somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ম্যারিটাল রেইপ ও আমরা

১৪ ই জুন, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কনসেন্ট সম্পর্কে আমাদের ধারণাটা এতোটাই অস্পষ্ট আর ঝাপসা যে অনেককে বলতে শুনছি, বিয়ের সময় তো পূর্ণসম্মতি দেয়াই হয়, সেখানে আবার বারবার সেক্সের সময়, সম্মতি নিতে হবে কেন! তাদের কথা শুনে বিয়েটাকে আমার অনেকটা ফুটবলের কন্ট্রাক্ট সাইনিং এর মতো মনে হয়েছিল। যেহতু দল আপনাকে কিনে নিয়েছে, আপনিও রাজী হয়েছেন দলের সব শর্তে, আপনাকে সব ম্যাচ খেলতেই হবে অসুস্থ না হলে কিংবা বিশেষ কারণ না থাকলে, আপনার ইচ্ছে অনিচ্ছার কোন দাম নেই।
জীবনটা এমন বাইনারি নিয়মে চলে না। একবার কোনকিছু করেছেন বলে, বারবার আপনাকে সে কাজ করতে হবে, এই চিন্তাটাও স্বৈরাচারী। ইচ্ছের বিরুদ্ধে যৌনকর্মীর গায়েও হাত দেয়ার অধিকার কেউ রাখে না। কোন বন্ধুর সাথে একবার বারে গিয়েছেন বলে সে যদি ধরে নেয়, সে বললেই আপনাকে মাল খেতে আবার যেতে হবে, সে বন্ধু ভয়ঙ্কর।
যাকে বিয়ে করলেন, সে একজন স্বাধীনচেতা মানুষ আর আপনি তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে যখন তখন তার উপর উপগত হতে পারেন না, এটা একটা সিম্পল বিষয়। বিয়ের সময়, কেউ তার স্বাধীনতা স্বামীর কাছে বিক্রি করে দেয় না। কনসেন্ট ছাড়া সেক্স মানেই রেইপ। জোরপূর্বক অপরিচিত কাউকে সেক্সে বাধ্য করা আর নিজের বৌকে বাধ্য করার মধ্যে মৌলিক পার্থক্যটা আসলে কী?
বিয়ে জিনিসটার উপর এতোটা অন্ধভাবে বিশ্বাস রাখারও কিছু নেই। তাদের মতেই, ‘পূর্ণসম্মতিতে’ বিয়ে করার পরও, অনেক মেয়েকে স্বামীর দ্বারা নির্যাতিত, নিগৃহীত হতে হয়। যৌতুকের জন্য পুড়িয়ে মারার ঘটনাও আমরা দেখেছি। এসব তো হওয়ার কথাই ছিল না, যেহেতু পূর্ণসম্মতিতে বিয়ে করেছে, জীবনটা হওয়া উচিত ছিল লেকের জলের মতো ঢেউহীন, স্থির, নিষ্কম্প। নারী নির্যাতন দমন আইনের দরকার কী? অথচ এদেশে নারীনির্যাতন একটা স্বাভাবিক, সাধারণ ঘটনা! এদেশের আইনেই, নিজের বৌকে থাপ্পড় মারা যদি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয়, তার অসম্মতিতে সেক্স করতে বাধ্য করাটা শাস্তিযোগ্য হবে না কেন?
আরেকটা ভাইরাল পোস্টে দেখলাম লিখেছে, ম্যারিটাল রেইপের আইন হলে, পুরুষের ‘পুরুষাঙ্গে একপ্রকার তালা’ ঝোলানো হবে! গুগল করে দেখলাম, তাদের কথামতো, পুরো ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া আর ওশেনিয়া মহাদেশের পুরুষদের পুরুষাঙ্গে তালা ঝুলছে! শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্য, চীন আর ভারতীয় উপমহাদেশের পুরুষদের পুরুষাঙ্গ মুক্ত স্বাধীন! আর একারণেই বোধহয়, এশিয়ায় জনসংখ্যা প্রতি বছর বাড়ে কোটিতে।


লাল রঙে চিহ্নিত দেশগুলোতে ম্যারিটাল রেইপ শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়!
বিয়েতে পূর্ণবিশ্বাস কিংবা ইমান আনা পুরুষেরা আরো বলছে, ম্যারিটাল রেইপ শাস্তিযোগ্য হলে, মিথ্যা মামলা বেশি হবে।
এদেশে এমন লোকও আছে, যে থানার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে মামলা করে আসে। জমিজমা নিয়ে মিথ্যা মামলা হয় অহরহ। মিথ্যে মামলা হয় বলে কি আইনগুলো তুলে দিতে হবে? সেদিন কোথায় যেন পড়লাম, এদেশের নারী নির্যাতনের বেশিরভাগ মামলা মিথ্যা। কিন্তু সে কারণে নারী নির্যাতন দমন আইন রদ করা হয়নি। মামলা দিলেই হয় না, সেটা প্রমাণ করতে হয় আদালতে। কারো নামে মামলা দিল আর পরেরদিনই পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে কারাগারে ঢুকিয়ে দিলো- এটা অপক্ক মনের কল্পনা হলেও, বাস্তবতা না। মিথ্যে মামলার যুক্তি তাই টেকে না।
কেউ নির্যাতিত হলে, কারো উপর অন্যায় হলে, সে যেন সঠিক বিচার পায় সেজন্যেই আইনগুলো করা। আইনের ফাঁকফোকরের ফায়দা লুটতে অসাধুরা চেষ্টা করবেই, চেষ্টা করেই আসছে- হয়রানীমূলক মামলার কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু হাজার মিথ্যে মামলার ভিড়ে, একজনও যদি পায় সুবিচার, সেটাই আইনের সার্থকতা। আইন মানুষের অধিকারের রক্ষাকবচ। আইনটা থাকলেই সত্যি ও মিথ্যে মামলা হবে, সাক্ষ্যপ্রমাণের ব্যাপার থাকবে, নির্যাতিত সুবিচার পাবে। না থাকলে, কিচ্ছু হবে না। যারা নির্যাতিতা, তারা সারাজীবন নির্যাতিত হতেই থাকবে।
মেরিটাল রেইপের পক্ষের বরাহ শাবকদের আরেকটা কথা বলতে শুনেছি- ম্যারিটাল রেইপ নিয়ে ‘লাফাচ্ছে’ যারা, তারা বেশিরভাগই পুরুষ!
এই কথাটাতেই তাদের আসল পরিচয়টা বেরিয়ে আসে। আমাদের সমাজে একটা শিশু বেড়ে ওঠে পুরুষ কিংবা নারী হিসেবে, মানুষ হওয়ার শিক্ষাটা তারা পায়ই না। দুই পায়ের মাঝে থাকা প্রজননযন্ত্রটাই তাদের পরিচয় হয়ে ওঠে, তাদের মস্তিষ্কও থাকে দুই পায়ের মাঝেই।
আমেরিকায় রেসিজমের বিরুদ্ধে করোনাকে উপেক্ষা করেও যারা রাস্তায় নেমেছিল, তারা কেউ কালো কিংবা সাদা নয়- তারা মানুষ। ফ্লয়েডকে তারা শুধু কালো হিসেবে দেখেনি, মানুষ হিসেবে দেখেছে বলে, তার আর্তচিৎকার তাদের মানবসত্ত্বায় লেগেছে বলেই স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করেছে রাজপথ, টিয়ারগ্যাস খেয়েছে, পুলিশের লাঠির বাড়ি খেয়েছে। মার্টিন লুথার কিং এর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যারা অংশ নিয়েছিল, তাদের গায়ের রঙও সাদা কিংবা কালো ছিল না, তারা মানুষই ছিলে সকলেই, চামড়াটা ছিল আবরণ।
আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে আপনাকে আদিবাসী হতে হবে না, গে-রাইট নিয়ে উচ্চকণ্ঠ হতে আপনাকে সমকামী হতে হবে না, নারী অধিকার নিয়ে কথা বলতেও, আপনাকে নারী হতে হবে না। আপনাকে শুধু মানুষ হতে হবে, একটা সুস্থ বিবেক আর চিন্তা করার মতো একটা মস্তিষ্ক থাকতে হবে। কে জানত, জন্মসূত্রে মানুষ হলেও, মানুষ হওয়াটা এতোটা কঠিন?
এই আধামানবেরা ভুলেই গেছে, হাজার বছরের অশিক্ষা, পিতৃতান্ত্রিক ও পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতা নারীদের 'নারী' হিসেবেই বাঁচিয়ে রেখেছে, যেমন তাদের করে রেখেছে পুরুষ। কয়েকপুরুষের দাসেরা যেমন জানত না, স্বাধীন মানব হয়ে বাঁচার অধিকার তাদের আছে, তেমনই জানে না এদেশের অধিকাংশ নারীও। পুরুষতন্ত্র আর পুরুষতন্ত্রের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ধর্ম তাদের নত হতে শিখিয়েছে, বিনীত ও শাসিত হতে শিখিয়েছে, তাদের দেহকে আবৃত করতে শিখিয়েছে, পুরুষদের উপর নির্ভরশীল হতে শিখিয়েছে। তাদের মনন, চিন্তা, চেতনা নিয়ন্ত্রণ করে পুরুষতন্ত্র। তারা যে স্বপ্ন দেখে, সেটাও পুরুষনিয়ন্ত্রিত। তাদের প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ পুরুষনিয়ন্ত্রিত- এদেশের নারীরা পচা মাছ কেনায় স্বামীর সাথে ঝগড়া করবে কিন্তু তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপে রইবে নিশ্চুপ। আপনি আপনার বাড়ির কাজের মহিলাকে, আপনার মাকে কিংবা শিক্ষিকাকে খুব সম্ভব তাই মেরিটাল রেইপ নিয়ে কথা বলতে শুনবেন না, প্রতিবাদ করতে দেখবেন না। শিক্ষা ও প্রস্তুতি ছাড়া কেউ হুট করে বিপ্লবী হয়ে উঠবে না। যারা প্রতিবাদ করছে, কথা বলছে, তারা এই পুরুষতন্ত্রের সাইকেল ভাঙার চেষ্টা করছে, তাদের পরিচয় নারী কিংবা পুরুষ না- তারা বিবেকসম্পন্ন মানুষ।
ম্যারিটাল রেইপ নিয়ে বিতর্ক বেশ কয়েকদিন ধরেই চোখে আসছে। ম্যারিটাল রেইপের পক্ষে যারা কথা বলেছে, বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করেছি, তারা সবাই পুরুষ কিংবা নারী, সংখ্যালঘু কিংবা সংখ্যাগুরু, বাঙ্গালী কিংবা পাহাড়ি, স্ট্রেইট কিংবা গে, সাদা কিংবা কালো- এসব ছাপিয়ে তারা কেউ মানুষ নয়। মানুষ হলে, রেইপ ভিক্টিমের বিপক্ষে কিবোর্ডে হাতে নিতে পারত না; ভিক্টিমের বিক্ষত, বিধ্বস্ত মুখ আর নির্বাক চাহনি ভাসত চোখে।
আমাদের প্রায় দুইশো বছর পুরাতন দণ্ডবিধিতে মেরিটাল রেইপের শাস্তি নেই বলে আর স্বাধীন হওয়ার প্রায় ৫০ বছর পরও সে আইন সংশোধন করা হয়নি বলে আইনপ্রণেতাদের নিয়ে ব্যাঙ্গ করেছি, তাদের আনাধুনিক, একচোখা, পুরুষতান্ত্রিক জেনে মনে মনে গালি দিয়েছি। কিন্তু এখন, ম্যারিটাল রেইপ নিয়ে আশেপাশের মানুষদের মন্তব্য দেখে, তাদের বিকৃত মননের কুৎসিত রূপ দেখে, তাদের দ্বারা আবৃত হয়ে আছি বলে, নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে, ঘৃণা হচ্ছে। আইনপ্রণেতারা তো এই স্থুলবুদ্ধি, সেক্সিস্ট আর সাম্প্রদায়িকদেরই প্রতিনিধি।
ছবিসূত্রঃ Share-Net Bangladesh
এবং উইকিপিডিয়া
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০২০ রাত ১০:৪৬
১৬টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×