মেছো মান্দু, থিওরি মান্দু অথবা কাঠ পায়ের এক যুবক
___________________________________________
মান্দু তার কাঠ পায়ে ভর করে হাঁটছে, ঠক্ থুপ, ঠক্ থুপ। ওর একটা পা আসল আরেকটা পা নকল, কাঠ পা বা ক্রাচ্। এই কাঠ পা নিয়েই সে বেশ দ্রুত হাঁততে পারে, ব্যাপারটা এমন যে কিছু কিছু সময় ওর জোড়ে হাঁটা সমান সমান আরেক জনের মোটামোটি দৌড়ানোর কাছাকাছি। ব্যাডমিন্টনে মাঝে মাঝেই অনেককে হারিয়ে দেয়। দৌড়াতেও পারে সে, বেশ ভালো। মাঝে মাঝে ক্রিকেটও খেলে। তবে আম্পায়ারিং ওর বেশি পছন্দ। তাইতো এলাকার সব ম্যাচে প্রধান আম্পায়ার ঐ মান্দুই। আর মান্দুর সেরা নেশাটা হলো মাছ ধরা, হুইলে বা বর্শীতে আর ঠিক এর পরেই কার্ড খেলা, থ্রি কার্ড, নাইন কার্ড, টাকার খেলা।
মাছের খবর পেলে মান্দুর মাথা ঠিক থাকেনা। হোকনা ৫/৭ হাজার টাকার টিকেট, মাছ ধরতে তার যেতেই হবে। ভাগাভাগির সঙ্গীও পেয়ে যায়, আরো আছেনা মেছো সব। তাই টিকিট পাওয়াটাই আসল কথা টাকা কোন ব্যাপারনা মোটেও। আর টিকিট পেয়ে গেলে দিনকয়েক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় তার প্রস্তুতি। সারা বাড়ি মো মো করে মসলার গন্ধে, চারের গন্ধে। মান্দু একটা ঘোরের মধ্যে চলতে থাকে এসময়, রাতে ঘুমাতে পারেনা ঠিকমতো। বউ এর শরীরও ভালোলাগেনা ঠিকঠাক। চোখের সামনে শুধু সে হুইলের ফাতারি দেখতে পায়। এই ডুব মারলো বুঝি। আর জলের এখানে সেখানে মাছেদের কম্পন, আহ্ ওইটা ধরলো বুঝি। এরকম সময়ে মান্দুর বউ অস্থির হয়ে যায়, ওর শরীরের চাহিদা আরও বেড়ে যায়। ও বুঝে গ্যাছে, স্বেচ্ছায় এখন সে তার দেহ ছোঁবেনা। মান্দুর বউ তার ভরাট হাতখানা স্বামীর স্পর্শকাতর জায়গায় রাখে। মান্দু বিরক্ত হলেও বাধ্য হয়, সে তার স্বপ্নভঙ্গের ভেতরেও জলের মাঝে ফাতারির ওঠানামা দেখতে পায়। মান্দুর ভালোলাগে। যেখানে বর্শি, ফাতারি, মাছ, জল সেখানে মান্দুর ভালোলাগে।
শিকার ভালো হলে মান্দুর মেজাজ ফুরফুরে থাকে। সন্ধ্যার পর সাহেব বিবি গোলাম তাকে ডাকে, ডাকে আরও সব কার্ডখেঁকো বন্ধুরা। মান্দু নিজেকে কখনোই জুয়ারু ভাবেনা, ভাবেনা তার খেলার সাথীদেরও। জীবনের জন্যতো কিছুটা এন্টারটেইনমেন্টের দরকার আছে নাকি। তাই এটা জুয়ার পর্যায়ে পড়ে না। কোনদিন ২০টাকা, কোনদিন ৫০টাকা, কোনদিন ১০০টাকা থেকে লিড শুরু হয়। আনসিন সিনে তা ডাবলও হয়ে যায়। কোন কোন সন্ধ্যায় খুব বেশি হলে ৪/৫ হাজার হেরে বসে আবার কোনবার বেশি লাভ করে ফেলে। মাস শেষে গড়পরতা সমান। টাকা টাকাই থাকে, একটু আধটু এদিক সেদিক হয়ে যায় তবে মাঝখান থেকে পুরো মাস মজা আর মজা। কার্ডের নেশা যে না খেলে সে কি আর বুঝবে। মাঝে মাঝে হাইভোল্টেজ ম্যাচ চলে। সকাল থেকে রাত ১১টা অবধি। নাওয়া খাওয়ার কথা মনে থাকেনা। ফোনে মিছে কথার অভাবও থাকেনা।
এই কার্ড খেলার সময়ে মান্দু আবার অনেক থিওরি করে। এখানে থিওরি মানেটা হলো খেলার মাঝে নিজের ভাগ্য বদলানো বা অন্যের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনবার জন্য নানান কৌশল করা। যেমন সে মাঝে মাঝে পানির বোতলটা অন্যদের মাথায় থেকিয়ে নিজের বগলের নিচে চেপে রেখে দেয়। আবার কখনো নিজের বা অন্যের জামা প্যান্ট বা লুঙ্গি থেকে ঝুলে থাকা সুতো ছিঁড়ে নিয়ে নিজের নখে বা কানের সাথে পেঁচিয়ে রাখে। আবার কখনো একটি নির্দ্দিষ্ট জায়গাতে বসতে না দিলে সে খেলতে চায়না, এমন সব খাম খেয়ালিপনা আরকি। এতে মাঝে মাঝে বেশ কাজ হয় ভাগ্য বদলের, ফলে সে থিওরি ব্যাপারটাকে খুব গভীরভাবে নেয় খেলার সময়। ওর দেখাদেখি আরও দু'একজনও এমনটা শুরু করে দেয়। এগুলো হলো মজার উপর মজা আরকি। এ নিয়ে হাসাহাসিও কম হয়না। আবার হাসাহাসির মাত্রা বেশিবেশি হয়ে গেলে রাগারাগিও হয়ে যায়। মান্দুর প্রিয় কার্ড হলো ৩,৬,৯ স্পেশাল রানিং। কার্ড হাতে নিয়ে প্রথমে এদের যেকোন একটি কার্ড দেখলেই ওর ভেতরে ধরফড়ানি শুরু হয়ে যায় আর তার পরেরটা যদি সেই সিরিয়ালের আরেকটি হয় তো ওর মুখের দিকে তাকালেই বুঝা যাবে যে কিছু একটা হতে যাচ্ছে পরের কার্ডটা মিললেতো সোনায় সোহাগা আর না মিললে, হুশ্ শালা, ভাগ্যটাই খারাপ।
মান্দুর মেজাজ ফুরফুরে থাকলে ওর বউ পাশ ফিরে ঘুমানোর ভানকরে থাকলেও রেহায় পায়না। জীবনীশক্তিতে ভরপুর এই মান্দু, যে কিনা তার জীবনের প্রায় তিরিশটা বছর কাঠ পা সাথে করে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই ছোট্টবেলা বছর কয়েক বয়সে ট্রাকের চাকার নিচে পড়ে মান্দু ওর পাটা হারিয়েছিলো, একটুর জন্য শুধু জীবনটা বেঁচে গিয়েছিলো।
এখন মনে হয় ও নিজেও জানেনা যে ওর একটা পা কাঠের এবং ওর সাথে যারা নিয়মিত চলাফেরা করে, মেশে তারাও ভুলে গ্যাছে ওর কাঠপায়ের কথা।
মান্দু এক স্বতস্ফুর্ত স্বভাবের যুবকের নাম, যার একটি কাঠের পা আছে অথচ যার ভেতর বাহিরটা প্রাণশক্তিতে ভরপুর। সামনে চলার পথে কোন কিছুই তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনা। ওর লোহা লক্কলের ব্যাবসার মতো জীবনটাকেও লোহা বানিয়ে ফেলার পথে ও অনেকটা এগিয়ে গ্যাছে।।