somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পরীক্ষার রেজাল্টই সব নয়

০৯ ই আগস্ট, ২০১৫ সকাল ১১:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিচ্ছে ।

দুমাস আগেই পরীক্ষা হলো । পরীক্ষার হলের সামনে টেলিভিশন ক্যামেরা গেলো । খুব আগ্রহ নিয়ে দেখলাম । তারুন্যের উচ্ছ্বাস ! সবার উত্তেজনা , অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা ।

কিন্তু যখন রেজাল্ট হবে , তখন সবার মুখে হাসি থাকবে না । তারা সবাই হয়তো আজকের নায়ক হবে না । অনেকেই দুঃখ পাবে । আমার এক বান্ধবী পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যাই করে ফেলেছিলো । খুব কষ্ট পেয়েছিলাম । নিজেকে বুঝিয়েছিলাম , দুঃখ পাওয়ার কি আসলেও কিছু আছে ?

জীবনে এরপর অনেকবার ব্যর্থ হয়েছি । কিন্তু কিছুই মনে হয়না । শুধু ওই বান্ধবীর মুখটা মনে পড়ে । মায়া হয় খুব । আর আসলেও কিন্তু জীবন কোন পরীক্ষার রেজাল্টের উপর নির্ভর করে না । জীবন চলে কর্মের উপর । জীবনের প্রতিটা বাঁকেই মানুষের জন্য অপেক্ষা করে আছে বিস্ময় । আমাদের শুধু একটা বিস্মিত হবার ক্ষমতা থাকলেই চলে ।

নয়া দিগন্তে শফিক রেহমানের "দেশে দেশে ফাসি" বিষয়ে একটা অতি ফরমায়েশি লেখা পড়েছিলাম । যুদ্ধাপরাধ এবং শাহবাগ আন্দোলনের পর এ বিষয় নিয়ে তার এই উলঙ্গ লেখাগুলি আমার কাছে কখনোই সময়োপযোগি বলে মনে হয়নি । এরই মধ্যে কলামের একটি পর্বে একজন রবার্ট স্ট্রাউডকে নিয়ে লেখা হয়েছে । কলামটির শ্রেষ্ট লেখাটিই বোধহয় রেহমান লিখে ফেলেছিলেন ! কি আকর্ষনীয় সেই জীবন !

রবার্ট স্ট্রাউড মাত্র তের বছর বয়সে বাবামায়ের দাম্পত্য কলহ এবং দুর্বিষহ মানসিক তাড়নায় বাড়ি থেকে পালিয়ে যান । এরপর টানা পাঁচবছর জীবনের সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েন তিনি । শেষমেষ সহজে অর্থউপার্জনের চিন্তায় কিটি এবং ব্রায়েন নামে দুই যৌনকর্মীর দালালের কাজ শুরু করেন । এই কাজেরই এক পর্যায়ে কিটি নামের সেই বার ড্যান্সারের কোন একজন প্রভাবশালি খদ্দেরের সাথে কথা কাটাকাটির মধ্যে স্ট্রাউড তাকে গুলি করে বসেন । বারোবছরের কারাদন্ড হয় তার ।

প্রায় আটবছর জেল খাটার পরে জেলের ভেতরে আরো একটি হত্যাকান্ড ঘটিয়ে বসেন স্ট্রাউড । স্ট্রাউডের ছোটভাই তার সাথে দেখা করতে এসে এক স্টাফের কারনে বিফল হন । একথা শোনার পর রাগান্বিত হয়ে স্ট্রাউড তাকে ছুরিকাঘাত করেন । স্টাফটি মারা যায় এবং বিচারে স্ট্রাউডের ফাসির আদেশ হয় । সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হয় । কিন্তু মৃত্যুদন্ড বহাল থাকে । ১৯১৫ সালের ২৩ এপ্রিল তার ফাসি কার্যকরের ব্যবস্থা করা হয় ।

এরপর ঘটে এক অভুতপূর্ব ঘটনা । স্ট্রাউডের সেই ভুলে যাওয়া মা দৃশ্যপটে হাজির হন । তার নিরবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় প্রেসিডেন্ট উড্রো ইইলসন তাকে ফাসি মওকুফ করে আজীবন কারাদন্ড দেবার সুপারিশ করেন । স্ট্রাউডকে জনবিচ্ছিন্ন একটি সেলে রাখার সিদ্ধান্ত হয় ।

মানুষ থেকে আলাদা হয়ে যাবার নির্দেশে বিচলিত হয়ে পড়েন রবার্ট স্ট্রাউড । কিন্তু তাড়াতাড়িই গুছিয়ে নেন । ১৯২০ সালটি তার জীবনের একটি বিশেষ বছর । এই বছরে তিনি জেল প্রাঙ্গনে কুড়িয়ে পাওয়া তিনটি আহত চড়ুইকে সুস্থ করে তোলেন । এবং পর্যায়ক্রমে জেলকর্তৃপক্ষের কাছে আরো কিছু পাখি কেনার অনুমতি চান । অনুমতি পাবার পর শুরু হয় রবার্টের অন্য রকম জীবন । রবার্ট বিশাল বিশাল পাখির খাচা তৈরি করেন । খাচাগুলো এতোই বিশাল ছিলো যে , এর ভেতরে অনায়াসে শত শত পাখি রাখা যেতো । জমা হতে থাকে পাখি । কিচিরমিচিরে ছেয়ে যায় সমস্ত কারাগার । কিছুদিন পরে পত্রপত্রিকায় এসব ঘটনা প্রকাশ পেয়ে গেলে জেলে দর্শনার্থিরা এগুলি দেখতে আসতেন । রবার্টের কাছ থেকে চোরাইপথে পাখি কিনতেন ।

এরই মধ্যে আরেকটি ভয়াবহ কাজ করে বসেন রবার্ট । তার প্রায় ছয়শ পৃষ্ঠার বই ডিজিজেস অফ ক্যানারিজ ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত হবার পর আমেরিকা কাপিয়ে দেয় । ব্যাপক ব্যাবসায়িক সাফল্য অর্জন করে ।

রবার্টের কাজ আমেরিকার জেলকর্তৃপক্ষের ভেতরেও বিশাল আলোড়ন তৈরি করে । জেলের ওয়ার্ডেন বেনেট তার কাজে মুগ্ধ হয়ে শুরু করেন প্রগতি এবং পুনর্বাসন নামে এক জেলভিত্তিক কার্যক্রম ।

তবে রবার্টের কাজ জেল কর্তৃপক্ষকে একটি বিপদেও ফেলে দিয়েছিলো । তার নামে আসা হাজার হাজার চিঠি চেক করা , এবং বোঝার জন্য বিভিন্ন ভাষার অনুবাদক প্রয়োজন হয়ে পড়ে । রবার্টের পাখি ব্যাবসা এত প্রসার হয়েছিলো যে , তার জন্য সেক্রেটারি নিয়োগ দেয়া হয় ।

কিন্তু কিছুদিন পরেই ঘটে বিপদ । বেনেট বদলি হয়ে যান । নতুন ওয়ার্ডেন বন্দীর এরকম খ্যাতিতে বিরক্ত হন । জেল কর্তৃপক্ষ রবার্টকে নোটিশ দেয় পাখি সরিয়ে ফেলতে । কিন্তু এ সিদ্ধান্ত কিভাবে যেনো ডেলা নামে এক নারী পাখি গবেষকের মাধ্যমে পত্রিকায় প্রকাশ পেয়ে যায় । আমেরিকা জুড়ে ঝড় ওঠে । প্রায় লক্ষাধিক সাক্ষর নিয়ে চিঠি যায় তৎকালিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হুভারের কাছে । গনচাপে প্রেসিডেন্ট তাকে পুনরায় অনুমতি দিতে বাধ্য হন । তার পাখি পোষার জন্য একটি অতিরিক্ত সেলও বরাদ্দ করা হয় । ১৯৩২ সালে ডেলা নামের সেই নারী স্ট্রাউসকে জেলের ভেতরেই বিয়ে করেন ।

কিন্তু এবার আরেকটা ভুল করে ফেলেন স্ট্রাউড নিজেই । পাখির ওষুধ বানানোর ল্যাবে অনৈতিকভাবে মদ তৈরি করার সময় ধরা পড়ে যান । শাস্তিস্বরূপ তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় আলকাতরাজ দ্বীপে । মাত্র দশমিনিটের নোটিশে স্ট্রাউডকে ছেড়ে যেতে হয় তার প্রিয় সমস্ত পাখিকে ।

এরপরের এগারো বছরের জীবন তিনি একাই কাটিয়ে দেন । লেখেন একের পর এক বই । কিন্তু এগুলো প্রকাশের অনুমতি না পাওয়ায় তার মৃত্যুর পূর্বে আর মানুষের কাছে পৌছায়নি ।

১৯৬৩ সালে যখন তিনি ৫৪ বছরের কারাজীবনের সমাপ্তি ঘটান প্রিজনার্স হসপিটালের বিছানায় , তখন তার নামে সারা আমেরিকায় 'কমিটি টু রিলিজ স্ট্রাউড' নামে লক্ষাধিক সদস্যের একটি সংগঠন তৈরি হয়ে গিয়েছিলো ।

রবার্ট বেচে থাকতেই তার জীবনি বের হয় । সেই জীবনির উপর বানানো মুভি অস্কার জিতে । কিন্তু কারাকর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞায় সেটি স্ট্রাউড দেখে যেতে পারেন নি ।
হসপিটালের বেডে বসে নার্সকে বলা রবার্টের জীবনের শেষ বাক্য ছিলো , আলো নিভে গেলে সবাইকে পাখি হয়ে যেতে হয় ।

স্ট্রাউডের ৭৩ বছরের জীবন এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার পর আমার মনে হলো , বাহ ! কি মোহময় জীবন ! মনে হলো , জেলে গেলেও তো মন্দ হয় না । কিন্তু আসলেও কি তাই ?

আসলেও তাই । জীবনকে উপভোগ করতে শিখে গেলে জীবনের সমস্ত বাঁকে দাড়িয়েই স্ট্রাউড হওয়া যায় । কেবল বুঝতে হয় নিজের আত্মাকে । আর বুঝতে হয় , শেষ মিনিট পর্যন্ত তুমি আসলেই জানো না , কি ঘটতে যাচ্ছে । তুমি সফল হও অথবা না হও দিনশেষে তোমাকে ঘুমাতে যেতে হবে , জীবন শেষে তোমাকে মৃত্যুর কাছে যেতে হবে ।

বুঝতে হবে সবার জীবনই আসলে একরকম , শুধু স্ট্রাউডদের জীবন অন্যরকম ।

পরীক্ষার্থীরা , best of luck
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×