somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভাসমান /:)

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ দিনটা ভালো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এ জন্য আমার ভালো লাগে। কতো সুন্দর করে কথা বলে। ছাত্রদের কাছ থেকে যে শব্দটা সবচেয়ে বেশি শুনি, সেটা হল "মামা"। বড় ভালো লাগে শুনতে। আমি রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি কমলাপুর রেল স্ট্যাশনে। আমার কোনও গরম কাপড় নেই দেখে ছাত্রটি ২০০ টাকা দিয়ে নেমে গেলো। আমি হতবাক হয়ে তার চলে যাওয়া দেখছি। টোকাই মুটেরা তাকে বিরক্ত করছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ৬ বছর আগে ফিরে গেলাম-

"স্যার, ব্যাগটা দেন, নিয়া যাই।"
"যাহ ব্যাটা! অনেক ভারী ব্যাগ। নিতে পারবি না।"
"দেন না স্যার, পারবো!"
"বললাম তো পারবি না। আমারই নিতে কষ্ট হয়!"
"ভাত খামু স্যার। ব্যাগটা নিয়া যাই। বেশি নিমু না।"
"আচ্ছা তাহলে নিয়া যা। কতো দিতে হবে?"
"২০ টাকা স্যার। এখন ৩০ টাকার নিচে ভাত খাওয়া যায় না।"


এই পর্যায়ে স্যার অর্থাৎ যার ব্যাগ উনি ব্যাগটা মাথায় তুলে দিলেন আমার। ট্রেনে উঠার আগপর্যন্ত বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন আমার কোনও কষ্ট হচ্ছে কিনা। উনি ট্রেনের ভিতরে যেতে মানা করেছিলেন, আমি তাও ভিতরে গিয়ে একেবারে সিটে ব্যাগ নামিয়ে রাখলাম। স্যার অনেক পস্তাচ্ছিলেন, বলছিলেন "আমার বয়েসী পোলাপানদের এখন স্কুলে পড়া কথা অথচ...।" উনি ৩০ টাকা দিলেন, ১০ টাকা বখশিশ। উনার মাঝে একটা অপরাধ-বোধ কাজ করছিল, বারবার আমাকে বলছিলেন এতো পিচ্চি পোলাপানদের দিয়ে তিনি এমন কাজ করাতে চান না তাই নিজেই ব্যাগ বয়ে আনেন। আমি খুশি মনে নেমে এলাম। মুনিয়া আজ অনেক খুশি হবে। এক ট্রিপে ৩০ টাকা আমাদের কাছে অনেক টাকা। গেইটে আসতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। কাল্লু ভাই দাঁড়িয়ে আছে। তাকে টাকা দিতে হবে। কাল্লু ভাই স্ট্যাশনেই থাকে, এখানেই কাজ করে। আমি এবং আমার মতো যারা আছে এখানে তাদের সবাইকে কাল্লুভাইকে টাকা দিতে হয়। আমরা ১৫ জন আছি কাল্লু ভাইয়ের অধীনে। বিনিময়ে আমরা ইচ্ছেমত স্ট্যাশনে ঘুরতে পারি, রাতে ঘুমাই, আর কেউ এসে টাকা দাবী করে না। এলাকা ভাগ করা আছে। দক্ষিণ পাশে আমাদের যাওয়া নিষেধ, ওই দিকে আছে বজলু ভাইয়ের টোকাই গ্রুপ। কাল্লু ভাইয়ের মতো বজলু ভাই অকারণে মারধোর করে না। বজলু ভাই রসিক মানুষ, আমাদের সাথে অনেক আদর করে কথা বলে। একবার মুনিয়াকে মিষ্টি খাবার কথা বলে তার ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। মুনিয়া কাঁদতে কাঁদতে ফিরে আসে। আমি জিজ্ঞেস করায় বলেছিল বজলু ভাই নাকি তাকে জোর করে আদর করেছে। তার গালে দাগ দেখলাম, কীসের দাগ মুনিয়া আর বলে নি। যাই হোক, বজলু ভাইকে দেখলেই আমার ভিতরটা কেঁপে উঠতো। গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছিলাম আমরা দু'জন। ট্রেনের ছাদ থেকে নেমেই যার সাথে প্রথমে পরিচয় হয়, সেই হল বজলু ভাই। যাত্রীদের ব্যাগ টানা, স্ট্যাশনের বেঞ্চে ঘুমানো সব বজলু ভাইই শিখিয়ে দিয়েছিলো। তার ওখানে কিছুদিন ছিলাম, মাঝে মুনিয়ার ওই ঘটনার পর স্ট্যাশন থেকে পালিয়ে যাই। পালিয়ে এসেছিলাম রমনা পার্কে ভিক্ষা করতে। সেখানে থাকা আরও কষ্টকর, শেষে আবার সেই কমলাপুরেই ফেরত, তারপর পরিচয় হল কাল্লু ভাইয়ের সাথে। কাল্লু ভাই ভাবের মানুষ, আমাদের মাঝে যারা মেয়ে আছে তাদেরকে সে কখনই স্পর্শ করে না। স্ট্যাশনে তার নাম হিরুচী কালাম, আমরা ডাকি কাল্লু ভাই। এমনিতে ভালো কিন্তু টাকা না পেলে সে অকারণে মারধোর করে। মাঝে মাঝে কাল্লু ভাই নেশা করে লম্বা ঘুম দেয়, আমাদের জন্যে সেই দিন থাকে উৎসব, আমরা ইচ্ছেমত টাকা চুরি করি। নিজের রোজগার করা টাকা চুরির মাঝে অন্য রকম একটা আনন্দ আছে, যা কাল্লু ভাই জেগে থাকলে পাওয়া যায় না, সে ঠিক অর্ধেক টাকা নিয়ে নেয়। সদ্য পাওয়া ৩০ টাকার ১৫ টাকাই কাল্লু ভাইকে দিতে হবে দেখে আমার একটু মন খারাপ হয়ে গেল। কাল্লু ভাই বিড়ি টানছিল, আমাকে দেখেই বলল "যা গিয়ে ৩০ টাকা দিয়ে ভাত খা"। আইজ তোর মাফ। আমি খুশিতে দৌড় দিলাম। মুনিয়া এতক্ষণে আসার কথা। আজকাল সে বকুল ফুলের মালা বানায়। রোজ সকালে সে রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী, বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলে যায় বকুল ফুল কুড়াতে। সেখানেও আবার প্রতিযোগিতা, তাকে তাই অনেক ভোরে যেতে হয়। গোটা পাঁচেক মালা বিক্রি করতে পারলেই ৫০ টাকা, আমাদের জন্যে অনেক। গেইটে গিয়ে মুনিয়ার জন্যে অপেক্ষা করছি। আমার এই বোনটাকে আমি অনেক বেশি ভালোবাসি। আমরা পিঠাপিঠি ভাইবোন, মুনিয়া আমার এক বছর বড় হবে। ঘরে সৎমা ছিল, আমাদের অকারণে মারধোর করতো। মুনিয়া বাসায় থাকতো, আমি গ্রামের মাদ্রাসায় যেতাম। একদিন সকালে মাদ্রাসায় গেছি, হুজুর আমাকে তার ঘরে আসতে বললেন। হুজুর নুরানি মানুষ, সুন্দর দাড়ি রেখেছেন, কানে আতর ভেজা তুলা থাকে। আমার ঐ আতরের গন্ধটা বেশ ভালো লাগতো। উনি আমার গলায় মুখে আদর করতে লাগলেন। আমি তখন ৮ বছরের বালক, লজ্জার বালাই নেই, তাই হুজুর যখন পেন্ট খুললেন আমার, আমি অন্য কিছু ভাবি নি। উনি আমার পশ্চাতদেশ দেখছিলেন, পরক্ষণেই তীব্র ব্যথার অনুভূতি, মনে হচ্ছিল পিছনে কেউ যেন মরিচ বেটে লাগিয়ে দিয়েছে, আমি বিকট চিৎকার দিয়ে দিলাম দৌড়। মাঝরাস্তায় এসে দেখি মুনিয়া কাঁদতে কাঁদতে আসছে, তার গালে গরম ছ্যাঁকার দাগ। সেই যে আমরা দুজন ঘর থেকে পালিয়ে আসলাম, আর ফিরে যাই নি। ট্রেনে উঠে পড়েছিলাম, ট্রেনে এসে পৌঁছেছিল কমলাপুর। তারপর থেকেই আমাদের ভাসমান জীবন। মুনিয়া কুড়িয়ে পাওয়া খাবার নিয়ে আসে। আমি কিনি পাউরুটি। সব খাবার মাটিতে ঢেলে ভাগাভাগি করে আমরা খাই। রাতে ভাইবোন একসাথে গাদাগাদি করে বস্তা ফেলে ঘুমাই। আমাদের পাশেই ঘুমায় আরও কয়েকজন আমাদের মতনই।

"মামা, যাত্রাবাড়ী যাবেন?"
সম্বিৎ ফিরল যাত্রীর ডাক শুনে। যাত্রাবাড়ীতে উড়াল সেতু হচ্ছে। ঐ দিকে এখন নরক গুলজার অবস্থা। যাত্রীকে বিনয়ের সাথে না করে দিলাম। যাত্রীকে না বলতে আমার খারাপই লাগে। সাধারণত আমি যাত্রীদের না বলি না। যাত্রীরা যা ভাড়া দেয় তাই মেনে নিই। অনেক রিকশাওয়ালাই নিরীহ যাত্রী পেলে ঠকায়। আমার খুবই খারাপ লাগে। আমি কখনই বেশি ভাড়া দাবী করি না। জীবন আমাকে কষ্ট করতে শিখিয়েছে। আমি জানি কষ্টের টাকার কি মূল্য। কাল্লু ভাইকে এখন আমার ঘৃণা লাগে। কাল্লুর জায়গা নিয়েছে এখন আরেকজন। কাল্লু ভাইয়ের সারা গায়ের চামড়া খসে পড়ে যাচ্ছে। ফুটপাথে শুয়ে থাকে সে, পথচারীরা মাঝে মাঝে ভিক্ষা দিয়ে যায়। আমার সাথে একবার অনেক দিন পর দেখা, মনে আছে আমাকে বলেছিল "তুই অনেক বড় হয়ে গেছিসরে মাসুদ! তুই আরও বড়ো হবি, খালি কাউরে মাইরা খাইস না।" দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আজ কাল্লু ভাইকে মৃতপ্রায় অবস্থায় ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখে। আমি এখন স্ট্যাশনে থাকি না, বলা বাহুল্য আমার খানিকটা অবস্থার উন্নতি হয়েছে। আমি এখন রাজপথে রিকশা চালাই, থাকি কমলাপুরের বস্তিতে একটা ছাপরা ঘর ভাড়া করে। মুনিয়া সন্ধ্যাবেলায় মুখে রঙ মেখে বস্তির আশেপাশে ঘুরঘুর করে গভীর রাত অবধি। মাঝে মাঝে কয়েকজন অপরিচিত লোকের সাথে সে কোথায় যেন চলে যায়। পরদিন সকালে ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে ফিরে আসে। কখনও বা তার মুখে থাকে জখমের চিহ্ন। আমি জিজ্ঞেস করি না তাকে কোনকিছু। আমার ইচ্ছে করে না।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৪:১৯
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

সম্পর্ক

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২


আমারা সম্পর্কে বাঁচি সম্পর্কে জড়িয়ে জীবন কে সুখ বা দুঃখে বিলীন করি । সম্পর্ক আছে বলে জীবনে এত গল্প সৃষ্টি হয় । কিন্তু
কিছু সম্পর্কে আপনি থাকতে চাইলেও থাকতে পারবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×