। সেখান থেকে তাঁরা গিয়েছেন শহীদ মিনারে। টেলিভিশনে দেখলাম, প্রচণ্ড গরমে অথবা অর্ধাহারে দুর্বল শরীর নিয়ে তাঁদের কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। সরকার দেখছে, দেখেই যাচ্ছে।
প্রতিটি নির্বাচন আসে আর প্রধান দুই দল প্রতিশ্রুতি দেয় ক্ষমতায় গেলে বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ করা হবে, বেতন বাড়ানো হবে ইত্যাদি। পরপর চারটি সরকার ওয়াদা করেও তার বরখেলাপ করেছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও যথারীতি ওয়াদা এবং তার বরখেলাপের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। এই সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দাবিদার। মৃত্যুবরণকারী শিক্ষক আজিজুর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এই দেশে দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রীয় সম্মান না পেলেও পদে পদে লাঞ্ছিত হন।
এ দেশে কালোটাকাওয়ালাদের জেলে না ভরে সেই টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির হোতারাও বিপুল সমাদর পান। দুর্নীতি আর দুর্বৃত্তগিরি যেখানে ছাড় পায়, সেখানে শিক্ষকেরা রাজপথে পুলিশের দ্বারা পদদলিত হবেন, এতে তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই। দিন তো কিছুই বদলায়নি।
প্রতিবছর বাজেটের আগে তাঁরা ঢাকায় আসেন। কোথায় কার বাসায় ওঠেন, কীভাবে ঢাকায় থেকে আন্দোলন করেন, জানি না। বদরুদ্দীন উমর লিখেছিলেন গত বছর, ‘১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় থেকেই প্রাথমিক শিক্ষকেরা নিজেদের বেতন-ভাতার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। তাঁরা সে সময় যে সামান্য বেতন পেতেন সেটাও তাঁরা নিয়মিত পেতেন না। কাজেই বেতন বৃদ্ধির দাবি তো ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁদের মূল দাবি ছিল নিয়মিত বেতন প্রাপ্তি। সেই সময়কার প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবিদাওয়া এবং আন্দোলনের ধরনের দিকে তাকালে মনে হয় বাংলাদেশে গরিব মানুষের ভাগ্যের কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনই বিগত ৬৫ বছরের ওপর সময়ে হয়নি। ...সরকার, এমনকি রাষ্ট্র পরিবর্তন পর্যন্ত হলেও কোনো জামানাতেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আজ পর্যন্ত হয়নি। সে পরিবর্তন যদি হতো তাহলে এ দেশের স্বাধীনতার পর বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষকেরা নিজেদের চাকরি সরকারিকরণের দাবিতে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তাঁদের দুরবস্থার প্রতিবাদে গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মাহুতির কথা বলতেন না।’
এটা গত বছরের কথা। এ বছরও আবার তাঁরা রাজধানীতে এসেছেন। পুলিশের মার খেয়ে শহীদ মিনারে গিয়ে উঠেছেন। গত বছরও সরকার তাঁদের দমের পরীক্ষায় পরাজিত করে ফেরত পাঠিয়েছিল। পরিস্থিতি একবিন্দুও এগোয়নি। এবারও কি তা-ই হবে? দিনের পর দিন ঢাকা শহরে ধরনা দিয়ে আন্দোলন করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাঁরা ধর্মঘটের কথাও ঘোষণা করেছেন। গত বছর তাঁরা গায়ে আগুন দিয়ে আত্মাহুতির কথা বলেছিলেন। এবার আমরণ অনশন করতে যাচ্ছেন। বাজেটে শিক্ষা খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় বরাদ্দের কথা বলে প্রত্যেক সরকারই অনেক বাগাড়ম্বর করে থাকে। কিন্তু সম্ভবত শিক্ষা ও শিক্ষকদের বিশেষত গ্রামাঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের ও শিক্ষকদের অবস্থা থেকে প্রমাণিত হয় যে এসব কথাবার্তাই চতুর ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়।
সরকারি দুর্নীতি-অপচয় আর অনুৎপাদনশীল খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচের বহর দেখে তো মনে হয় না, টাকার অভাব আছে! কেবল প্রাথমিক শিক্ষকদের বেলায় এ নিষ্ঠুরতা কেন? মাত্র চার হাজার টাকারও কম বেতনে কীভাবে একটি পরিবার বাঁচতে পারে? যাঁর ওপর জাতির সন্তানদের শিক্ষিত করার ভার, তাঁকে অনাহারে রেখে কীভাবে সুখী থাকতে পারে মহামান্য সরকার? একজন প্রাথমিক শিক্ষকের আক্ষেপ: ‘দারুণ কষ্টের নির্বাক কারিগর এই বঞ্চিত শিক্ষক সমাজের দুঃখ ও দাবির কথা’ শোনার কি কেউ নেই?
এবার পাসের রেকর্ড নিয়ে কী উল্লাস চারদিকে। সাক্ষরতার হার নিয়ে দেশ-বিদেশে কম বড়াই করে না সরকারগুলো। যে শিক্ষক ভাত পান না বলে গরু চরান বা দিনমজুরি করেন বা ইটভাটায় কাজ করেন, তাঁর সামনে এ গর্বের মিষ্টি নিয়ে দাঁড়াতে লজ্জা হবে না আমাদের? নিহত শিক্ষকের লাশের ভার আমাদের কাঁধে। এ ভার নামানো ছাড়া সরকারের দায়মুক্তি নেই। আজ সত্যিই আমরা খুব ছোটো হয়েগেলাম।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×