বিধাতার গৎবাঁধা সেই চিরন্তন নিয়ম চলে যেতে হবে এই নির্মম সত্য মেনে যেতে কারো আপত্তি নেই। কিন্তু এই ভাবে কেন? এই ভাবে চলে যাবার কোন মানে ছিল? বিভিন্ন কারনে এই ২০১১ সালটি বেশ স্মরণীয় হয়ে উঠেছে। আর শোকের এই অগাস্ট মাসে সেই শোক যেন আরও বেশি করে কঠিন এবং অমসৃণ এক ভারী পাথর হয়ে আমাদের বুকের উপরে চেপে বসেছে। শোকের মাসে আমরা কেমন করে যেন শোক আর শোকের অথৈ মহাসাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি। এই শোক গুলি কেমন করে জানি আমরা আর সইতে পারছিনা। আমরা আজ ভারাক্রান্ত। এত শোক সইবো কি ভাবে?
মিশুক মুনির স্যার যাকে বলা হয় বাংলার সায়মন ড্রিং
মিশুক মনির। শ্রুতি মধুর ছোট্ট একটি নাম। খুব কাছ থেকে যারা দেখেছেন তারা বেশ ভালভাবে তার সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে পারবেন। বর্তমান সরকারের জ্বালানী উপদেষ্টা ম তামিমের বাল্যবন্ধু তিনি। গতকাল এটিএন নিউজে এসে তিনি একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। একে একে বর্ণনা করতে থাকেন কাজ পাগল এই মানুষটির সম্পর্কে। সদালাপি, মিষ্টভাষী, আর গভীর এক দেশ প্রেম আজীবন বুকে লালন করে থাকা সাদা মনের ঐ মানুষ টি তামাম পৃথিবীর সেনসেটিভ সব খবর সংগ্রহ করে বিশ্ব দরবারে প্রচার করে বেড়াতেন। সেই মানুষ টি আজ খবরের শিরোনাম। প্রকৃতির নির্মম আর নিষ্ঠুর এক হিংস্রতার শিকার হলেন তিনি। গর্ব করে কোনদিন ও যেই ব্যক্তি একটি বারের জন্যও বলেননি তিনি শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনির চৌধুরীর সন্তান! জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরী তার চাচা আর বিখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ফেরদৌসি মজুমদার তার ফুপু। নিজ গুনে তিনি পরিচিত হয়েছেন বিশ্ব দরবারে। নিজের নামের উপর সুবিচার করেছেন তিনি স্ব মহিমার গুনে। সেই প্রিয় মিশুক স্যার আজ অন্তরালে!
এই দেশের টি ভি ব্রডকাস্ট নিউজের জনক মিশুক মুনির। যে পথ দেখায় সে সব সময় এগিয়ে থাকে। ৯৬ এর দিকে বাংলাদেশের টি ভি জগতে বিস্ময় নিয়ে যোগ হয় একুশে টি ভি। বাংলাদেশের ইতিহাসে সেই সময়ের একুশে টিভির নিউজ মাইলফলক হিসাবে কাজ করে এবং পরবর্তীতে যতগুলি টি ভি চ্যানেল প্রতিষ্ঠিত হয় এই দেশে সব চ্যানেল গুলি ইটিভির সেই আইডিয়া কে ফলো করে। আজকের মুন্নি সাহা, সুপন রায়, জ ই মামুন, সাহানাজ মুন্নি, সামসুদ্দিন হায়দার ডালিম, মোস্তফা ফিরোজ, রুমি নোমান, সালেহ বিপ্লব, সহ বর্তমান সময়ের সব বাঘা বাঘা রিপোর্টার গুলি মিশুক মনির স্যার এর হাতে গড়া। এই দেশের বর্তমান সব টি ভি চ্যানেল গুলির বার্তা প্রধানদের গুরু মিশুক মুনির।
ক্যামেরার পেছনের এই মানুষটি কাজ করেছেন বিবিসিতে।কাজ করেছেন কানাডার রিয়েল টেলিভিশনের হেড অব ব্রডকাস্ট অপারেশনস্ হিসেবে দীর্ঘ আট বছর। কিন্তু বিত্ত আর বৈভব কোনদিন কাছে টানেনি এই সাদা মনের মানুষটিকে। লাগজারিয়াস জীবন রেখে তাইতো তিনি ছুটে এসেছেন তার প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশে। উদ্দেশ্য একটাই। দেশকে কিছু দেওয়া। শুরু ও করেছিলেন। কিন্তু শেষ আর হলনা। হলিউড এর প্রযুক্তি তিনি ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন নিউজ রুমে। আজ সব স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেল বুঝি। দেশকে ভালবাসার মহান এক ব্রত নিয়ে আগামীর বাংলাদেশ গড়ার মহতি সেই উদ্যোগ আজ থমকে গেছে। অনেক কিছুই দেবার ছিল তার। বিশ্ব দরবারে ছি এন এন এর মতন নিউজ চ্যানেল এই বাংলাদেশের বুকে প্রতিষ্ঠিত করার এক বাস্তব স্বপ্ন দেখা মানুষটি চলে গেলেন স্বপ্নের দেশে। নিজ জীবন বাজিরেখে এই মানুষটি ‘রিটার্ন টু কান্দাহার’, ‘ওয়ার্ডস অব ফ্রিডম’ প্রামাণ্যচিত্রগুলো বানিয়েছিলেন।
তারেক মাসুদ- সিনেমার ফেরিওয়ালা
কঠিন ধর্মীয় এক অনু শাসনের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা এই মানুষটি পড়েছেন মাদ্রাসায়। কিন্তু রক্তে যার সৃষ্টির নেশা সে তো সৃষ্টি সুখের উল্লাসে বিভোর হবেনই। বিশ্ব চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের যিনি এই বাংলাদেশের মুভি দেখতে বাধ্য করিয়েছিলেন তিনি সিনেমার ফেরিওয়ালা তারেক মাসুদ। তার মৃত্যুর সাথে এই দেশের ব্যতিক্রম ধর্মী চলচ্চিত্রের যেই অপার সম্ভাবনা সেই সুযোগ শেষ হয়ে গেল। বাংলা চলচ্চিত্র কে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত করা মাটির ময়না খ্যাত এই পরিচালক দেশকে দিতে শুরু করেছিলেন মাত্র। কিন্তু সেই স্বপ্নের অসম এক সমাপ্তি ঘটলো। ১৯৮৯ সালে চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানকে নিয়ে ‘আদম সুরত’ নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন তারেক মাসুদ। এবং এই দেশে তিনি ঐ আদম সুরত দিয়ে নিজেকে অন্যভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর ১৯৯৫ সালে তার নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘মুক্তির গান’ ও ১৯৯৬ সালে ‘মুক্তির কথা’ প্রশংসিত হয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। এরপর ২০০২ সালে তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মাটির ময়না’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে নিয়ে যায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। কান চলচ্চিত্র উৎসবে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে এই ছবি। মার্কিন বংশোদ্ভূত স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ ছিলেন এই চলচ্চিত্রের সহ-পরিচালক। এরপর ‘অন্তর্যাত্রা’ (২০০৬) ও ‘রানওয়ে’ (২০১০) নামে আরও দু’টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন মাসুদ ও ক্যাথরিন।সর্বশেষ ‘কাগজের ফুল’ নামে আরেকটি ছবি বানানোর কাজে হাত দিয়েছিলেন এই ফেরিওয়ালা। কিন্তু তার সদাই আর কেউ কিনতে পারল না। গতকাল গিয়েছিলেন তিনি সেই কাগজের ফুল ছবির লোকেশন দেখতে। কিন্তু সেই যাওয়া ই শেষ যাওয়া হয়ে গেল তার জীবনে।
আসলেই নির্মম আর হৃদয় বিদারক গতকালের সেই ঘটনায় গোটা দেশ আজ শোকে স্তব্ধ। সকল কণ্ঠ আজ বানী হারিয়েছে। এই নির্মম অপ মৃত্যু কি ভাবে মানতে পারবে জাতি? এত শোক সইবার ক্ষমতা যে আমাদের নেই। ক্ষণজন্মা এই অসাধারন প্রতিভাবান মানুষ দুটি আজ চলে গেলেন দূর আকাশের দূর নক্ষত্র হয়ে। তারার দেশের সেই অগনিত তারকারাজির মাঝে পশ্চিম আকাশের কোনে প্রতি সন্ধ্যায় উকি দেবে আমাদের মিশুক আর তারেক! আর আমাদেরকে ডেকে ডেকে বলবে হে বাংলার মানুষ তোমাদের কে অনেক কিছুই দেবার ছিল আমাদের। কিন্তু আমরা পারিনি। আমাদের অসমাপ্ত কাজগুলো তোমরা শেষ করে নিয়। আর হ্যাঁ তোমরা সবাইকে জানিয়ে দিয় আমরা ভাল আছি। বেশ ভাল আছি।
লেখাটি বি ডি ব্লগে প্রকাশিত
প্রথম আলো ব্লগে প্রকাশিত