সে রাতে অমাবস্যা ছিল। চারিদিকে কালো কুচকুচে অন্ধকার। সেই অন্ধকারকে ব্যাবচ্ছেদ করে হাঁটছিলাম আমি। রাত ক'টা বাজে তখন? দু'টো কি তিনটে? আমি হাঁটছি একা। জনশূন্য রাস্তা। কথায় আছে অন্ধকারে নাকি নিজের ছায়াও সঙ্গ ছেড়ে দেয়! আমাকে ভয় দেখাতেই বোধহয় ল্যাম্পপোস্টের লাইটটাও ভেঙ্গে গেছে!
বারবার মনে হচ্ছে পেছন পেছন কেউ একজন আসছে। এমনিতে মুখে বলি ভূতে বিশ্বাস নেই আমার। কিন্তু মনে মনে ঠিকই ভয় লাগছিল। ব্যাপারটা ভূতের না, ব্যাপারটা অতিপ্রাকৃত কিছু দেখে ফেলার ভয়! "পেছনে তাকাব না তাকাব না" করতে করতে কি মনে করে যেন ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেলাম একবার! না, কুচকুচে কালোয় কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা। কিন্তু পায়ের শব্দটা থেমে গেল মনে হচ্ছে!
ব্রেকআপ হয়েছিল আমার তিন দিন আগে। কয় বছরের প্রেম ছিল?? দাঁড়ান, হিসেব করে নেই। উমমম... ৬ বছর ৭ মাস! প্রথমদিকে বেশ মনে থাকত এসব হিসেব নিকাশ। প্রতি মাসে সেলিব্রেট করতাম আমরা। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ব্যাপারগুলো একটু কমে আসা শুরু করল। ২-৩ বছর পর আমরা অ্যানুয়াল অ্যানিভারসারি পর্যন্ত পালন করা বন্ধ করে দিলাম। ভেতর থেকে আর সেই আগের উত্তেজনাটা আসছিল না। দিনদিন ব্যাপারগুলো রুটিনের আওতায় পড়ে যাচ্ছিল। সকাল বেলা তার গুড মর্নিং টেক্সট দেখে আর আগের মত হাসি ফুটতো না মুখে। বরং প্রতি সকালে স্মার্টফোনের স্ক্রিনে ৪টা টেক্সটের নোটিফিকেশন দেখলেই বিরক্ত লাগত। জানতাম এর মাঝে ৩টা পাঠিয়েছে এয়ারটেল আর একটা পাঠিয়েছে সে! মাঝে মাঝে টেক্সট ওপেন না করেই ডিলিট করে দিতাম!
আমাদের মাঝে কোন ঝগড়া ছিল না। আমার কোনো ব্যাপারেই সে রাগ করত না। আমি অন্য কোনো মেয়ের সাথে কথা বললেও সে কিছুই বলত না, বরং আমি তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে বলত সে জানে আমি যা কিছুই করি দিনশেষে তার কাছেই ফিরে আসব তাই সে কিছুই বলে না! প্রথম দিকে ভাল লাগত ব্যাপারটা। পরে মনের ভেতর কেমন যেন লাগা শুরু হল। আমি নিজেকে প্রশ্ন করতাম "আসলেই কি অন্ধবিশ্বাস ? নাকি আমার প্রতি ভালবাসার গভীরতার অভাব?"
কেমন যেন একটা উত্তেজনাহীনতায় ভুগছিলাম আমি। প্রথম প্রেমের উত্তেজনা অনেক আগেই মিলিয়ে গিয়েছিল। রুটিনের মাঝে নতুনত্ব কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমি। তাই নতুনত্ব খুঁজতে তাকে ফোন করে বলেছিলাম আমি ব্রেকআপ করতে চাই!
প্রথমে বিশ্বাস করেনি । মজা করছি ভেবে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল "আমার মত করে কে ভালবাসবে তোমাকে?" চুপ করে রয়েছিলাম আমি। বলেছিলাম আমি একা থাকতে চাই। অনেক অনুনয়-বিনয় করেছিল সে। পাগলের মত কেঁদেছিল সেদিন। বলেছিল "তুমি কিছুদিন একা থাক সমস্যা নেই। আমি ডিস্টার্ব করব না। কিন্তু তাই বলে ব্রেকআপ কোরো না।" আমার না-বোধক উত্তর শুনে আর একটি কথাও বলেনি সে। চুপচাপ ফোন রেখে দিয়েছিল।
আজ তিন দিন পর ওর এলাকার ছোট ভাইটা ফোন দিয়েছিল সন্ধ্যায়। বলেছিল "ভাইয়া, কবর দেওয়ার সময় তো এলেন না। ৪ দিনের মিলাদটা মিস কইরেন না এটলিস্ট!"
পায়ের আওয়াজটা আবার বেড়েছে! কেমন যেন খসখস শব্দ। ভয়ে ভয়ে আবার ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে কলিজাটা বের হয়ে আসতে নিয়েছিল ভয়ে। অন্ধকারের মাঝে জ্বলজ্বল করছে দুটি লালচে চোখ!! ধীরে ধীরে কাছে আসছে। অবয়বটা বোঝা যাচ্ছে এখন। বেশ বড়সড় একটা কুকুর। চিনতে পারলাম কুকুরটাকে। প্রথম এনিভারসারিতে আমি নিজেই কাঁটাবন থেকে এটা কিনে দিয়েছিলাম তাকে। কবরস্থান থেকে এখনো নড়েনি সে। আজ মাঝরাতে আমার দিকে তাকিয়ে যেন বিদ্রূপ করে বলছে "তোর থেকে আমি বেশি লয়াল!"
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ৮:৩৫