ফেব্রুয়ারী ১২, ২০৫০। শাহেদের আজ চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার দিন। শেষ হয়ে যাবে তার ঊনচল্লিশ বছরের কর্মজীবন। জীবনের এই প্রান্তে এসে নিজেকে তার অনেক পরিপূর্ণ মনে হল। পিছনের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল, যা পেয়েছি এই ষাট বছরের জীবনে তা এক দমই মন্দ নয়। ভোরে প্রাতঃভ্রমণে যাওয়া তার অনেক পুরনো একটা অভ্যাস। দেরি না করে তাই সে রাস্তায় নেমে এল। আজকের সকালটা অনেক সুন্দর। গত ত্রিশ বছরে ঢাকা শহর অনেক বদলেছে। হাটা হাটি করার জন্য এখন আর পার্কে না গেলেও চলে। ফুটপাতগুলো অনেক বড় করা হয়েছে, আর পুরো শহেরেই অনেক গাছপালাও আছে। কয়েকদিন আগেই ঢাকা শহরের একটা স্যাটেলাইট ইমেজ দেখে তার মনটা ভরে গিয়েছিল। পুরো শহর মনে হয় সবুজে ঢাকা। আহা, কি অসাধারণ!!
শেষ বারের মত অফিস করার জন্য শাহেদ প্রস্তুত হয়ে নিল। আর তারপর তাকাল তার সাইকেলটার দিকে। এই বেচারা গত ষোল বছর হল তাকে বহন করছে। আজকের এই বিশেষ দিনের জন্যই শাহেদ সাইকেল ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রেখেছে গতকাল। এখনো দেখতে পুরো নতুনের মতই লাগছে। সাড়ে আটটার দিকে শাহেদ অফিসের দিকে রউনা হল। সাত কিলোমিটার রাস্তা যেতে বড়োজোর ২৫ মিনিট লাগার কথা। ঢাকার সাইকেল লেনগুলো এককথায় চমৎকার। এমন কোন রাস্তা নেই যেখানে এখন সাইকেল লেন পাওয়া যাবে না। দুই লেন দিয়ে শয়ে শয়ে সাইকেল চলে যাচ্ছে। সেই তুলনায় মোটর গাড়ির সংখ্যা একান্তই নগণ্য।
অথচ আজ থেকে ঊনচল্লিশ বছর আগে এমনটা ছিল না। ঢাকাতে ট্রাফিক জ্যাম তখন ছিল অসহনীয়। চাকরি জীবনের শুরুতে শাহেদ অফিস থেকেই গাড়ি পেতো। কিন্তু ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে অফিস করা ছিল রীতিমত এক বিভীষিকা। শখের বশেই কয়েক বন্ধু মিলে তারা ঠিক করেছিল যে সাইকেল নিয়েই অফিস করবে। প্রথম দিকে অনেক সমস্যার ভেতর দিয়েও যেতে হয়েছে। সবাই টিটকারি মারত। আর তাছাড়া, অন্য যানবাহন গুলোও কোন অজানা কারনে সাইকেল দু’চোখে দেখতে পারত না। কিন্তু যত দিন যেতে থাকলো, শাহেদরা ততই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হল। একে একে আরও অনেকে এসে যোগ দিল তাদের সাথে। ধীরে ধীরে বিরাট একটা সাইকেল আন্দোলন গড়ে উঠল। সরকারও এই আন্দোলনের সাথে একসময় একাত্ততা প্রকাশ করল। বিদেশী গাড়ির উপর ট্যাক্স বাড়ানো, সাইক্লিং এর প্রতি জনসচেতনতা তৈরি, দেশী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাইকেল উৎপাদনে বিশেষ সুবিধা, সাইকেল পারকিং এর ব্যবস্থা করা, আলাদা সাইকেল লেন থেকে শুরু করে দরকারি সব কিছুই সরকার নিশ্চিত করল। ২০৩০ এর মধ্যে ঢাকা হয়ে গেল সাইকেলের নগরী!
এগোতে এগোতে শাহেদ কয়েকটা বৃক্ষ ভবন পার করল। বৃক্ষ ভবনের আইডিয়াটা তার দারুন লাগে। ৫০ তলা ভবনের পুরোটুকুতেই হচ্ছে নানা রকমের গাছের চাষ। শাক শব্জি, ফলমূল থেকে শুরু করে সম্ভব সবকিছুই। আর এ থেকেই শহরের চাহিদা মিটানো হচ্ছে। আর তাছাড়া সব ভবনেই দেখতে পাওয়া যায় বড় বড় সোলার প্যানেল। ঢাকা এখন আর বিদ্যুতের জন্য অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল নয়। তাই জীবাশ্ম থেকে উৎপন্ন পেট্রোল, ডিজেলের গাড়ি দেখতে পাওয়াটাই মুশকিল, মোটামুটি বেশিরভাগই এখন বিদ্দুৎ চালিত গাড়ি। তারপরও সাইকেলের তুলনায় অন্য সব যানবাহনের ব্যাবহার খুবই কম। আর দূরে কথাও যাওয়ার জন্য যেহেতু মোটর গাড়ির বিকল্প নেই, সেখানেও বেশিরভাগই ব্যাবহার করা হচ্ছে বায়োডিজেল, যা সাধারণত উৎপন্ন হয় সয়াবিনের মত বিভিন্ন রকমের ডাল জাতীয় ফসল থেকে। এমনকি উড়োজাহাজও এখন নিয়মিত বায়োডিজেল দিয়ে চলছে।
গাছপালার সংখ্যা বাড়ার কারনে ঢাকায় বাতাসও পাওয়া যায় এখন প্রচুর, বুক ভরে শ্বাস নেওয়া যায়। আর তাই আজকাল অনেকে দেখি Windmill বানাচ্ছে। সাইকেলে প্যাডল মারতে মারতে শাহেদ ভাবল, জীবদ্দশায় এমনটা দেখতে পাবে, আজ থেকে ঊনচল্লিশ বছর আগে সে কখনো কল্পনাও করতে পারত না!!
শাহেদ তার অফিসে পৌঁছে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল পৌছতে মাত্র ২০ মিনিট লেগেছে। শাহেদ আবারো একবার মনে মনে বলল, জীবনটা কি এর চেয়ে ভাল হতে পারত!!!