- ভাই এতো ভয় পান কেনো ?
একটু থতমত খেয়ে দেখলাম কথাটা কে বললো । নিশ্চিন্ত হলাম । ভয় পাওয়ার মত কিছু হয় নাই ।
- তারপর কি খবর ? চা খাও । আমি একটু অস্ফুট হেসে বললাম ।
কিন্তু এ ছেলে নাছোড় বান্দা , উত্তরটা দিবেন না ?
ভালো করে আগামাথা একবার চোখ বুলালাম । ছেলের জ্যাকেটের কলারটা উল্টা হয়ে আছে । চুল মনে হয় নতুন করে ব্যাকব্রাশ করেছে । চোখটাও একটু অন্যরকম লাগছে । চোখে কি কাজল দিয়ে আসছে নাকি ! বোধহয় আসছে ।
আমি আর কি বলবো ! বললাম , বসো । আগে বুঝে নেই কী বলতে চাচ্ছো । বুঝিই তো নাই ।
- আপনি পলিটিক্যাল লেখা দেন না ক্যান ?
একটু ভিমরি খাইলাম । এইরকম প্রশ্ন আসবে চিন্তাও করতে পারি নাই । হাইসা দিলাম ।
হাসার অবশ্য যথেষ্ট কারণ আছে । আমার ফেসবুক বয়স সর্বসাকুল্যে দুইমাস [বইলা রাখি , দুইমাস আগে আমি একটা ল্যাপটপ কিনছি ।] আমার অনেক কাছের ফ্রেন্ডরাও জানে না , ফেসবুকে আমার একটা একাউন্ট আছে । তাই এই টপিক নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করাটা বেশ একটা মজারই ব্যাপার ।
ছেলেটা বসলো । ছেলেটাকে দেখলেই ভালো লাগে । বুদ্ধিসুদ্ধি আছে । ফেসবুকে দেখছি ব্যাপক হানাহানি করে বেড়ায় । দম আছে ।
- সবুজ , চার কাপ চা দে । চিল্লানি দিলাম ।
সবুজ হলে চা বানায় । ব্যাপক চা । চিনির সরবতের থেকেও ভালো । আমি সকালবিকাল এই চা খাই ।
- চারকাপ ক্যান ? আমি দুই কাপ খাবো না ভাই ।
আমি হাসলাম , তুমি খাবা এককাপ । আমি খাবো তিনকাপ ।
ছেলে অবাক হইলো , বলেন কি !
মুচকি হাসলাম । তিনকাপ চা আমিও খাবো না । কিন্তু জুনিয়রের হাত থেকে আলোচনার লাগাম নিজের হাতে নেয়ার রাস্তা তৈরী করলাম । ট্রিকস কাজ দিছে । জুনিয়র একটু মোহাচ্ছন্ন । কথা বলার সুযোগ আমি তৈরী করে ফেলেছি ।
একটু ওর দিকে পাশ ফিরে বললাম , কী মনে হয় তোমার ? পলিটিক্যাল ঘৃনা ছড়িয়ে কি লাভ ? সবাই মিলে আমরা দেশটারে শুয়োরের খোয়াড় বানানোর টেন্ডার নিছি নাকি ?
ভদ্র ছেলে । শুয়োর শব্দটা মনে হয় সহ্য করতে পারলোনা । চোখমুখ ফেকাঁসে করে ফেললো । ভদ্র ছেলেদের এই সমস্যা আছে । আবেগটা মুখে চলে আসে । এই ছেলেটাও একই জাতের [যদিও তাকেই আমি ফেসবুকে দেখছি গালাগালির ম্যারাথন চালাইতে] ।
এরই ফাঁকে সবুজ চা দিয়ে গেছে । চায়ের নিচ থেকে চিনির ব্যাপকতা দেখা যাচ্ছে । আনন্দে মনটা ভরে গেলো ।
ভদ্র জুনিয়রও সামলে নিয়েছে , ভাই ! তাই বলে সত্যের পক্ষ নেবেন না ?
আমি নিশ্চিন্তে সবুজের চায়ে চুমুক দিলাম । সরবত ফেল । মনে মনে সবুজকে প্রতিদিনের মতো আরেকবার ধন্যবাদ দিলাম ।
চায়ের কাপ সামনে রেখে জুনিয়রকে বললাম , শোনো , তোমার কাছে যেটা সত্য , সবার কাছে সেটা নাও হতে পারে । আমরা ৪৭ এ মনে করছিলাম এইটাই শেষ সত্য । শেষ হয় নাই । ৬৯ এও একইরকম ভাবছিলাম , শেষ হয় নাই । ৭১ এও মানুষ ভাবছিলো , এই শেষ । শেষ হইছে ? সময়কে এতোটা বোকা ভেবো না ।
ছেলেটা হালকা বিভ্রান্ত হয়ে গেছে । ওর মুখের উপর একটা মাছি পড়েছে । গুয়ে মাছি বোধহয় । বো বো শব্দ করছে । তবে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আমি বুঝি , বিভ্রান্তি কাটিয়ে ছেলেটা উঠে দাড়াবেই । সে তার মতের পক্ষে কথা বলবেই । এতো সহজেই যদি সবাই সব মেনে নিতো , তাহলে তো অনাদিকাল থেকে পৃথিবীটা ভেরেন্ডাভাজির মতো বিস্বাদ মনে হইতো !
এরই ফাঁকে সবুজের একটা কাপ ফাঁকা হয়ে গেছে । দ্বিতীয় কাপে চুমুক দিয়ে জুনিয়রের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে উসখুস করছে । আমি ওর দিকে ফিরতেই হেসে হেসে বললো , ভাই দ্যান্তের একটা কথা আছে । নরকের সবচে নিচের স্থানে সেই থাকবে , যে সত্য মিথ্যার লড়াইয়ে নিরপেক্ষ থাকে ।
আমি হাসলাম । এই লাইনটা আমি আগেও শুনেছি । ছেলেকে বলাও যাচ্ছে না যে , ” দ্যান্তের রেফারেন্সটা অনেক আগে থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ । “ এরই মধ্যে আরেকটি মাছি এসে ছেলেটার মুখের উপর যোগ দিয়েছে ।
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম , শোনো ইতিহাসের যে সংঘাত , সেটা ভালো আর খারাপের নয় , আদর্শের । সত্য মিথ্যারও নয় , আত্মপরিচয়ের । সময় কখনো বিভেদ থামাতে পারেনি । পারবেও না । ২০১৫ তেও না , ২৫ এও না । তাই হিংসাকে পুজি করে আমি ব্যবসায় নামতে নামবো কেন ?
বুঝতে পারছি , জুনিয়র বুঝতে চাচ্ছে না । নতুন যুক্তি খুজছে । একটা মাছি তার মুখের উপর থেকে উড়ে কানের উপর চলে গেছে । ছেলেটা টেরও পাচ্ছে না । কী অদ্ভুত মানুষের মন আর বিশ্বাস ! মনে মনে হাসলাম ।
দুই কাপ চা শেষ হয়েছে । আমি আর আগাইতে চাই না । কি হবে ! এতে বরং আমাকে ঘৃনা করার আরেকজন লোকই শুধু বাড়বে ।
আমি উঠে দাড়ালাম । ছেলেটা আরেকটা কিছু বলতে চাচ্ছিলো । আমি মাথা নাড়ালাম , আজ না , আরেকদিন । রুমে আইসো ।
কথাটা বলে ছেলের মুখে বসা মাছি দুটাকে উড়িয়ে দিয়ে আমি পা বাড়ালাম । জুনিয়র আর এককাপ চা সবুজের দোকানেই পড়ে রইলো ।
আমাকে এখন রুমে ফিরতে হবে । একটা গোসল দিতে হবে । তারপর কাপড়গুলা ইস্ত্রি করতে হবে । আর সারাজীবন ধরে নরকে যাবার যে পথটা তৈরী করেছি , সেটা আরেকটু গুছিয়ে নিতে হবে ।