
কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েই শুরু করি লেখাটা।
কে যেন একবার বলেছিল, কোন ছেলের চুল বড় হলে, যে কেউ অন্তত ২য় বার ফিরে তাকায় তার দিকে। কথাটা মনে ধরেছিল। তাই কিনা কে জানে, হঠাৎ করেই ইচ্ছে হলো চুল বড় রাখার। মেয়েদের মত কোমর পর্যন্ত না হলেও, রবীন্দ্রনাথের তরুণবেলার চুলের মত কাঁধ পর্যন্ত। মেয়েরা এমনিতে কেউ তাকায় না, চুলের বদৌলতে যদি তাকায় একআধবার- সেটাই বা কম কিসের?
কিন্তু চুল বড় রাখতে চাইলেই তো আর রাখা যায় না। চুল বড় হতে সময় লাগে। এই ছোট থেকে বড় হওয়ার মাঝের সময়টাই সবচেয়ে ভয়ংকর। এসময়েই লোকের বিভিন্ন কথা শুনতে হয়। কেউ দেয় বাহবা, কেউ মারে টিটকারি।
মা খুব একটা আপত্তি করেনি আমার এ সিদ্ধান্তে। বাবা করেছিল। বাবা একটু মৌলবাদী টাইপের মানুষ। আমার চুলের বেগতিক রকমের দৈর্ঘ্য দেখে দুএকদিন চোটপাট করলেন। কিন্তু আমি যখন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, নিউটন, কার্ল মার্ক্স, দ্যা ভিঞ্চি থেকে একালের জয় গোস্বামী আর নির্মলেন্দু গুনের উদাহরণ টেনে বোঝালাম, একমাত্র চুলের দৈর্ঘ্য কম বলেই তাদের নাগাল ধরতে পারছি না, প্রতিভাটা খুলছে না খুলি খুলি করেও, তখন তিনি চুপ করে গেলেন।
কিন্তু সমস্যাটা বাঁধল বাড়ি থেকে হলে এসে। একদিন গেস্টরুমে বড় ভাইরা ধরলেন বড় চুলের জন্য। আচ্ছা মত ঝাড়ি দিয়ে বললেন, আমার এমন চুল দেখে হলের আরো অনেকেই বড় চুল রাখতে পারে, যা ছেলেদের নৈতিক চরিত্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। আমাকে তাই চুল কাটাতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। নাহলে ছাড়তে হবে হলের মায়া।
বড় ভাইদের কথা শুনে আমার প্রতিক্রিয়া হলো মিশ্র। তাদের মতে, আমার চুল দেখে অনেকেই বড় চুল রাখার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। তারমানে, আমার চুলগুলো অন্তত অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে! আয়নায় নিজের বিশাল সাইজের চুলগুলো যতটা খারাপ দেখায়, ততোটা খারাপ নয় অন্তত! আর খারাপ লাগলো, একথা ভেবে যে, আমার চুল নৈতিক চরিত্রের জন্য ক্ষতিকর। আমাকে অবিলম্বে এমন অনুকরণযোগ্য চুলও কাটিয়ে ফেলতে হবে!
উক্ত প্রতিক্রিয়ার পর যা হলো, তা প্রচন্ড রাগ। আমাকে চুল কাটানোর নির্দেশ দেয়ার বড় ভাইয়েরা কে? আমার কি নিজের চুল বড় রাখার অধিকারও নেই? নিজের বাবা মা যেখানে কিছু বলল না, সেখানে কোন বড়ভাইয়ের আদেশ শুনে আমাকে চুল ছোট করে ফেলতে হবে!
ঠিক করলাম, যা ইচ্ছে বলুক ওরা। আমি আমার ইচ্ছে মত চুল রাখবো। কাটালাম না পরের গেস্টরুম পর্যন্ত।
ফলাফল? আমার অবাধ্যতা দেখে, সিংগেল গেস্টরুম নিল ওরা আমার। আমাকে একা একটা রুমে নিয়ে গিয়ে র্যাগ দিল ২০-২৫ জন মিলে। র্যাগিং এর এক পর্যায়ে, আমাকে বাধ্য করল নিজের চুল নিজেই কাচি দিয়ে কাটতে!
এ ঘটনার পর, ইচ্ছে হয়েছিল, সব ছেড়েছুড়ে বাড়ি চলে যাই। বাড়ির পাশের অনার্স কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করলেও অন্তত পেটের ভট জুটবে। বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাইয়ের অত্যাচার তো আর সইতে হবে না!
কিন্তু চলে যেতে পারিনি হল ছেড়ে। বাস্তবতা বাধা দিয়েছিল বাড়ি ফিরতে। ইগোর চেয়ে ক্যারিয়ার অনেক বড়, এমনটা সহপাঠীরাও বুঝিয়েছিল সান্ত্বনা দিয়ে।
বড় ভাইদের সাথে এখন দেখা হয় প্রতিদিন। ক্যান্টিনে, রিডিং রুমে, লাইব্রেরিতে, ডিপার্টমেন্টের সামনে। প্রতিবার দেখা হলে, সালাম দিয়ে হ্যান্ডশেক করি তাদের সাথে। হাসি মুখে জিজ্ঞেস করি, “ভাই, কেমন আছেন?”।
২
কোটা সংস্কার আন্দোলন তখন তুঙ্গে। অনেক তর্কবিতর্ক, অনেক আলোচনার পর ঠিক করলাম সবাই, ডিপার্টমেন্টের ক্লাস বর্জন করা হবে। সেদিনই ক্লাস ছিল আমাদের। একটা assignment জমা দেয়ার শেষ দিন ছিল সেটা। ঠিক করা হলো, সেদিনের ক্লাসটা করবো আমরা, কিন্তু আগামীদিন থেকেই ক্লাস পুরোপুরি বন্ধ।
ক্লাস ছিল দুপুর দুটোয়। হল থেকে হন্তদন্ত হয়ে এসে, ক্লাসে ঢুকতে যাবো, ঠিক এমন সময়ে বড় ভাইয়ের ফোন।
“মধুতে আয় পাঁচ মিনিটের মধ্যে।“
বললাম, “ভাই, ক্লাস আছে। আমি ডিপার্টমেন্টে এখন।“
আমার কথা শুনে বড় ভাই, মনে হলো, তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। হয়ত তার সামনে থাকলে, গালে একটা থাপড়ই বসিয়ে দিতেন। বললেন, “তুই কোথায় আছিস, কী করছিস- এগুলা তো আমি শুনতে চাই নাই। তুই আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে মধুতে আসবি। তোকে আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে মধুতে দেখতে চাই।“
সারারাত জেগে assignment এর কাজ করেছি। সকালে উঠে ছবি সংযোজন, প্রিন্ট ইত্যাদি করতে গচ্ছা গেছে একশো টাকার মত। অথচ সে assignment আমার জমা দেয়া হলো না!
ক্লাসের বদলে মধুর ক্যান্টিনে গিয়ে স্লোগান দিতে হলো আমার মতই ক্লাস মিস করে আসা আরো অনেকের সাথে। “কে বলে রে মুজিব নাই? মুজিব সারা বাংলায়। আমরা সবাই মুজিবসেনা, ভয় করিনা বুলেট বোমা। **** হলের মাটি, ছাত্রলীগের ঘাঁটি।“
সত্যিই আজ দেশের প্রতিটা ঘরে ঘরে একজন করে মুজিব জন্ম নিয়েছে। তারা এখন সবাই ছাত্রলীগের কর্মী হয়ে সভাপতি কিংবা সাধারণ সম্পাদকের পা চাটছে ক্লাস, পড়াশুনো, বই ছেড়ে।
৩
আমার জিয়া হলের এক বন্ধু সিগারেট খাচ্ছিল টিএসসিতে দাঁড়িয়ে। আচমকা হলের এক পলিটিক্যাল বড় ভাইকে দেখে সালাম দিয়ে হ্যান্ডশেক করে সে। এটাই নিয়ম সব হলের। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় সে ভুলে গিয়েছিল সিগারেট ফেলে দিতে।
সিগারেট হাতে বড় ভাইয়ের সাথে হ্যান্ডশেক করার অপরাধে জিয়া হলের বড়ভাইয়েরা রড দিয়ে পিটিয়েছিলেন আমার সে বন্ধুকে।
ডিএমসিতে আহত সে বন্ধুকে দেখতে গেলে সে বন্ধু বলেছিল, “আমার বাড়িতে এসব বলিস না, প্লিজ। আম্মুর হাই ব্লাডপ্রেসার। আমি মার খেয়ে মেডিকেলে আছি শুনলে কী যে হবে, ভাবা যায় না!”
আমি আমার সে বন্ধুর মাকে জানাইনি এসব। শুধু আর টিএসসিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাই না। হঠাত কোন ভাইয়ের দেখা হলে? যদি সিগারেট হাতেই হ্যান্ডশেক করে ফেলি? আমি বুঝে গেছি, এই বিশ বছর বয়সেও আমার স্বাধীনভাবে সিগারেট খাওয়ার অধিকার নেই।
৪
কিছুদিন আগে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। এটা নিয়ে লেখালেখি হয়েছে অনেক। সেসব নিয়ে বলতে চাই না।
যেদিন সম্মান পেয়েছে বাংলাদেশ, সেদিনই গেস্টরুমে বলে দেয়া হলো, “কাল ছাত্রলীগের আনন্দ মিছিল হবে। হলের সবাইকে যেন হলগেটে সকাল দশটায় পাই আমরা। কেউ না থাকলে তাকে হল থেকে বের করে দেব!”
পরদিন সকাল দশটায় আমরা হলগেটে উপস্থিত হলাম। দুঘণ্টা অপেক্ষার পর, আমরা অংশ নিলাম আনন্দ মিছিলে। প্রচন্ড রোদের মধ্যে মধুর ক্যান্টিন থেকে টিএসসি হয়ে শহীদ মিনার পর্যন্ত স্লোগান আর হাততালি। এর মধ্যে টিএসসিতে লীগের কয়েকজন হোমরাচোমরা ভাষণ দিলেন প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করে। আমরা তার সেই ভাষণ সূর্যের প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে শুনে হাততালি দিলাম।
বিশ্বাস করুন, সেদিনের আনন্দ মিছিলের পর, যদিও কোন ঈশ্বরেই বিশ্বাস করি না, প্রার্থনা করেছিলাম, “বাংলাদেশ যেন উন্নয়নশীল দেশ হয়েই চিরদিন থাকে। উন্নত দেশ হয়ে না যায় কোনিদিন। উন্নত দেশ হলেই তখন আবার আমাদের বাধ্য হয়ে রোদের মধ্যে আনন্দমিছিল করে কিছু পাতি নেতার মুখে প্রধানমন্ত্রীর গুণগান শুনতে হবে।“
৫

গেস্টরুমে আমাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আমরা যেন প্রতিটা ভাইকে ফেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাই আর তাদের আপলোড দেয়া ছবি আর পোস্টে কমেন্ট করি। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি কোন ছবি আপলোড করলে, আমরা যেন তার ছবি শেয়ার করি, সেকথাও বলে দিয়েছেন তারা।
আমরা সাধারণত বড় ভাইদের ছবিতে “নাইস পিক” আর পোস্টে “সহমত ভাই” লিখে কমেন্ট করি। কেন্দ্রীয় ও হল সভাপতির ছবি শেয়ার করলে তার সাথে লিখে দেই, “ভালবাসা!”
৬

বড় ভাইয়েরা এটাও বলে দিয়েছেন, কারও সাথে সমস্যা হলে আমরা যেন আগে পিটাই। পিটিয়ে হলে ফিরে আসি। এ জন্য তারা আমাদের সবসময় একসাথে থাকতে বলেছেন। যাতে আমরা কোথাও ঝামেলা লাগলে একসাথে ঝাপিয়ে পড়তে পারি।
মারামারির পর কী হবে সেটা নিয়ে আমাদের কিছু ভাবতে হবে না। আমাদের রক্ষার জন্য বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ট্যাগ আছে।
আমরা তাই মাঝেমাঝেই মারামারি করি। বাস ভাঙ্গি। রিক্সাওয়ালার সাথে পাঁচটাকা নিয়েও বচসা হলে থাপ্পড় মারি গালে। চায়ের দোকানে বিল না দিয়ে চলে আসি অনেকসময়। পুরান ঢাকার বহিরাগতদের ধরে পিটাই। বুয়েট আর মেডিকেলের সোনার ছেলেদের সাথে আমাদের প্রায়ই মারামারি লাগে।
***
উপরের ঘটনাগুলোর মত শতশত ঘটনা বলে যেতে পারবো একটানা। এর সব কিছু ঘটেনি আমার সাথে। কিন্তু আমার মতই কোন একজনের সাথে হয়েছে এমন।
প্রতিবছর জানুয়ারিতে নতুন ছাত্ররা হলে আসা শুরু করে। ঠিক এসময়েই তাদের ম্যানার শেখানোর নাম করে গেস্টরুম শুরু হয় প্রতিটা হলে। গেস্টরুমে বড় ভাইদের হাতে থাকে সুপ্রিম পাওয়ার। তারা চাইলেই ফ্রেসারদের গায়ে হাত দিতে পারে, রডের বাড়ি দিতে পারে, কলার ধরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারে, গালি দিতে পারে বাপমা বোন তুলে, শাস্তি হিসেবে হল থেকে বহিষ্কার করতে পারে কয়েকদিনের মত। আর ভাইয়েরা এ সুযোগ ব্যবহার করে ইচ্ছে মত। এভাবে চলতে থাকে টানা একটা বছর। গেস্টরুমের লক্ষ্য, হলে আসা নতুন ছাত্রদের ছাত্রলীগের কর্মসূচীতে নিয়ে যাওয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রেরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পড়তে আসে। অনেকের এ শহরে থাকে না কোন পরিচিত। বাইরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকবে, এ সামর্থও থাকে না সবার। তাদের একমাত্র ঠিকানা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো। নিজের শেকর ছেড়ে আসা অসহায় এই ছাত্রদের হলে এসে পড়তে হয় গেস্টরুমের বড়ভাই নামক জানোয়ারদের হাতে। গালি দিয়ে, মেরে, মানসিকভাবে নির্যাতন করে তারা ভেঙ্গে দেয় প্রতিটা তরুণের মেরুদণ্ড। যাতে করে, তারা দলের প্রতিটা কর্মসূচিতে থাকে। এবং থেকে সরকারী দলের কর্মীসংখ্যা বৃদ্ধি করে।
শুধুমাত্র দলীয় কর্মসূচি নয়, প্রথম বর্ষের ছাত্রদের বড় ভাইদের খুঁটিনাটি কাজও করে দিতে হয়৷ যেমন, সিগারেট কিনে দেয়া, ক্যান্টিন থেকে খাবার নিয়ে আসা, লন্ড্রিতে কাপড় দিয়ে আসা ইত্যাদি। এসব করতে করতে ফ্রেসারদের ব্যক্তিত্ব কখন যে নেই হয়ে যায়, তা তারা নিজেরাও বুঝতে পারে না। সাথে আছে শাস্তি ও শাস্তির ভয়। তাদের স্কেলে ছোট অপরাধ হলে গালাগাল আর বড় অপরাধ হলে রডের বাড়ি। একটা ব্যাচকে মেরুদণ্ডহীন করতে এর চেয়ে বেশি কী লাগে আর?
গেস্টরুমের প্যারা, প্রোগ্রামের ব্যস্ততা এসব কাটিয়ে ছাত্ররা লেখাপড়ার সুযোগ কমই পায়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ছাত্র যে কারণে আসে, নতুন জ্ঞান অর্জন ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টি- তার কোনটিই সাধিত হয়ে ওঠে না। যারা টাকাওয়ালা কিংবা স্থায়ী ঠিকানা যাদের ঢাকা, তারা সাধারণত হলে থাকে না। তারা পড়াশুনা করার সুযোগটা হলের ছাত্রদের চেয়ে সামান্য হলেও বেশি পায় বলে, ডিপার্টমেন্টের পরীক্ষাগুলোতেও তাদের স্কোর বেশি থাকে সাধারণত। যা পরের বছরগুলোয় পূরণ করা রীতিমতো কষ্টসাধ্য। এভাবে একই মেধায় ভর্তি হওয়া ছাত্রদের ভেতরেও একটা সুক্ষ ক্লাস তৈরী হয়ে যায়৷ যারা হলে থাকে না, যাদের পারিবারিক অবস্থা আমাদের চেয়ে একটু সচ্ছ, তারা রীতিমতো টিটকারি মারে আমাদের চামচামির জন্য; কেন আমরা চামচামি করি তা না বুঝেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থার এমন নড়বড়ে অবস্থার জন্য গেস্টরুম অবশ্যই অনেকাংশে দায়ী।
গেস্টরুম প্রথা ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে ঢাবিতে জানি না। তবে এটুকু জানি পূর্বেই সব সরকারের আমলেই এটা ছিল। প্রত্যেকটা সরকারী দল চেয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজেদের আয়ত্তে রাখতে। আর এজন্য তাদের দরকার শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন। আর ছাত্র সংগঠন শক্তিশালী রাখতেই তারা শুরু থেকে গেস্টরুমের মাধ্যমে ফ্রেসারদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে তাদের নিজেদের দলে টেনে নেয়। পরবর্তীতে তারা যাতে রাজনীতি না করলেও যেন তাদের বিরুদ্ধাচরণ না করে, সে শিক্ষাও দিয়ে দেয় পুরোপুরি। ভয়ংকরভাবে।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের একটা ভাষণ দেখেছিলাম কিছুদিন আগে ইউটিউবে। তিনি কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বলেছেন, তাদের সময়ে নতুন কোন ছাত্র এলেই তারা তার সব ধরনের সাহায্য করত। ফর্ম পূরণ করে দিত, মেস ঠিক করে দিত ইত্যাদি। যাতে সে ছেলেটার সমর্থন পায় তারা। সে সময়কার ছাত্ররাজনীতিই ছিল এমন। ছাত্ররা নিজের ইচ্ছায় রাজনীতিতে যোগ দিত। কারণ তখন ছাত্ররাজনীতি মানে চাঁদাবাজি বোঝাত না, তখন ছাত্ররাজনীতি মানে নেতার পা'চাটা বোঝাত না, তখন ছাত্ররাজনীতি মানে বোঝাতো না মাদক ব্যবসার লাইসেন্স। ছাত্ররাজনীতি ছিল জনগণের জন্যই।
পাশার দান উলটে গেছে এখন। ছাত্রদের জোর করে রাজনীতি করানো হচ্ছে। বাধ্য করানো হচ্ছে মিছিলে যেতে। আর এজন্য ব্যবহার করা হচ্ছে গেস্টরুমের মত একটা অস্ত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এব্যাপারে জানে না, এমন একটা ভান করে থাকে৷ সত্যি বলতে, সরকারি দলের কাছে তারা অসহায়। কিংবা ক্ষমতা থাকলেও তার সঠিক প্রয়োগ তারা করছে না। নতজানু হয়ে আছে সরকারী ছাত্রসংগঠনের কাছে।অথচ একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই পারে গেস্টরুম প্রথার বিলোপ ঘটাতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, সাদ্দাম হোসেন, কিছুদিন আগে বলেছেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্টরুম কালচারের ধারণা আর থাকবে না। অতিথি কক্ষ অতিথিদের জন্যই থাকবে। আমরা সংখ্যায় নয়, মানে বিশ্বাস করি। সে কারণেই সাধারণ ছাত্রদের কাউকে জোর করে কর্মসূচিতে নেয়া হবে না।“
এটা একটা ভাল খবর। তার কথাগুলো শুনে আশা পেয়েছি। যদিও এসব লোকভোলানো কথা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তারপরও, তার আগে এভাবে কেউ বলেছেন বলে মনে পড়ছে না।
খারাপ খবর ছাড়া ভাল কোন খবরে ছাত্রলীগের নাম আজকাল আর শোনা যায় না। যে ছাত্র সংগঠনটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাথে জড়িত, তার এমন অধঃপতন দেখে লজ্জা লাগে। আশা করি, তারা এখন থেকে ভাল কাজ করেই খবরে আসবে। তাদেরও যে পূর্ববর্তী সরকারি ছাত্র সংগঠনগুলোর মত আচরণ করে ক্যাম্পাসে টিকে থাকতে হবে, এর মানে নেই কেন। এসব না করেও যে ছাত্রদের সমর্থন পাওয়া যায়, তার উদাহরণ তাদের নিজের দলেই আছে।
গেস্টরুম প্রথার ফলাফল কতটা ভয়াবহ এটা নতুন করে বলে দিতে হয় না। র্যাগিং এর নিও রুপ এই গেস্টরুম। র্যাগিং তো দু একদিন পর থেমেও যায়। কিন্তু কন্সেনট্রেশান ক্যাম্পের মত এই গেস্টরুম চলতে থাকে বছরব্যাপি। সপ্তাহে তিনদিন। কোন কোন হলে সপ্তাহের সাতদিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় অন্তত ৩০ হাজার শিক্ষার্থী থাকে। তাদের প্রত্যেককেই যেতে হয় এই গেস্টরুমের গণ্ডী পেরিয়ে। সবাইকে সহ্য করতে হয় বড় ভাইদের নির্মম অত্যাচার আর শীতল আচরণ। মানসিক পীড়নের ভয়ে জড়সড় থাকতে হয় সর্বদা। এই প্রথার বিলোপ হোক তাই অবিলম্বে। না হলে, আরও নিচে নামবে ঢাবি। অবস্থা হবে অনেকটা ঢাকা কলেজের মত। শিক্ষিত কারো বদলে প্রতিবছর উৎপাদিত হবে হাজার হাজার হৃদয়হীন নেতা আর রাজনৈতিককর্মী। মেরুদণ্ডহীন কিছু গিনিপিগ দখল করবে দেশের বিভিন্ন সেক্টরগুলো। দেশের জন্য এটা কোন সুখবর নয়।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ১:১৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


