পরিচালনা কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপির অন্যায় হস্তক্ষেপে স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে অচলাবস্থরা সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, পাঁচ শতাধিক ছাত্রীকে অবৈধভাবে ভর্তি করার পরও সভাপতির অন্যায় আবদার পূরণ না হওয়ায় রোষানলে পড়েছেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রোকেয়া আক্তার বেগম। চাকরির মেয়াদ আরও প্রায় ১০ মাস থাকা সত্ত্বেও কোনো কারণ দর্শনো নোটিশ ছাড়াই তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এরপর ছয়জন বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষককে ডিঙিয়ে একজনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি নতুন অধ্যক্ষকে সহযোগিতা না করলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ারও হুমকি দেয়া হয়েছে।
এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত কোনো কেন্দ্র সচিব নির্ধারণ করা হয়নি। পরীক্ষা নেয়ার প্রস্তুতিতেও ব্যাঘাত হচ্ছে। হাইকোর্টের রায়, নাকি সভাপতির অফিস আদেশ—কোনটি মানা হবে, তা নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েছেন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। এ অবস্থায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে গতকাল ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম উপলক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও স্কুলে উপস্থিত হয়েছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। এদিকে শনিবার এক অফিস আদেশ জারি করে কয়েকদিনের জন্য বিদেশে গেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি। এ আদেশে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ উপেক্ষা করে নতুন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে দায়িত্ব পালন ও সব শিক্ষক-কর্মচারীকে তাকে সহযোগিতা করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এর আগে বৃহস্পতিবার গভর্নিং বডির এক সভায় নতুন অধ্যক্ষ নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। অথচ ওইদিনই অধ্যক্ষ রোকেয়া আক্তার বেগমের রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট কোনো অধ্যক্ষ নিয়োগ করার ওপর এক মাসের জন্য স্থগিতাদেশ জারি করেছেন। এতে অবস্থা আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। বিদেশে থাকায় গতকাল এ বিষয়ে রাশেদ খান মেননের কোনো বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অভিভাবক প্রতিনিধি আমার দেশকে বলেন, পরিচালনা কমিটি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে কোনো কিছু ভুল হয়নি। ভর্তিবাণিজ্যের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে দাবি করেন তিনি।
গতকাল সকাল সাড়ে ৭টায় বেইলি রোডে প্রতিষ্ঠানের মূল শাখায় গিয়ে দেখা যায় গেটে দারোয়ান ছাড়া আর কেউ নেই। ৮টার পর থেকে বিজ্ঞান বিভাগের ব্যবহারিক পরীক্ষার কয়েকজন ছাত্রী ও শিক্ষক আসতে শুরু করেন। সাড়ে ৮টায় অধ্যক্ষ রোকেয়া আক্তার বেগম এসে অধ্যক্ষর চেয়ারে বসেন। অফিস খোলা থাকায় টুকটাক কিছু দাফতরিক কাজকর্ম সারেন। সকাল ৯টার পর আসেন রাশেদ খান মেননের নিয়োগপ্রাপ্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শায়লা আহমেদ। তিনি সরাসরি টিচার্স রুমে গিয়ে অন্যান্য শিক্ষকের সঙ্গে বসেন। আর অন্য শিক্ষকরাও একে একে স্কুলে আসেন এবং হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেন। তারা স্কুলের বারান্দায়, করিডোরে, টিচার্স রুমে বসে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করেন। দুপুর ২টা পর্যন্ত স্কুলে উপস্থিত থাকেন তারা।
অধ্যক্ষ রোকেয়া আক্তার বেগমের অভিযোগ অনুযায়ী ভর্তিবাণিজ্যের ক্ষেত্রে সব চাহিদা পূরণ করতে না পারার জন্যই কোনো কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়াই হঠাত্ করে তাকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। নতুন অধ্যক্ষকে দায়িত্ব বুঝিয়ে না দেয়ায় ২৬ মার্চ বিকালে টেলিফোনে তাকে রাশেদ খান মেনন গালিগালাজ করেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। রোকেয়া আক্তার বেগম বলেন, ‘পুলিশ দিয়ে চুলের মুঠি ধরে কলেজ থেকে বের করে দেব’—এমন কথাও বলেছেন রাশেদ খান মেনন।
রাশেদ খান মেননের নিয়োগপ্রাপ্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শায়লা আহমেদ আমার দেশকে বলেন, বৃহস্পতিবার হঠাত্ করেই সভাপতি আমাকে ডেকে নিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষর দায়িত্ব নিতে বলেন। তিনি ডাকার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি এ বিষয়ে কিছুই জানতে পারিনি। তারপরও আমি সভাপতিকে বলি যে, আমার আগে আরও ছয়-সাতজন বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষক আছেন। নিয়ম অনুযায়ী তারাই আগে ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক হবেন। তখন তিনি আমাকে বলেন, তারা সবাই পূর্ণাঙ্গ অধ্যক্ষ পদে নিয়োগের জন্য আবেদন করেছেন। আমি বলেছি, তাদের মধ্যে একজন আবেদন করেননি। তারপরও সভাপতি আমাকেই দায়িত্ব দেন। তিনি বলেন, ২৭ তারিখের মধ্যে অধ্যক্ষ নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যাবে। শুধু এই তিন-চারদিনের জন্য তুমি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন কর। এর বাইরে আমি আর কিছুই জানি না। তবে অধ্যক্ষ রোকেয়া আক্তার বেগম যেহেতু আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে এসেছেন, এখানে আমার আর কিছুই বলার নেই।
অধ্যক্ষ রোকেয়া আক্তার বেগম ও শায়লা আহমেদ দু’জনই জানান, তাদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। বরং সুসম্পর্ক রয়েছে। তারা শুধু পরিস্থিতির শিকার।
অধ্যক্ষ রোকেয়া আক্তার বেগম আমার দেশকে বলেন, এবছর নতুন ছাত্রী ভর্তির ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা ভিকারুননিসার ইতিহাসে আগে কখনও ঘটেনি। এখন পর্যন্ত এ স্কুলে প্রায় ১ হাজার ৬শ’ শিক্ষার্থীকে নতুন ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে শতকরা ৬৫ ভাগ ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে করা হয়েছে। বাকি ৩৫ ভাগ ভর্তি গভর্নিং বডির সভাপতি, সদস্য, মন্ত্রণালয়সহ সমাজের বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তির সুপারিশের ভিত্তিতে করা হয়েছে। পরীক্ষার আগে সভাপতি ১৫টি ও শিক্ষক প্রতিনিধিসহ সব সদস্য প্রত্যেকে ৭টি করে মোট ৭১টি ফরম স্কুল থেকে স্বাক্ষর করে বাড়িতে নিয়ে গেছেন, যে ঘটনা অতীতে কখনও ঘটেনি। সেই ৭১ ফরমে আবেদন করা সবাইকে ভর্তি করা হয়েছে। এরপর সভাপতি রাশেদ খান মেনন কোনো স্বাক্ষর ছাড়া আরও ১৫০ ছাত্রীর তালিকা তৈরি করে পাঠান। এদেরও ভর্তি করা হয়। এর বাইরে টেলিফোনে সুপারিশের ভিত্তিতেও অনেক ছাত্রী ভর্তি করাতে বাধ্য হই। তাদের সঠিক সংখ্যা এখনও হিসাব করা হয়নি। এদের ভর্তি করাতে গিয়ে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ছাড়াই আসনসংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। এ কারণে যেখানে প্রথম শ্রেণীর প্রতি শাখায় ৬০ শিক্ষার্থী থাকার কথা, সেখানে এখন গড়ে ৮০ জন হয়েছে। প্রথম শ্রেণীর ১৭টি শাখার প্রতিটিতেই ২০ থেকে ২২ জন করে বেশি ছাত্রী ভর্তি করা হয়েছে। শিক্ষকদের এখন এত বেশিসংখ্যক শিশুকে পাঠদান করাতে সমস্যা হচ্ছে। এরপরও পরিচালনা কমিটির সদস্যরা আরও ভর্তি করার সুপারিশ নিয়ে আসেন। কিন্তু সেটা পূরণ করতে পারিনি বলেই ক্ষোভের কারণে নতুন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ করেছেন সভাপতি।
অধ্যক্ষ রোকেয়া আক্তার বেগম স্বীকার করেছেন, তিনি সুপারিশে যেসব ভর্তি করেছেন, তা অন্যায় হয়েছে। এসব ভর্তি বাবদ ছাত্রীপ্রতি দুই থেকে চার লাখ টাকা করে নেয়া হয়েছে—এমন অভিযোগ তিনি শুনেছেন। এক্ষেত্রে তার আরও শক্ত অবস্থান নেয়া ভালো ছিল বলে তিনি মনে করেন। কিন্তু পরিচালনা কমিটির চাপে তাদের সঙ্গে সমঝোতা করা ছাড়া উপায় ছিল না বলে জানান তিনি।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, ভর্তি করা ছাড়া গত প্রায় দু’বছরে কোনো ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ করেনি পরিচালনা কমিটি। তাদের একটাই কাজ—ভর্তি করানো। কমিটির চারজন অভিভাবক প্রতিনিধির মধ্যে দু’জনেরই কোনো সন্তান বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানে পড়ে না। একজনের মেয়ে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। আর মাধ্যমিক পর্যায়ের একজন অভিভাবকের মেয়ে একাদশ শ্রেণীতে ওঠায় তার সদস্যপদ ঢাকা শিক্ষা বোর্ড বাতিল করেছে। কিন্তু তারপরও তারা পদ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন না। একই অবস্থা শিক্ষক প্রতিনিধির ক্ষেত্রেও। শিক্ষকদের এখন পর্যন্ত নতুন পে-স্কেল অনুযায়ী বেতন দেয়া হয়নি।
অধ্যক্ষ রোকেয়া আক্তার বেগমের চাকরির মেয়াদ আগামী বছর ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আছে। তাই তিনি চান তার মেয়াদ পূর্ণ করে সম্মানজনকভাবে চাকরি ছাড়তে।
এদিকে শনিবার রাশেদ খান মেননের জারি করা অফিস আদেশে তিনি বলেন, অধ্যক্ষ নিয়োগ পরীক্ষার প্রার্থী হওয়ায় সরকারি বিধি মোতাবেক রোকেয়া আক্তার বেগমকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষর পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গত ৪ ফেব্রুয়ারি জারি করা পরিপত্র অনুযায়ী রোকেয়া আক্তার বেগম একাধিক তৃতীয় বিভাগ প্রাপ্ত হওয়ায় অধ্যক্ষ নির্বাচিত হতে পারবেন না জেনে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন। এমনকি তিনি হাইকোর্ট থেকে অধ্যক্ষ নিয়োগের বিষয়ে একটি নিষেধাজ্ঞাও এনেছেন। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে কাউকে দায়িত্ব দেয়ার বিষয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। সেহেতু শায়লা আহমেদই বৈধ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। এ কারণে প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় আর্থিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করার জন্য মিসেস শায়লা আহমেদই বৈধ ও অনুমোদিত ব্যক্তি। তাই তিনিই প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। কেউ এ ব্যাপারে অসহযোগিতা করলে বা অন্য কারও সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
Click This Link
পুলিশ দিয়ে চুলের মুঠি ধরে বের করে দেব, অধ্যক্ষকে হুমকি
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
১৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?
মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়
প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন
চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)
সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন
যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।
আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন
তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?
আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন