সকাল থেকে সারা দুনিয়া অসহ্য মনে হচ্ছে, কম্পিউটারের সামনে বসে আছি প্রায় ঘন্টা দুয়েক, কি লিখবো, কি করে লেখা শুরু করবো ভাবতে ভাবতে সময় পার হয়েছে। সকালে মেসেঞ্জারে মাসুমের মেসেজ পেয়ে হতবিহবল হয়ে আছি। আমাদের একজন প্রিয় আপা আর এই দুনিয়াতে নেই, ঠিক এই লেখা লেখার সময়ে তার পরপারে যাবার আয়োজন চলছে, যোহরের নামাজের পরে উনার শেষ বিদায় জানানো হবে।
"আস্সালামু আলাইকুম, মামা! আমার আম্মা, অধ্যাপিকা সুরাইয়া মজুমদার, আজ রাত ০১:৪৫ মিনিটে যশোরে নিজ বাসভবনে ৮২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)! আজ বাদ-জোহর জানাজার পরে ওনাকে যশোর কবরস্হানে আব্বার কবরের পাশে কবর দেয়া হবে! তাঁর রুহের মাগফিরাতের জন্য আপনারা সবাই দোয়া করবেন! মাসুম"
চাবুক আপাকে এই প্রজন্মের অনেকেই চিনবে না, তবে আমাদের প্রজন্মের কাছে তিনি ছিলেন অতি পরিচিত মুখ। স্বাধীনতার পরে ১৯৯০ সাল (এর পরে আমি বিদেশ চলে যাওয়াতে আর খবর রাখতে পারি নাই) পর্যন্ত উনার লেখা অনেক অনেক পত্রিকাতে ছাপা হত, বিশেষ করে বিনোদন পত্রিকা গুলোর (প্রায় প্রতিটা সাপ্তাহিকে বিশেষ করে চিত্রালী, পূর্বানী, বিচিত্রা, রবিবার ইত্যাদিতে বেশী) চিঠিপত্রের কলামে তিনি ছিলেন জনপ্রিয়, যা আজকালের ফেইসবুকের মত। আমরা যারা আমাদের ছাত্রাবস্থা তরুণ কালে নিয়মিত পত্রিকা পড়তাম আমরা উনাকে দেখেছি, আজকের সময়ে যাদের অনলাইন সেলিব্রেটি বলা হয় তখন তিনি তেমন ছিলেন, যশোর থেকে তার লেখার জন্য আমরা নিয়মিত অপেক্ষা করতাম।
অত্যান্ত সন্মানীয় আমাদের এই বোনের সাথে আমার স্মৃতি অনেক। কোনটা রেখে কোনটা বলি। একটা উল্লেখ না করলে নয়, তখন ছিলো মুলত পত্রমিতালীর যুগ। একদিন আমি উনাকে একটা চিঠি লিখেই ফেললাম, আমি তখন ইন্টারের ছাত্র। যতদুরমনে পড়ে লিখেছিলাম, আপা আমি যশোর আসতে চাই, আপনার সাথে আড্ডা দিবো। ব্যস, আপা জানালেন কবে আসবে। আমি পরের চিঠিতে জানালাম, আপনার কলেজের ছুটি যখন হবে। এর পরের চিঠিতে তিনি আমার জন্য বিমানের টিকেট পাঠালেন। আমার জীবনে প্রথন বিমান ছড়া, ঢাকা-যশোর, ভাড়া ছিলো ৫২৫টাকা, আমার এখনো টিকেটের টাকার কথা পরিস্কার মনে আছে, ঢাকা বিমান বন্দরে গিয়েছিলাম বেবিট্যাক্সি চড়ে! এই স্মৃতি ভুলি কি করে। যশোরের আপার বাড়িতে ২/৩দিন ছিলাম, আপার দুই ছেলে, বড়জন আমার সমসাময়িক, ভাগিনাদের সাথে বন্ধুত্ব, দুলাভাইয়ের সাথে রাত জেগে আড্ডা, কত মজার স্মৃতি।
আপা, সম্ভবত যশোর মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন তখন, সুতারাং বাংলাভাষার দক্ষতা ছিলো অসাধারন, বাংলা বানানের জাহাজ ছিলেন তিনি। পড়ার জানার এমন আগ্রহ অসাধারন ছিলো। এর পরে আপা ঢাকা আসেন, আমাদের বাসায় আসেন, সেই সব স্মৃতি এখন বার বার মনে পড়ে।
বিদেশ থেকে ফিরে এসে আমি আপাকে হারিয়ে ফেলি, মাঝে মাঝেই মনে পড়ত, কিন্তু খুঁজে পাই নাই, কয়েক বছর আগে ফেইসবুকে ছোট ভাগিনা (সে এখন নামকরা ডাক্তার) আমাকে দেখে চিনে ফেলে, ফলে ফেইসবুকে আবার আপাকে খুঁজে পাই, তখন তিনি বৃদ্ধ এবং অসুস্থ্য, অনলাইনে আর উঠে আসেন নাই, সমসাময়িক উনার সবাই হারিয়ে গেছেন। এদিকে আমি বার বার মাসুমের ফিডে যাই, মেসেঞ্জারে কথা হয়, যাব যাব করতে থাকি (মাসুম, আমি লজ্জিত আপার কাছে ও তোমাদের কাছে), কিন্তু যাওয়া হয়ে উঠে নাই, মাসুম বার কয়েক আপার ছবি পাঠান, আমি সেই ছবি দেখি আর দুখে পড়ি, আপার সেই মাষ্টারনীর চেহারা আর নেই।
এই লেখা লেখার সময় আমি কাঁদছি, মানুষ কেন এই দুনিয়াতে আসে আর কেনই বা চলে যায়, আমারও বয়স হয়েছে, চলে যেতে পারি যে কোন দিন। একটা আফসোস থেকে গেল, আপার সাথে শেষ দেখা হল না, দেখা হলে নিশ্চয়, কান ধরে বলতেন, 'এত দিন পরে আপার কথা মনে হল উদরাজী'! এখন আর আমার কাছে সেই সুযোগ নেই, বিশাল হাহাকার মনে তৈরী হল আজীবনের জন্য।
চাবুক আপার জন্য দোয়া করি, আল্লাহ আপাকে বেহেস্তের সবচেয়ে ভাল জায়গায় রাখুন। নিশ্চয় পরপারে দেখা হবে, আবার কথা হবে। বিদায় 'প্রিয় চাবুক আপা, কলেক রোড, যশোর'!
(আপার ছবি দেয়া ভাল মনে করছি না, তবে আমার সেই প্রথম বিমানে চড়ে যশোর যাবার এবং ভাগিনাদের সাথে তোলা একটা ছবি শেয়ার দিচ্ছি)