আজ রাতে ঠাণ্ডা মনে হয় আরও বেড়েছে। সন ২০৫০, জুলাই মাস, কিন্তু রাতের তাপমাত্রা প্রায় -৫ ডিগ্রি ছুয়েছে। রুম হিটার থাকায় তাও রক্ষা। মাহফুজের ঘুমটা ভাঙল অস্বস্তি নিয়ে, নিঃশ্বাস নিতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। তাড়াতাড়ি রুমের অক্সিজেনের মাত্রাটা দেখে নিল মাহফুজ। আশ্চর্য, কালকে রাতেইতো অক্সিজেন ঠিকঠাক ছিল। তাহলে মনে হয় অক্সিজেন টিউবটা নতুন করে রিফিল করে নিতে হবে। অস্বস্তি নিয়েই মাহফুজ অফিসের জন্য প্রস্তুত হল। সাড়ে সাতটার মধ্যে না বের হতে পারলে আজকেও দেরি হয়ে যাবে। অফিসের সময়টা তার একদম ভাল লাগে না। এত ট্রাফিক জ্যাম পার করে কি ১১টা – ৩টা অফিস করা যায় ? তাও অবশ্য ভাল, সে শুনেছে ২০১২ তে নাকি ৯টা – ৫টা অফিস করতে হতো !! কিভাবে সেটা সম্ভব হতো এখনো সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে সে মনে করে অক্সিজেন মাস্কটা পরে নিল। নইলে গাড়ি পর্যন্ত যেতে যেতেই শ্বাস বন্ধ হওয়ার সমূহ সম্ভবনা আছে।
মাহফুজ গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে আজ ৩ নাম্বার ফ্লাইওভার দিয়ে যেতে বলল। গতকাল ৪ নাম্বারটা দিয়ে গিয়ে পুরো ধরা খেয়েছে। ঢাকায় এখন প্রতি রাস্তার উপর দিয়ে ৫টা করে ফ্লাইওভার হয়েছে। কিন্তু কোনটার জ্যামের অবস্থা কত খারাপ, আগে থেকে তা অনুমান করা অসম্ভব। মনে মনে সে ভাবল আজকে ৩ নাম্বার দিয়েই সুযোগটা না হয় নেই। কিছু দূর যেতেই, ড্রাইভার বলল,
‘স্যার, গাড়ির ভিতরে অক্সিজেনের মাত্রা অনেক কমে গেছে। সামনের ষ্টেশন থেকে কি ভরে নিব?’
‘ঠিক আছে নাও।‘
ঢাকায় এখন পেট্রল, সিএনজি ষ্টেশনের মত অনেক অক্সিজেন রিফুয়েলিং ষ্টেশন আছে। যদিও অনেক লম্বা লাইন, কিন্তু না গিয়ে তো উপায় নেই! প্রায় এক ঘণ্টা লাইনে দাড়িয়ে থেকে অক্সিজেন রিফুয়েল করা গেল।
৩ নাম্বার ফ্লাইওভারের অবস্থা একেবারেই যা তা আজকে। যত দূর দেখা যায়, গাড়িগুলোর কোন নড়াচড়া নেই। গাড়ির জানালা দিয়ে মাহফুজ আকাশের দিকে তাকাল। উপরের উড়ন্ত গাড়িগুলো ও দেখা যাচ্ছে লাইন দিয়ে দাড়িয়ে আছে। ঢাকার বড়লোকেরা এখন উড়ন্ত গাড়ি ব্যাবহার করেন। মাহফুজ মধ্য আয়ের মানুষ। তাই অনেক শখ থাকা সত্ত্বেও সে এখনো কোন উড়ন্ত গাড়ির মালিক হতে পারেনি। তবে আকাশের জ্যামের অবস্থা দেখে মাহফুজ মনে মনে একটু হেসে নিল। নিজেকেই সান্ত্বনা দেওয়ার একটা চেষ্টা!
‘দবির, এসিটা বাড়িয়ে দাও’, মাহফুজ ড্রাইভারকে বলল।
‘স্যার, এসি ফুল!’
গরমটাও যা পড়েছে। বাইরে এখন প্রায় ৪০ ডিগ্রি। মনে হচ্ছে গাড়িটা বদলেই ফেলতে হচ্ছে। নতুন মডেলের একটা গাড়ি এসেছে বাজারে, গাড়ির তাপমাত্রা যে ২৫ ডিগ্রি পর্যন্ত নামাতে পারে।
গাড়িতে বসে থেকে কি করবে, চিন্তায় পড়ে গেল মাহফুজ। ভাবল, ইন্টারনেট থেকে খবরটা দেখে নেয়া যাক। ল্যাপটপ খুলেই সে দিনের আবহাওয়ার আপডেটটা দেখে নিল। সর্বোচ্চ ৫৬ ডিগ্রি, সর্বনিম্ন -৭ ডিগ্রি, বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ২৬%। গ্রীন হাউস এফেক্ট মনে হয় আরও বেড়ে গেছে। অন্য খবরগুলোতে এবার সে চোখ বুলাতে শুরু করল। সারা দেশে প্রচণ্ড গরম ও ঠাণ্ডায় প্রায় ৫০০ জন মারা গেছে গতকাল। কি যে হচ্ছে এই দেশটার!! মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এইদিকে, তার ঘনিষ্ট বন্ধুর ধরা পরেছে স্কিন ক্যান্সার। পরিচিতদের মধ্যে তাকে নিয়ে এমন ছয়জনকে পাওয়া গেল। ডাক্তাররা বলেন Ozone স্তর নীচে নেমে যাওয়ায় নাকি এখন স্কিন ক্যান্সার বেশি হচ্ছে। এম্নিতেই অশুখ-বিশুখ আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে।
বিদেশের পাতায় দেখা গেল একটা ইন্টারেস্টিং খবর। প্রায় পাঁচ বছর পর নাকি একটা পোলার ভাল্লুক দেখতে পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরাও অবাক, এত বছর পর এইরকম একটা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ভাল্লুক কিভাবে পাওয়া গেল!! বৈশ্বিক উষ্ণতার কারনে পোলার ভাল্লুকের সাথে আরও অনেক স্থলজ আর জলজ প্রাণী আজ বিলুপ্ত। খবরটা পড়তে পড়তেই মাহফুজের বাবার কথা মনে পড়ে গেল। ছেলেবেলায় বাবা গল্প করতেন, আমাদের দেশে ইলিশ নামে একটা মাছ ছিল। খেতে নাকি ছিল অসাধারণ! কিন্তু অতি মাত্রায় মাছ ধরা আর বৈশ্বিক উষ্ণতার কারনে বহু বছর আগেই তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে ! তার জেদের কারনেই বাবা তাকে একবার যাদুঘরে নিয়ে গিয়ে ইলিশ মাছের ফসিল দেখিয়ে এনেছিলেন।
সাড়ে দশটা বাজে। মাহফুজ ল্যাপটপটা বন্ধ করে আবার রাস্তার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। অফিস, তুমি আর কত দূর!!!!