হলে এসে প্রথম প্রথম খুব একা লাগতো । মায়ের মোবাইলের ভয়েস রেকর্ড করে রাখতাম । সারারাত ধরে ওটাই শুনতাম । দশ দিন পর পর বাসায় চলে যেতাম । যখন খুব মন খারাপ হতো , বন্ধু শুভ্রর সাথে ঢাকা শহরের রাস্তায় রাস্তায় হাটতে থাকতাম । এক পর্যায়ে শুভ্র বলতো , চলো খুলনা যাই । আমি মাথা নাড়তাম । নাহ , কদিন আগেই না আসলাম ! ও টিকিট কেটে আসতো । আমি কোন রকমেই না যাবার পক্ষে । আর বাস ছাড়ার ঠিক আগে আগে আমার ব্যাগও গোছানো হয়ে যেতো ।
কিছুদিন যেতেই এই সমস্যাটা কেটে গেলো । আমাদের আরেক বন্ধু রনির ঢাকায় আগমন ঘটলো । ওর মোবাইলটা আমাদের জন্য মহা আশির্বাদে পরিনত হলো । সারারাত মোবাইল দিয়ে কি কি করা যায় সেগুলির পাঠ নিতাম আমরা । দিনরাত ওটা নিয়েই থাকতাম । মলি জলি পলি......
আমাদের দেশের পাবলিক ভার্সিটির হলগুলিতে সাধারনত স্থানীয় ছেলেরা কমই থাকে । বেশিরভাগকেই আসতে হয় দুর শহর থেকে । বাবাকে ছেড়ে , মাকে ছেড়ে , বন্ধুদের ছেড়ে একরকম শিকড় ছিড়ে চলে আসতে হয় । এরপর একে অপরের উপর ঠেস দিয়ে খুব কষ্টের কিছু দিন , কিছু মাস কাটে । প্রথম প্রথম হলের বেডে শুয়ে সারা রাত কান্না আসে । পনেরো দিন পরেই অটো নিয়ে বাড়ি চলে যেতে হয় । বাড়ি যাওয়ার সময় কি আনন্দ ! ফেরার সময় সারাটা রাস্তা মায়ের মুখ মনে পড়তে থাকে । রাস্তার প্রতিটা পায়ের ধাপকে বিষন্ন লাগে ।.....এ রকম একটা সময় , ভার্সিটি জীবনে পা রাখা সকল হলের ছেলেদের জন্যই কম বেশি একই ।
এর মধ্যে মধ্যে আবার থাকে আরেক বিপত্তি । ছেলেটার অভিযোজন শুরু হবার আগেই শুরু হয় টিকে থাকার নতুন লড়াই । শুরু হয় বিভিন্ন অস্বাভাবিক হলভিত্তিক কর্মকান্ড ( গেস্ট রুম সিস্টেম একটি ) । অনেকেই বিব্রত হয়ে প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত ত্যাগ করে । অনেকের উপায় না থাকায় চুপচাপ কয়েক রাত চোখের জল ঝরায় , সহ্য করে যায় ।
অনেক সুশীল আবার আগ বাড়িয়ে উল্লেখ করে থাকেন , যাতে কেউ বেয়াদবি না করে তার জন্য আগাম কিছু ব্যাবস্থা এভাবে নেয়া হয় । আগাম টাইট দেয়া হয় । কিন্তু নিজের উপলব্ধি থেকে মনে হয় , যে ছেলে অনেক দুর থেকে নতুন শহরে পা রাখে , হল থেকে ক্লাসের রাস্তাটা ভালভাবে চেনে না , হলের সবগুলো ডাইনিং ভালোভাবে চেনে না , তার জন্য বেয়াদবি করাটা তো তখন অনেকটা ঐতিহাসিক ব্যাপারের মত !
আমার ঢাকায় আসার প্রায় দুই বছর পরে খুলনা থেকে আসা এক ছেলের সাথে ডিএমসির ফজলে রাব্বী হলের মেইন বিল্ডিংয়ের গেটে দাড়িয়ে পরিচয় হলো । এসেছে এখানে আমাদের দুই ব্যাচ জুনিয়র হিসেবে । খুব আগ্রহ নিয়ে কথা বলছিলো । বুঝলাম , এলাকার মানুষ পেয়ে কথার ভুত চেপেছে ।
ছেলেটার সাথে দেখা হওয়ার দুদিনের মাথায় সে আমাকে কিছু সমস্যার কথা খুলে বলে । সে মানিয়ে উঠতে পারছে না । একটু নরম প্রকৃতির হওয়ায় হলে উঠে খাবারের সমস্যা , বাসার জন্য খারাপ লাগা , পড়াশুনার প্রেশার সব মিলিয়ে এলেবেলে অবস্থা । এর সাথে সরকারি ভার্সিটির হলে ফার্স্ট ইয়ারের কম বেশি যেসব সমস্যা থাকে , সেসবে তার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা । সে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে । এখান থেকে সে মাইগ্রেশন করতে চায় ।
শুনে আমার খারাপ লেগেছিলো । টানা একমাসের চেষ্টায় এক পর্যায়ে ছেলেটাকে আমি ঢাকায় থেকে যাওয়ার ব্যাপারে রাজি করাতে পারলেও দুঃখজনক এক পরিস্থিতির কারনে সে ঢাকা মেডিকেল থেকে শেষ পর্যন্ত হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যায় । পরে ওদের ক্লাসমেটদের কাছ থেকে এক সময় জানতে পারি ছেলেটা খুলনা মেডিকেলে মাইগ্রেশন নিয়ে চলে গেছে । এর পেছনে কিছু বড় ভাইয়ের অবদান ছিলো ।
শিক্ষার জন্য ভুতগ্রাম থেকে উঠে আসা একটা ছেলে এই উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে এসে rag এর মাধ্যমে আসলেই কি কিছু শেখে ? যুক্তি দেয়া হয় , সিনিয়রদের কাছে ভদ্রতার বিধান শেখে । সম্পর্ক ভাল হয় । বিতর্কের জায়গাটা এখানেই । ভদ্রতা শেখানোর এ কি পদ্ধতি ! কান ধরে উঠাবসা , বিভিন্ন অশ্লীল কাজ , গালাগাল যদি ভদ্রতা শেখানোর মাধ্যম হয় , তবে আমার ধারনা আমাদের কেউই বাবা মা এবং পরিবারের কাছ থেকে কোন ভদ্রতাই শিখতে পারি নি । আমার বাবা মা তো আমাকে এভাবে ভদ্রতা শেখান নি !
ছোট ভাই বানাতে গিয়ে পরের ছেলেকে যেসব কথা বলা হয় , নিজের ভাইকে কি সেটা বলা সম্ভব ? নিজের ভাই জুনিয়র হয়ে আপনার হলে আসলে যেভাবে শেখাতেন , সেভাবে শেখানো কি অসম্ভব !
আমেরিকান এক বিখ্যাত সিরিয়াল কিলারকে তার সাক্ষাতকার নেয়ার সময় একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো , কেন এগুলি করলেন ? তিনি বলেছিলেন , পৃথিবী আমার উপর অন্যায় করেছে ।
আমি অবাক হয়ে চিন্তা করেছিলাম , প্রত্যেকটা মানুষই কি নিজের কাজের জাস্টিফিকেশন খুজে নেয় ! একজন সিরিয়াল কিলারেরও তাহলে বলার কিছু থাকে !
আসলেই তাই । নিজের পক্ষে দাড়ানোর জন্য যুক্তি খুনিরও থাকে , মুনিরও থাকে ।