আপনি ব্যাংকে টাকা রেখেছেন। তুলতে চান, কিভাবে তুলবেন? এই প্রশ্নের উত্তর মোটামুটি সবারই জানা-চেক দিয়ে। চেক না থাকলে টাকা তুলতে পারবেন? উত্তরটা সবাই নাও জানতে পারেন। উত্তর হলো: পারবেন। ব্যাংকে গিয়ে যোগাযোগ করুন, ব্যাংকার পথ দেখাবেন। চেক ছাড়াও টাকা খরচ করা যায়। ডেবিট কার্ড দিয়ে এটিএম কিংবা পস মেশিনে, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল পেমেন্ট ইত্যাদি নানা আধুনিক পদ্ধতির বদেীলতে আজকাল আমাদের নগদ টাকার প্রয়োজন কমেছে।
....
আপনার ব্যাংকের টাকা আপনি অন্য কাউকে দেবেন। কিভাবে? এটাও চেক দিয়ে দেয়া সম্ভব। ইলেকট্রনিক উপায়েও দেয়া সম্ভব। আপনি কিভাবে দেবেন, সেটা আপনার ইচ্ছা। তবে ছোট্ট একটা কথা আছে। ব্যাংক যতক্ষণ না মোটামুটি নিশ্চিত হবে যে, আর্থিক লেনদেনের আদেশটা আপনার দেয়া, ততক্ষণ কিন্তু সে অর্থ স্থানান্তর করবে না। ব্যাংক যেহেতু আপনার অর্থের আমানতদার এবং এই অর্থ রেখেই তার লাভ হয়, কর্মচারীদের বেতন হয়, সুনাম রক্ষিত হয়, তাই ব্যাংক কিন্তু আপনার অর্থ স্থানান্তরের আগে সম্ভাব্য সব সতর্কতা অবলম্বন করবে।
বাস্তবে, নগদ টাকার লেনদেন কমই হয়। বেশী হয় অর্থ স্থানান্তর। কারণ নগদ টাকা বহন অনেক বেশী ঝুঁকিপূর্ণ, অনেক বেশী ঝক্কি-ঝামেলার কাজ। ভুল, জালিয়াতি কিংবা অবহেলার কারণে গ্রাহকের ক্ষতি যে হয়না, তা কিন্তু নয়। কিন্তু ব্যাংক চেষ্টা করে আপনার টাকার সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, নিজের স্বার্থে।
....
এগুলো মোটামুটি সবাই জানেন। তারপরও লিখলাম গেীরচন্দ্রিকা হিসেবে। এতক্ষণের আলোচনা ছিলো দেশের ভেতরের লেনদেন নিয়ে। দেশের বাইরে টাকা পাঠাতে হলে কি করবেন? অনেকেই বলবেন, দূর! এটা আর এমন কি? হুন্ডি করবো।
ভালো কথা, হুন্ডি কিন্তু অবৈধ। দেশ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর। জিজ্ঞেস করুন, তাহলে বৈধ কোনটা? কি করবো?
আমি জানতে চাইবো, আপনি কেন টাকা পাঠাবেন? যদি বলেন পড়াশোনার জন্য, তাহলে বলবো, আপনি ব্যাংকে গিয়ে স্টুডেন্ট ফাইল খোলেন। যদি ব্যবসায়িক কারণে পাঠাতে চান, তাহলেও আপনাকে ব্যাংকে যেতে হবে। বৈদেশিক বাণিজ্যের নিয়মকানুন মেনে আপনি টাকা পাঠাতে পারেন সহজেই, ব্যাংকাররা আপনাকে সাহায্য করার জন্য বসে আছে(অবশ্যই ফি কিংবা কমিশনের বিনিময়ে, ফাউ না)
....
এখন বলেন, ব্যাংকাররা কিভাবে নিজেদের মধ্যে সেটলমেন্ট করে? কেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে। ভালো, বিদেশের লেনদেনগুলো কিভাবে নিষ্পত্তি হয়? এতক্ষণে আপনি আমার পয়েন্টে এসেছেন। আমি এই বিষয়েই কথা বলতে চাই।
....
বিদেশের সঙ্গে আমাদের লেনদেন হয় বৈদেশিক মুদ্রায়, প্রধানত ডলারে। ডলার আমাদের দেশে আসে, আবার আমাদের দেশ থেকে বিদেশে যায়। কিভাবে? অবৈধ পথ অনেক আছে, সেগুলোর কথা বলবোনা, বৈধগুলো বলি। ডলার আসে রফতানি আয় হিসেবে, রেমিটেন্স হিসেবে, অনলাইন আয় থেকে। ডলার যায় আমদানি ব্যয় হিসেবে, পড়াশোনার খরচ, চিকিৎসার খরচ হিসেবে।
....
কিভাবে আমরা ডলার পাই? পাঠাই ই বা কিভাবে?
আমাদের ব্যাংকগুলো বিদেশের ব্যাংকের সাথে একাউন্ট খোলে, একাউন্টগুলোর একটা নাম আছে, মজার নাম ’নস্ট্রো একাউন্ট’। আমি মজা করে বলি, নষ্ট একাউন্ট। অন্যের ব্যাংকে আমার একাউন্ট-এই হলো নস্ট্রো একাউন্ট এর সংজ্ঞা। অন্য বিদেশী ব্যাংকও আমাদের ব্যাংকে একাউন্ট খুলতে পারে। সেটার নাম হবে ভস্ট্রো একাউন্ট, আমি মজা করে বলি ভ্রষ্ট একাউন্ট। আমার ব্যাংকে তার একাউন্ট-এই হলো ভস্ট্রো একাউন্ট এর সংজ্ঞা।
তো, নস্ট্রো-ভস্ট্রো একাউন্টে লেনদেন হয় কিভাবে? চেক দিয়ে? সেটা থিওরিটিক্যালি সম্ভব, কিন্তু প্রাকটিক্যালি নয়। কেন? চেক নিয়ে কি আমার লোক প্রতিদিন সকালে নিউইয়র্ক দৈীড়াবে? চেক অবশ্য কুরিয়ারে পাঠানো যায়, সেটাও ঝুঁকিপূর্ণ, খুব ফিজিবল আইডিয়া নয়।
....
এখানেই আসে সুইফট এর ভূমিকা। আপনারা ইতোমধ্যে সুইফট ব্যাপারে ম্যালা ম্যালা তথ্য জেনে গেছেন, আমি আর ওদিকে যাচ্ছি না। সুইফট আন্ত:ব্যাংক টেলিযোগাযোগ নিশ্চিত করে। কিভাবে? টেলিফোনে? টেলিযোগাযোগ তো টেলিফোনেই হওয়া উচিত।
আসলে তা না। সুইফট ইন্টারনেট ব্যবহার করে। বিশ্বের ১০,০০০ এরও বেশী ব্যাংককে সার্ভিস দেয়। এর ব্যবহৃত নেটওয়ার্কের নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা খুব কঠিন।
মিলিয়ন মিলিয়ন এমটি জেনারেট হয় সুইফটে, এটাকে হ্যাক করা খুবই মুশকিল। কারণ এটা ব্যয়বহুল এবং সারা দুনিয়ায় ব্যবহৃত। এটার নিরাপত্তাব্যবস্থায় ন্যূনতম গলদ বের করতে পারলে সারা দুনিয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় তুলকালাম ঘটিয়ে ফেলা সম্ভব।
....
সুইফট এ কি মেসেজ পাঠানো যায়? সেটা কি চেক এর কাজ করে? এগুলোও আপনারা ইন্টারনেট ঘেঁটে বের করে ফেলতে পারবেন। আমি শুধু বলি, সুইফট এ মেসেজ দিয়ে আপনি আপনার নস্ট্রো একাউন্ট থেকে ইচ্ছেমত অর্থ স্থানান্তর করতে পারবেন।
তবে শর্ত আছে, এই মেসেজ শুধুমাত্র আপনার ইউজারনেম আর পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেই দেয়া যাবে। আপনার ব্যাংকের নেটওয়ার্ক থেকেই শুধু পাঠানো যাবে। আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, এই মেসেজ একবার ট্রান্সমিট করে ফেললে আপনি আর এই মেসেজের আদেশ প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন না। একবার মেসেজ পেলে বিদেশী ব্যাংক নির্দিধায়, আপনাকে জিজ্ঞেস না করেই আপনার নস্ট্রো থেকে টাকা স্থানান্তর করে দেবে, পরবর্তীতে আপনার কোন ওজর আপত্তি পাত্তা পাবেনা। (অনেকটা নগদ টাকা নিয়ে ব্যাংকের কাউন্টার ত্যাগ করার মতো, পরবর্তীতে কোন বক্তব্য গ্রহনযোগ্য হবেনা)।
....
কি মেসেজ দিয়ে অর্থ স্থানান্তরের আদেশ দেয়া যায়? এমটি ১০৩ আর এমটি ২০২(আগ্রহ থাকলে ইন্টারনেটে এগুলোর মাজেজা খুজুন)। এগুলো শুধুমাত্র ব্যাংকের একজন ইনপুটার আর একজন অথরাইজারই করতে পারেন। আর সেটাও করতে হবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে বসেই। আর কোনভাবে যদি করা সম্ভব হতো, তাহলে দুনিয়ার ১০,০০০ ব্যাংক শুধু শুধু সুইফট কে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ফি দিতো না।
....
বেশ বড়সড় বক্তৃতা দিয়ে ফেললাম। আপনি কষ্ট করে পড়ে থাকলে, কেন দিলাম, সেই কারণটা আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবেনা বলে আশা করি।
বাঁচতে হলে জানতে হবে, বুঝতে হবে।
ভালো থাকুন।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০১৬ দুপুর ১:৩১