ইরানের বাগদাত সিটিতে এক রাজা ছিলেন। রূপকথার গল্প যেমন হয় আরকি, রাজা বড়ই মহৎ। তার মন অনন্ত জলিলের বুকের মতই উচু মানে ব্রড। তাঁর কাছে এসে কেউ কোনদিন অবিচার পায় নাই। অন্তত তাঁর তাই মনে হয়, কারণ সবাই হাসি মুখে বেড়িয়ে গেছে দরবার থেকে।
তো সেদিন সকালেও তাঁর দিল খুব খুশী ছিল। তিনি বসে বসে দাঁড়িতে হাত বুলাচ্ছিলেন। তাঁর এই দাঁড়ি বেগম সাহেবা খুব পছন্দ করেন। তিনি নিজেও দাঁড়িকে বউকে আদর করার মতই আদর করছেন।
এমন সময় এক ব্যক্তি আসল। সে এসেই রাজাকে বলল, “হুজুর, আপনার কাছে বিচার চাইতে এসেছি। আমি জানি আপনি সুবিচার করবেন।”
রাজা বললেন, “আলবাত সুবিচার করবো। তুমি আগে বারো”।
“হুজুর পেশায় আমি চোর। সাত পুরুষ ধরে আমরা এই পেশায় আছি। আমার পিতা খুব নামকরা চোর ছিলেন হুজুর। আপনি তাকে চিনিবেন হুজুর। তাঁর নাম রহমত আলী। গতবছরে তিনি মরে গিয়েছেন। আল্লাহ তাকে বেহেস্ত নসিব করুন।”
রাজা বললেন, “হ্যাঁ তোমার পিতাকে আমি চিনি। একবার তাঁর কান মলে দিয়েছিলাম মুরগী চুরির অপরাধে।”
চোর খুশী হয়। সে বলে, “আপনার মহত্ত্ব হুজুর। আমাদের বিরুদ্ধে অনেকের অভিযোগ, হুজুর। কিন্তু আমরা তো, সাত পুরুষের পেশা ছাড়তে পারি না, না? আর না হয় ছাড়লামই, কিন্তু খাব কী? দিন চলবে কীকরে? দিনের বেলা না হয় চলল, কিন্তু রাত তো চলবে না!”
কথা ট্রু। চুরি ছেড়ে দিলে বেচারার পেট চালানোই দায় হয়ে যাবে। আর যেহেতু সে চোর, তাই কেউ অন্য কাজেও নেবে না।
রাজা দাঁড়ি ঝাঁকিয়ে বললেন, “তা তো বটেই, তা তো বটেই। চুরি ছেড়ে দিলে তোমার দিন গুজার হবে কীকরে? আর চুরিটুরি না হলে, আমার কাছেও তো বিচার আসবে না। তখন আমি সারাদিন কী করবো?”
চোরের মুখে এবার মুচকি হাঁসি লক্ষ্য করা যায়। সে বলে, “ভাবুন তাহলে ব্যাপারটা হুজুর। আর দেখুন না চারদিকে কেমন রেষারেষি। এ ওর ক্ষতি করছে, ও এর ক্ষতি করছে। একজনের উন্নতি হচ্ছে, তো আরেকজন পিছন থেকে উন্নতির লুঙি খুলে দিচ্ছে। কেউ কারো উন্নতি সহ্য করতে পারছে না। আর এদিকে আমাকে দেখুন! আমি চাচ্ছি, সবার উন্নতি হোক, সবার ঘর সোনাদানায় ভরে উঠুক।”
রাজা সায় দেয় ওর কথায়, “তা ঠিক বলেছ বটে। তোমার মত মহৎ মন আর কয়জনের আছে? আমার ছাড়া আর কাররই নেই।”
চোর জিহ্বা কাটে এবার। “ছি হুজুর, আমার সাথে নিজের চরিত্রের তুলনা করে কেন আমার মানসম্মানের বলৎকার করছেন? আমার সাথে আপনার তুলনা হয়?”
রাজা থতমত খেয়ে যান। “তা ঠিক বলেছ বটে। হে হে হে। ঠিক বলেছ।”
“হুজুর আমার বাবা খুব মহৎ লোক ছিল” চোর বলতে থাকে।
রাজা তাকে থামিয় দিয়ে বলে, “তা তোমার কথা বল। তোমার বাবার কাহিনী শোনার ইচ্ছা করছে না।”
“ওকে। লেট’স কাম টু দ্যা পয়েন্ট। কাল রাতে আমি চুরি করতে গিয়েছিলাম দর্জির বাড়ি। শালা আবালচোদ খুব টাকা কামিয়েছে।”
“চুতমারানি, মুখের ভাষা ঠিক কর” রাজা চিৎকার করে বলেন।
“জো হুকুম, হুজুর। তো গেলাম রাতের বেলা চুরি করতে। দর্জির বাড়ির পাঁচিল খুব উঁচু। ঐ শালা দর্জি আবার পাঁচিলে পেরেক ঠুকে রেখেছে। ঐ পেরেকে গুঁতো লেগে আমার কী হয়েছে দেখুন?”
রাজার চোখ আলুর মত হয়ে গেল। তিনি এতক্ষণ দেখেননি কেন, সেটাই ভাবছেন। চোর বলে, “আমার একটা চোখ গেছে। আমি এখন কানা। দর্জি যদি পেরেক না পুঁতত তাইলে আমার আর চোখের এমন হতো না। হুজুরের কাছে আমার আকুল নিবেদন এই যে, আমার উক্ত চোখ ফেরত দিয়ে এবং দর্জির প্রাপ্ত শাস্তি দিয়ে আমাকে বাধিত করবেন...নিবেদক”
“বুঝেছি বুঝেছি... থাম”। চোরের মুখের তুবড়ি থামল, কিন্তু তার চোখের পানি থামল না। রাজা দেখলেন, চোরের যেই চোখ ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, সেই চোখ দিয়েই পানি বেশি বের হচ্ছে। তিনি রাজকণ্ঠে বললেন, “তলব কর দর্জিকে”।
দর্জি আসল। রাজা বললেন, “কী তোমার কৈফিয়ত?”
“হুজুর, আপনি মহান। চোরের কী দরকার ছিল দেয়াল টপকাবার? আমি তো ওকে দেয়াল টপকাতে বলি নাই। ও নিজ দায়িত্বে দেয়াল টপকেছে। তার জন্য আমি কেন দায়ী আমি কেন হব হুজুর?”
সেটাও কথা বটে! রাজা খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি বললেন, “তা না হয়, বুঝলাম। কিন্তু ও তো ওর কর্তব্য করছিল মাত্র। সে কাজ না করলে তার পেটে ভাত জুটবে না। আর তুমি যদি পেরেক দেয়ালে না পুঁতে রাখতে তাহলে ওর চোখ এভাবে মাঠে মারা যেত না আই মিন দেয়ালে মারা যেত না! সুতরাং তোমার চোখ বাজেয়াপ্ত করা হল। তোমার চোখ উপরে নেয়া হবে!”
দর্জি কান্নাকাটি শুরু করে দিল। সে জানত, কান্নাকাটি করলেও যদিও বা হুজুরের মন গলে, কিন্তু তার হুকুমের আর মন গলবে না। একবার যা বলে ফেলেছেন সেটা তিনি করবেনই। চোখ তার যাবেই।
“হুজুর আপনি মহান, আপনি ঠিক বিচারই করেছেন, আমি এটা জানি। কিন্তু ভেবে দেখুন, আমার উপর কতো বড় পরিবার- আমার চোখ চলে গেলে, তারা কী খেয়ে বাঁচবে হুজুর? আর একটা চোখ যদি আমার উপড়ে ফেলা হয়, তাহলে আমি সূচে সুঁই ঢুকাব কী করে? আমি তো তখন আমার কর্তব্য করতে পারব না! আমার কাপড় ভাল হবে না। বাজারে আমার বদনাম হবে”
হুজুর দাঁড়িতে হাত বুলাতে থাকেন। বেচারার কোথাগুলো ভাববার মত। ওর একটা চোখ উপড়ে ফেলা উচিৎ বটে তবে ওর চোখ না থাকলে ওর ব্যবসায় হ্যারিকেন জ্বলবে, আর পশ্চাতে ঢুকবে বাঁশ। ব্যবসার উন্নতির অধিকার সবারই আছে। চোরেরও যেমন নির্দ্বিধায় চুরি করার অধিকার আছে, দর্জিরও তেমন অধিকার আছে কাপড় বানানোর। আর ও কাপড় না বানালে পরিবারের এতগুলো মানুষ না খেয়ে মরবে। হুজুর বড় চিন্তায় পড়ে গেলেন, বিশাল প্রবলেম।
হুজুর চিন্তায় পড়ে গেছে দেখে দর্জির মনে একটু আশার সঞ্চার হল। সে বলল, “হুজুর যেহেতু চোখ উপড়ানোর কথা বলেই ফেলেছেন তবে চোখ উপড়াতেই হবে। কিন্তু আমার চোখ উপড়ালে আমার ব্যবসার ক্ষতি হবে। এমন কারো চোখ তোলা উচিৎ যার এতে ক্ষতি নয় বরং লাভই হবে!”
বড়ই চিন্তার কথা। হুজুর ভাবতে লাগলেন, কে সেই ব্যক্তি যার চোখ তুললে ক্ষতি হবে না বরং লাভই হবে। চোর সেখানে উপস্থিত ছিল, সে তৎক্ষণাৎ কমেন্ট করল, “আমার বাড়ির পাশে এক শিকারি থাকে, ব্যাটা যখন তীর ছোড়ে তখন একটা চোখ বন্ধ করে রাখে। দুটো চোখ নিয়ে ওর অসুবিধা। তার যদি একটা চোখ উপড়ে ফেলা হয় তবে সুবিধা। একটা চোখ আর কষ্ট করে বন্ধ রাখতে হবে না। ওর কাজ সহজ হয়ে যাবে।”
কথাটা রাজার মনপুত হল। তিনি বললেন, “তবে তাই হোক, ডাক শিকারিকে। তার চোখই উপড়ে ফেলা হোক।”
চোর বলল, “অপরুপ আপনার বিচার, জনাব। অনন্য আপনার মহত্ত।”
সেই শিকারিকে ডাকা হল। তাকে বলা হল, তার চোখ উপড়ে ফেলা হবে। এতে করে তারই লাভ! কিন্তু সে বুঝতে চায় না। কান্নাকাটি করতে থাকে। কিন্তু রাজার হুকুম। কিছু করার নেই। সুতরাং তার একটা চোখ উপড়ে ফেলা হল।
চোর বলে, “আপনার মহান বিচার”
দর্জিও বলে, “জয় মহারাজ বাগদাদেশ্বরের জয়”।
উপরের গল্পের রাজার সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পাচ্ছেন না? না পেলে বলব আপনি কানা। অন্ধ বলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু কানা পারফেক্ট। আমাদের যে যেমন বোঝাচ্ছে তেমনই বুঝছি। একবার ডানে হেলছি তো একবার হেলছি বামে।
ষোলই ডিসেম্বর লাফাচ্ছি ঠিকই কিন্তু যখন পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের কথা উঠছে, তখন নির্বাক।
ওরা বলছে, “পাকিস্তান আমাদের সাথে ঠিক করে নাই। তারা একাত্তরে অনেক মানুষ হত্যা করেছে। কিন্তু তাদের সাথে সম্পর্ক ছেদ করার আগে ভাবতে হবে বাণিজ্য......... ম্যা ম্যা ম্যা”
আমরা বলছি, “খুব ভাল বলেছেন। আবেগের বশে কিছু করা যাবে না”
চোর বলছে, “মনে করুন আপনি চা খাবেন। টিস্টলে গেলেন। দেখলেন একটা টেবিল খালি আছে। তার ডানে একটা চেয়ার। বামে একটা চেয়ার। আপনি ডানের চেয়ারটায় বসলেন। আপনার অধিকার আছে ডানের চেয়ারে বসার। আপনি ইচ্ছা করলে বামের চেয়ারেও বসতে পারতেন ...আমি আজ ভাত খেয়েছি... কাল ভাত খেয়েছিলাম...... আগেরদিনও ভাত খেয়েছি...... ৭১ এ দুইটা পক্ষ ছিল। একটা বাংলাদেশের পক্ষে আরেকটা পাকিস্তানের পক্ষে। কেউ যদি পাকিস্তান সাপর্ট করে সেজন্য তাকে আপনি দোষী বলতে পারেন না। একবার ভাবুন, যুদ্ধে পাকিস্তান জিতলে কী হতো? তখন কিন্তু রাজাকার হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের ফাঁসি হতো”
আমরা বলছি, “ভাববার মত কথা বটে”
ওরা বলছে, “সেদিন আমি একটা সঙ্গীতানুষ্ঠানে গেলাম। প্রচণ্ড সুন্দর একটা দিন। এমন দিনে তারে বলা যায়.................. পাখি গান গায়...... কি সুন্দর ফুল...... কিন্তু গান শুনেই মেজাজ গরম হয়ে গেল। এগুলো কিছু হল। এরা রেওয়াজ করে না। সবখানেই অনাচার............ টুং টাং... অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় নি বলেই রেওয়াজ না করা শিল্পির ফাটা কণ্ঠের মতই দেশ চলছে”
আমরা বলছি, “সেটা ঠিক। নির্বাচন ভাল না হলে গান ভাল হয় কেমনে। কথা ট্রু”
ওরা বলছে, “আসল রাজাকারের ফাঁসি হয় নাই। আমরা আসলে আসল রাজাকারেরা ঝুলবে আর আসল মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রাপ্য সম্মান পাবে। এরা কেউ আসল মুক্তিযোদ্ধা না”
আমরা বলছি, “হে হে হে”
ওরা বলছে, “মনে করুন, একটা ফুল সুন্দর। সেটাকে ভাল বলার অধিকার আপনারও আছে। আমারও আছে। ... আমি তুমি... তুমি আমি... বেগম জিয়া বলেছেন, তার শহীদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ আছে। থাকতেই পারে। কোন কিছুই তো সন্দেহের উর্দ্ধে না। শহীদ ত্রিশ হাজার ছিল না ত্রিশ লাখ আমরা সেটা হলফ করে বলতে পারি না। কিন্তু তাকে খারাপ ভাষায় যেভাবে গালিগালাজ করা হচ্ছে তা মানা যায় না। তাকে গোলাপি বলা কখনোই ঠিক না। তার না হয় চরিত্র একটু ঢিলাঢালা ছিল তাই বলে আপনি তাকে গালিগালাজ করতে পারেন না। তিনি জেএসসি এটা বলা মিথ্যাচার। কারণ প্রমাণ আছে, তার আমলে জেএসসি ছিল না”
আমরা বলছি, “তাতো বটেই। তা তো বটেই”
কিন্তু রাজা আর আমাদের একটা পার্থক্য আছে। ধরতে পেরেছেন? পারেননি জানি। রহমত আলী যে মুরগী চুরি করেছিল, এটা তার মনে আছে। কিন্তু আমাদের মুরগী চুরির কথা খেয়াল নেই।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:১৩